
তনয় ভয়েজার ২০০২০ নিয়ে বৃহস্পতি এক্সপেডিশনে এসেছিল। এক্সপেডিশন শেষে বৃহস্পতির অভিকর্ষজ বল ব্যবহার করে হাইপার ডাইভ দেয়ার সময় একটি ছোট এস্টোরয়েডের সাথে ধাক্কা খায়। এমন তো হবার কথা ছিল না। এই কোয়ান্টাম কম্পিউটিঙয়ের যুগে এটা অসম্ভব ঘটনা। ভয়েজারের চোখ বা নেভিগেসনাল সিস্টেমটাই শুধু অকেজো হয়ে গিয়েছে। তনয় পৃথিবীর সাথে যোগাযোগ করতে পারছে ঠিকই, কিন্তু, যে পথ ব্যবহার করে তাকে পৃথিবীতে ফিরে যেতে হবে, সেটা বের করতে পারছে না। ওর নভোজান ঠিক কোন পথে যাচ্ছে সে ঠিক বুঝতে পারছে না, তবে ধারনা করছে এস্টোরয়েডের সাথে সংঘর্ষের কারনে তার যতটুকু বিচ্যুতি ঘটেছে, তাতে সে সৌরজগতের বাইরের দিকেই যাচ্ছে। তার মানে নিশ্চিত মৃত্যু। এ ধরনের পরিস্থিতির জন্য তনয় মানসিক ভাবে একদমই প্রস্তুত ছিল না। যদিও নভোচারী হিসেবে গড়ে উঠার জন্য তাকে সব ধরনের পরিস্থিতির জন্যই প্রশিক্ষন দেয়া হয়েছে। কিন্তু, এই ধরনের দুর্ঘটনা খুবই অস্বাভাবিক। তনয়ের এখন ভয় পাওয়া উচিত, চিন্তিত হওয়া উচিত। কিন্তু, কেন যেন সে কিছু অনুভব করছে না। মনে হচ্ছে কটা দিন অবসর পাওয়া গেল। সে এখন চাইলেই হিসেব করে বের করে ফেলতে পারবে সে আর কতোদিন বেঁচে থাকতে পারবে। যদিও মৃত্যুর সংজ্ঞা পৃথিবীতে অন্যরকম। প্রতিটি নভোযানেই এখন ব্রেইন স্ক্যানিং করার ব্যবস্থা থাকে। মৃত্যুর আগে সে চাইলে তার ব্রেইন স্ক্যানিং করে পৃথিবীতে পাঠিয়ে দিতে পারে। তনয়ের যতো স্মৃতি, যতো অভিজ্ঞতা, ব্রেইন ম্যাপিং সবকিছু এই এক্সপিডিসনের আগে পৃথিবীতে স্ক্যানিং করে রেখে এসেছে। বলা যায় তনয়ের একটা কপি ওদের প্রতিষ্ঠানের কেন্দ্রীয় তথ্য ভান্ডারে আছে। তার মৃত্যুর পর কেউ যদি তার ব্যাপারে আগ্রহী হয়, তার সাথে কথা বলতে চায়, তবে এই কপির সাথে কথা বললে সেটা তনয়ের সাথে কথা বলার মতোই হবে; সে এক রকম অমর।
কিন্তু, এই সময়টা তনয় একান্তই নিজের করে পেতে চায়। সে চায় না, মৃত্যুর আগের এই কটা দিন সম্পর্কে কেউ কিছু জানুক। এক মগ ধোয়া উঠা কফি নিয়ে তার খুব জানালার পাশে বসতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু, এখন সেটা সম্ভব না। কারন, এখন সে আছে ভরহীন পরিবেশে। নভোযানের যতোটুকু শক্তি অবশিস্ট আছে, সেটা সে গ্র্যাভিটি তৈরি করার পেছনে খরচ করতে চায় না। তারচেয়ে, এ কটা দিন