প্রথমেই একটা ব্যাপার ব্যাখ্যা করে নিই। আমি একজন গড়পরতা মুসলমান, খুব ধার্মিক নই, নাস্তিকতাও পছন্দ করি না। আমি প্রায় ১৬ বছর আগে তদানীন্তন বিআইটি রাজশাহী থেকে ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং এ গ্র্যাজুয়েশন করে বর্তমানে একটি সরকারী প্রতিষ্ঠাণে চাকুরী করছি। অল্প কিছু বিশ্বাস (যেমন - সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্ব বা এজাতীয়) বাদে বাকী সবধরণের ঘটনারই কাযর্কারণ বোঝার বা ব্যাখ্যা পাবার চেষ্টা করি। এগুলো বলার উদ্দেশ্য নিজকে জাহির করা নয়, নিচের ঘটনাগুলোর প্রেক্ষিতে আমার অবস্থানটা পরিষ্কার রাখা।
আজ দুপুরে গিয়েছিলাম দিনাজপুর। অনেকদিন পর বন্ধুদের সাথে গল্প করতে গিয়ে শুনলাম যে ওরা জানে যে আমার বউ এর চাকরী হয়েছে। (একটু অবাক হলাম, কারণ ওদের সাথে আমার বেশ কিছুদিন যোগাযোগ নেই)। কীভাবে জানে জিগ্যেস করাতে জানালো সাইবুর ভাই বলেছে। এবার টাশকি খেলাম (সাইবুর ভাই এর কাহিনী নিয়েই এই লেখা। পড়তে থাকুন, কারণটা বুঝতে পারবেন অচিরেই)। সাথে সাথে প্ল্যান করলাম ভদ্রলোকের সাথে দেখা করতে যাবো। মোবাইলে বলতেই উনি রাজি হয়ে গেলেন। এর মধ্যে এক বন্ধু নিশার বললো তার কোন আত্মীয়কে কে যাদু করেছে, এ ব্যাপারে কথা বলতে সেও যাবে। সো, তিনজনেই রওনা হলাম একটা বাইকে।
বেশ অনেকটা পথ পেরিয়ে ওনার বাড়ি পৌছলাম বিকেল নাগাদ। আমি সালাম বিনিময়ের পর জানতে চাইলাম উনি কীভাবে খবর পেলেন যে আমার বউ চাকরী পেয়েছে? জবাবে জানলাম ওনারা জানিয়েছেন। একটু বিস্মিত হলেও কিছু বললাম না। এবার নিশার বললো তার আত্মীয়ের ব্যাপারটা। উনি আমাদের বসিয়ে এক জগ পানি, দুটা গ্লাস আর জায়নামাজ আনালেন। গ্লাসে পানি ঢেলে মিনিটখানেক দোয়া পড়লেন। এবার তিনটি বাশপাতা আর একটি সসপ্যান আনালেন। বাশপাতাগুলো আমাদেরকে ধরতে বলে সসপ্যান টা পানি দিয়ে ধুয়ে জায়নামাজ দিয়ে ঢেকে দিলেন। আমাকে বললেন সুরা ফাতিহা আর আয়াতুল কুরসি পড়তে। নিশারকে বললেন স্যান্ডেল খুলে দাড়িয়ে জায়নামাজের নিচে হাত ঢুকিয়ে সসপ্যানটা বের করতে। নিশার বের করে আনতেই দেখলাম সসপ্যানের পানিটুকু কাদাগোলা, তার মধ্যে শপিং নেটে জড়ানো একটা কাদামাখা পুটলি, দুর্গন্ধ ছাড়ছে। ওটা সসপ্যান থেকে বের করে দেখা গেলো ভেতরে বেশ কয়েকটা শামুক (অনেক আগেই অক্কা পেয়েছে), প্রায় সাদা হয়ে যাওয়া কিছু ঝিনুক, কয়েকটি কড়ি, দুটা হাড় আর চারটি তাবিজ।
জায়নামাজ দিয়ে ঢাকার আগে সসপ্যানটা খালি ছিলো, তাতে উনি গ্লাসখানেক পানি দিয়েছিলেন আমাদের সামনেই। নিজের চোখকে অবিশ্বাস করবো কীভাবে? অথচ কোন যুক্তিতেই একে ব্যাখ্যা করতে পারছিনা। ঘটনাটার ব্যাখ্যা কী কেউ দিতে পারেন? এর সাথে আগের ঘটনাগুলোরও কোন ব্যাখ্যা পাচ্ছিনা। তাই ঠিক করেছি এরপরের বার ভিডিও ক্যামেরা নিয়ে যাবো, পুরো কাজকর্ম ভিডিও করে রাখবো। অবশ্য করতে দিবে কিনা জানিনা।
কিছুদিন আগের কথা। আমার বউ মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং এ মোটামুটি ভালো সিজিপিএ (৩.৫২) নিয়ে পাশ করেও পরপর দুটো মেয়ের জন্ম, আমার সাময়িক প্রবাস এসবের চক্করে পড়ে প্রায় ৪/৫ বছর ধরে বেকার বসে আছে। আমি নিজেও পাশ করার পর বৎসরাধিককাল বেকার ছিলাম। তাই বেকারত্বের যন্ত্রণা ভালোই বুঝি। দিনে দিনে আমার মেয়েরা কথা বলা শিখে, ওর রাগ বাড়ে। প্রায় দুই বছর থেকে সম্ভাব্য সব জায়গায় এপ্লাই করে যাচ্ছি। কোথাও ডাক পড়ে, কোথাও পড়েনা। যেখানে ডাক আসে সেখানে পরীক্ষা বা ইন্টারভিউ যেমনই হোক সিলেক্টেড হয়না। এদিকে শ্বশুর - শাশুড়ি, আত্মীয় - স্বজন, বন্ধুবান্ধব সবাই বলতে থাকে এখন ধরাধরির দিন, তোমার পদমযর্দা ব্যবহার করে কোথাও ধরো, চাকরী হয়ে যাবে। এদিকে আমি ভাবছি, আমার ২.৯৯ সিজিপিএ নিয়ে যদি আমি বিনা তদ্বিরে চাকরী পেতে পারি, তাহলে এতো ভালো রেজাল্ট নিয়ে ও কেন পাবেনা? আর আমি কাউকে তেমন করে রিকোয়েষ্টও করতে পারিনা। যদিও আশেপাশে অনেককেই দেখি বেশ কায়দা করে কেমন কেমন করে যেনো নিজেদের কাজ গুছিয়ে নেয়। দিন যায়, মাস যায় - অবস্থা পাল্টায় না। আমার বিশ্বাসে চিড় ধরে। সব সংকোচ ঝেড়ে ফেলে বন্ধু বান্ধবদের কাউকে কাউকে বলি ভাই আমার বউটার জন্য একটা চাকরীর ব্যবস্থা করে দে না। সবাই আশ্বাস দেয়, কিন্তু দিন আর বদলায় না। এদিকে সারাদিন ঘরে বসে বসে মাথার মধ্যে তৈরী হওয়া বেকারত্বের চাপে বউটা আমার একবারে নাজেহাল হয়ে পড়ে। দীর্ঘ বারো বছর প্রেম করে সংসার শুরু করা বউটা শেষ পযর্ন্ত আমাকে সন্দেহ করা শুরু করে দেয়। বুঝি মানসিক বিপযর্স্ত অবস্থার কারণেই এমন করে, তবু সবসময় নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারিনা। তাই মাঝে মাঝেই ঝগড়া ঝাটি শুরু হয়ে যায়। যাকে বলে অবস্থা কেরোসিন।
আমারও মানসিক অবস্থা সুস্থির না। যে যা করতে বলে চেষ্টা করি। কেউ বলে খতম পড়াও, কেউ বলে ছদকা দাও আরো অনেক কিছু; সবই চেষ্টা করি, ফলাফল শূণ্য। এমন সময় এক বন্ধু বল্লো যে দিনাজপুর এলাকায় এক লোক আছে, জ্বীন সাধনা করে, তার কাছে যাওয়া যেতে পারে। আরো শুনলাম ভদ্রলোক কারো কাছ থেকে কোন টাকা পয়সা নেন না। সাত পাচ ভেবে রাজী হয়ে গেলাম।