ভেসে বেড়াবে এই নভোজানের ভেতরে বাইরে। ভয়েজারের এই বড় জানালাটা তনয়ের খুব পছন্দ। এখানে থেকে যেদিকেই চোখ যায় শুধু আকাশ। এক অদ্ভুত অনুভূতি। ছোটবেলা থেকে কত রাত এই আকাশ দেখে কেটেছে, তার কোনো হিসেব নেই। এতো দেখার পরও এর রহস্যের যেন কোনো শেষ নেই, চির নতুন এই আকাশ। এক একটা তারা যেন এক একটা দ্বীপ।

যোগাযোগ মডিউল থেকে এক ঘেয়ে শব্দ ভেসে আসছে। নিশ্চয়ই নিয়ন্ত্রন কক্ষে হইচই পড়ে গেছে। যোগাযোগ মডিউলটা কিছুদিনের জন্য বন্ধ রাখতে হবে। না হলে এই শেষ কটা দিন এরা শান্তিতে থাকতে দেবে না। তনয় যোগাযোগ মডিউল বন্ধ করতে এসে দেখে এক অদ্ভুত মেসেজ এসেছে। কেউ কি ওর সাথে মজা করার চেষ্টা করছে? বিশ্বাস হচ্ছে না।
আমি RZO15. আমি এসেছি ১৩ কোটি আলোকবর্ষ দূরের নফোসিন নক্ষত্র থেকে। হ্যা, তুমি ঠিকই শুনেছ, আমি নক্ষত্র থেকেই এসেছি। তোমাদের মতো আমরা থ্রি ডাইমেনসনাল জগতে বাস করি না। আমাদের জগতে ছয়টা ডাইমেনসন। কিন্তু, প্রজাতি হিসেবে আমাদের বয়স তোমাদের প্রায় তিন গুন। তাই, আমাদের প্রযুক্তি আমাদেরকে তোমাদের মতো ভিন্ন মাত্রার জগতের বাসিন্দাদের সাথে যোগাযোগ করার ক্ষমতা দিয়েছে।
আর হ্যাঁ, তোমার নভোযানের এই ছোটখাট ক্ষতি করার জন্য আমরা দুঃখিত। আমাদের টেকনিশিয়ানরা কাজ করছে সেটা দ্রুত ঠিক করার জন্য।
তনয় বোঝার চেষ্টা করছে এই মেসেজের উৎস কোথায়। কিন্তু, মনে হচ্ছে কাছাকাছি কোথাও থেকেই আসছে। কিন্তু, আশে পাশে আর কিছুর অস্তিত্ব সে খুঁজে পাচ্ছে না। মনে হচ্ছে একদম শুন্য থেকে কেউ ওর সাথে যোগাযোগ করছে। মনে হচ্ছে কেউ কোনো ধরনের উৎকট রসিকতা করার চেষ্টা করছে, কিন্তু তনয় যদি চুপ থাকে, তাহলে সে বুঝতে পারবে না কি ঘটনা ঘটছে। তাই সে সিদ্ধান্ত নিল কিছুক্ষন কথা বলার।
১৩ কোটি আলোকবর্ষ থেকে কিভাবে আসা সম্ভব, তনয় জানতে চাইলো।
খুব সোজা, এটা তো তোমরা আরও দু’শ বছর আগেই জানো! শুধু জানো না কিভাবে করতে হয়। এতো বছর হয়ে গেলো, কৃত্রিম গ্র্যাভিটিও তোমরা এখন তৈরি করতে পারো, কিন্তু ওয়ার্মহোল বানানো এখনো শিখলে না! ওয়ার্মহোল দিয়ে আমরা খুব অল্প সময়েই এখানে চলে আসতে পারি।
তোমাদের রসিকতা হজম করার মতো মানসিকতা এই মুহূর্তে আমার একদম নেই। ওয়ার্মহোল তোমরা বানাতে পারো, কিন্তু আমার ভয়েজারের নেভিগেশন সিস্টেম ঠিক করতে তোমাদের এতো সময় লাগছে?