বহুদূর পথ পাড়ি দিয়ে গেলাম কাহারোল উপজেলার এক প্রত্যন্ত গ্রামে। ভদ্রলোককে দেখে বলা চলে একটু আশাহতই হলাম। আমাদের মতোই বয়স, পাতলা গোফ, কামানো গাল, এভারেজ লুকিং ভিলেজ ফার্মার টাইপ। (আমার ধারণা ছিলো যে বিশাল আলখাল্লা, লম্বা দাড়ি, বড় পাগড়ি পরা কোন বৃদ্ধকে দেখবো )। যাহোক ওনাকে বললাম আমার উদ্দেশ্য। উনি আমাকে খুব আশ্বাস দিয়ে পরবর্তী শুক্রবারে সকালে যেতে বললেন। আমি আরো একটু বিভ্রান্ত হয়ে পড়লাম।
পরের শুক্রবার । সকাল সকালই মোটর সাইকেল নিয়ে রওনা দিলাম। বেলা দশটা নাগাদ পৌছলাম। অনেক লোকের ভিড়। বিভিন্ন মানুষের বিভিন্ন সমস্যা। উনি কাউকে পানিপড়া, কাউকে জড়িবুটি আবার কাউকে বা বিভিন্ন সদুপদেশ দিয়ে বিদায় করছেন। এক পযার্য়ে আমাকে ডাকলেন। আমার সামনেই একটি গ্লাসে পানি ভরে হাতে নিলেন, আমাকে বললেন একটি জায়নামাজ দিয়ে গ্লাসসহ তার হাতটি ঢেকে দিতে। আমি জায়নামাজটি ঝেড়ে তার হাত ঢেকে দিলে তিনি আমাকে সূরা ফাতিহা ও আয়াতুল কুরসী পড়তে বললেন তিনবার করে। পড়া শেষ হলে আমাকে বললেন জায়নামাজটা সামান্য উঠিয়ে তার হাতের গ্লাসটাতে তাকাতে।
তাকালাম। এবং চমকে উঠলাম। একজন সুন্দর স্বর্ণকেশী মহিলা দেখতে পাচ্ছি গ্লাসের ভেতর। আকার আকৃতিটাও এমন যেন গ্লাসের ভেতরে বসে থাকার জন্যই, অস্বাভাবিক লাগছেনা। ভদ্রলোক আমাকে গ্লাসের ভেতরে কাউকে দেখতে পাচ্ছি কিনা জিগ্যেস করলেন। আমার তখন মুখে কথা ফুটছেনা, মাথা দুলিয়ে সম্মতি জানালাম। উনি তখন আমাকে বললেন যাকে দেখতে পাচ্ছেন তাকে রিকোয়েস্ট করুন ভাবীর চাকরীর ব্যাপারে। আমি বিশ্বাস অবিশ্বাসের দোলাচলে দুলছি। এও কী সম্ভব? একবার মনে হচ্ছে এভাবে রিকোয়েষ্ট করাটা শিরক এর নামান্তর হয়ে যায়, আবার মনে হচ্ছে জ্বীন তো আল্লাহরই সৃষ্টি, আর তিনি তো কোন কিছুর উছিলা ধরেই আমার প্রার্থনা মঞ্জুর করবেন। এতসব ভাবনা শেষ করে গ্লাসটার দিকে তাকিয়ে বললাম, “Oh sweet lady, please do something so that my wife will get the job at BAPEX. I will be grateful to you.” (ঐ মুহূর্তে বোধহয় আমার সন্দেহ হচ্ছিল যে এই স্বর্ণকেশী বাংলা না ও বুঝতে পারে। বলা বাহুল্য আমার বউ তার ৩/৪ দিন আগে বাপেক্সের সহকারী প্রকৌশলী হিসেবে নিয়োগলাভের জন্য পরীক্ষা দিয়েছে।)।
যাহোক, এবার আবার জায়নামাজ দিয়ে হাত ঢেকে দেয়া, আবার ফাতিহা পাঠ শেষে উনি আমাকে জায়নামাজের নিচে হাত দিয়ে তার হাত থেকে গ্লাসটি নিতে বললেন। নিলাম। এবার উনি কিছু একটা দোয়া পড়ে ফু দিয়ে জায়নামাজটি উঠিয়ে নিলেন। আমি আবারও হতভম্ব। এবার আগের চেয়ে কিছুটা বেশি। আমার হাতের গ্লাসটির মুখে একটি প্রমাণ সাইজের আপেল। আপেলটি গরম লাগতে পারে বলে সতর্ক করে দিয়ে উনি আমাকে আপেলটি উঠাতে বললেন। তুললাম। গরম ঠান্ডা বুঝিনি। আপেলটি হাতে ধরে আছি আর ভাবছি এটা ইল্যুশন, একটু পরেই সব ভ্যানিশ হয়ে যাবে নিশ্চয়ই।(কেননা আমি পুরো প্রক্রিয়াটি গভীর মনোযোগ ও পযার্প্ত অবিশ্বাস নিয়ে লক্ষ করেছি)।
কিন্তু হলোনা। আপেলটি পরের দিন ফজরের নামাজের পরে কোন অংশ না ফেলে খেতে বলে আমাকে বিদায় দিলেন। আমি অনেক সন্দেহ নিয়ে সৈয়দপুর রওনা হলাম। একটু পর পর দেখছি আপেলটা আছে নাকি উবে গেছে। নাহ, বাসায় পৌছেও আপেলটি অক্ষত আছে দেখে এবার একটু চিন্তায় পড়লাম। অনেক দ্বিধা দ্বন্দ আর অবিশ্বাস নিয়ে খুব উত্তেজনায় কাটালাম রাতটি। সুবেহ সাদিকে নামাজ পড়ে আপেলটি খেলাম। এবং পুরো ব্যাপারটির মধ্যে কোথাও একটা ফাকি ঝুকি আছে কিন্তু আমি ধরতে পারিনি এই ভেবে ব্যাপারটা ভুলে যেতে চেষ্টা করলাম।
বেশ কদিন (প্রায় ১৫/১৬ দিন) পার হয়ে গেছে। আমি পুরো ব্যাপারটি মন থেকে মুছে দিয়ে নিত্য কাজকর্মে মন দিয়েছি। হঠাৎ করেই এক বিকেলে আমার ছোটবোনের হাজবেন্ড ফারুক মোবাইলে কল দিয়ে জানালো এসিআই -র একটা নতুন সেক্টর ওপেন হচ্ছে অটোমোবাইলে, ভাবী যেন ইন্টারভিউ দিতে যায়। কাজেই আবারও সেই সাইকেল পুরো করা। তবে এবার ব্যাপারটা একটু ভিন্নরকম হলো। ইন্টারভিউ শেষে উৎফুল্ল বউ আমাকে ফোন করে জানালো চাকরীটা মনে হচ্ছে হয়ে যাবে। কারণ হিসেবে ব্যাখ্যা করলো ইন্টারভিউ এ ওকে জিগ্যেস করেছে আমি কোথায় থাকি আর তারপরে রংপুর বা দিনাজপুরে পোষ্ট করলে কোন সমস্যা আছে কিনা। এবার আমিও একটু যেন আশার আলো দেখলাম। পরের সপ্তাহে যোগাযোগ করতে বলেছিল ওকে। মাঝে মাত্র কয়টা দিন, তাই বললাম থেকে যাও ঢাকাতেই। যাহোক নির্ধারিত দিনে যোগাযোগ করলে ওনারা জানান যে এই মুহূর্তে ওনাদের ঢাকাতেই লোক দরকার, এতে কোন আপত্তি আছে কিনা। আপত্তি করার বিন্দুমাত্র অবকাশ ছিলোনা। তাই পরের মাসের প্রথম দিন থেকেই ওকে জয়েন করতে বললেন ওনারা। হয়ে গেলো চাকরী। (চাকরীটা হয়েছে এটাই যথেষ্ট, আর আমি রিকোয়েষ্ট করেছিলাম বাপেক্সের জন্য, চাকরী হয়েছে এসিআই তে। কাজেই এর মধ্যে আমার একবারও মনে হয়নি যে ঐ জ্বীনঅলা ভদ্রলোকের কোন কেরামতি এখানে থাকতে পারে।) এদিকে সেই ভদ্রলোক কীভাবে যেন জেনে বসে আছেন আমার বউ এর চাকরী হয়েছে(!) )।
ব্যাপারগুলো দেখে অবাক হচ্ছি। কিন্তু কোন ব্যাখ্যা খুজে পাচ্ছিনা। তাই অস্থির লাগছে। কেউ কী বলতে পারেন এগুলো কীভাবে হলো? আগাম ধন্যবাদ জানিয়ে রাখছি।
(দু:খিত লেখাটা ছোট করতে পারিনি বলে। পুরো ব্যাপারটা বোঝাতে এ বর্ণনাটুকু আমার মনে হয়েছে জরুরী। কষ্ট করে পড়ার জন্য অনেক ধন্যবাদ।)