কিছুটা সময় লাগার জন্য আমরা দুঃখিত! কিন্তু একটু বোঝার চেষ্টা কর, তোমাকে যদি এখন বলি পাথর ঘষে আগুন জ্বালাও, পারবে তুমি দু’মিনিটে জ্বালাতে? আমাদের প্রযুক্তি গ্রহন করার মতো অবস্থা তোমাদের এখনও হয় নি। তাই আমরা এখন চেষ্টা করছি তোমাদের মতো করেই তোমার নভোজান ঠিক করতে। তাই, কিছুটা সময় লাগছে।
তাইতো! পাথর ঘষে আগুন জ্বালাতে গেলে তো ঘাম ছুটে যাবে। কিন্তু, কোনো এলিয়েন এসে কথা বলছে এটা বিশ্বাস করার কোনো কারন এখনো ঘটে নি। এস্টরয়েডের আঘাতে আরও কি কি নষ্ট হয়েছে কে জানে! আরও কিছুক্ষন কথা বলে দেখা যাক ঘটনা কি।
তোমরা কি এবারই প্রথম পৃথিবীর কাছাকাছি এসেছ?
না। তোমাদের পৃথিবী বলতে পারো আমাদের একটা পরীক্ষার ফল। কোটি কোটি বছর আগে আমাদের পূর্ব পুরুষরা ঠিক করেছিল চৈতন্য বা বুদ্ধিমত্তা মহাকাশের সব জায়গায় ছড়িয়ে দেবে। সেখান থেকেই ধীরে ধীরে পর্যায়ক্রমে আমরা মহাকাশের বিভিন্ন প্রান্তে প্রানের সূচনা করি। কোথাও সফল হই, কোথাও ব্যর্থ হই। কোথাও প্রান, বুদ্ধিমত্তা বিকশিত হবার পরেও ধ্বংস হয়ে গেছে। তোমাদের এই পৃথিবী আমাদের সফল পরীক্ষাগুলোর মধ্যে একটা। যদিও তোমাদের এই পৃথিবী বহুবার ধ্বংস হতে হতে বেঁচে গেছে।
সেটা কি রকম?
এই যেমন ধর, মানুষ যখন পারমানবিক বোমা বানানো শিখল, আমরা তো মনে করলাম পৃথিবীর আয়ুষ্কাল আর বড়জোড় ৫০ কি ১০০ বছর। তারপর, কতবার কতো এস্টরয়েডের গতিপথ আমরা পরিবর্তন করে দিয়েছি। তোমরা যে হারে পরিবেশ জলবায়ু দূষণ করে চলেছ, তোমাদের গ্রহের বুদ্ধিমান প্রানী মানে মানবজাতি ধ্বংস হয়ে যাবার এখনো যথেষ্ট সম্ভাবনা আছে, যদি না তোমরা তোমাদের প্রযুক্তি আরও উন্নত করে এটাকে তোমাদের বসবাস উপযোগী রাখতে পারো। যদিও পৃথিবীর বাইরে তোমাদের ছড়িয়ে পড়ার যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে। আমরা আশাও করছি তোমরা ছড়িয়ে পড়তে পারবে। যা হোক আমরা তোমার নেভিগেশন সিস্টেম মোটামুটি ঠিক করে ফেলেছি। তোমার ঘরে ফেরার ব্যবস্থা করছি।
আমাদের সাথে তোমার যোগাযোগের কথা কেউ জানবে না। আমরা সব প্রমান মুছে দেবো। এমনকি তোমার মস্তিষ্ক থেকেও আমাদের সাথে যোগাযোগের ব্যাপারটা আমরা ভুলিয়ে দেবো। কিন্তু, সত্যি কথা বলতে কি, কোনো তথ্য কখনও পুরোপুরি মোছা যায় না। তাই, আমাদের কথা তোমার হঠাৎ হঠাৎ মনে পড়বে! যদিও ব্যাপারটা তোমার মনে কাছে স্বপ্নের মতো মনে হবে, কিন্তু তুমি ঠিকই বুঝবে এটা স্বপ্ন ছিল না।
অ্যালার্মের কর্কশ শব্দে ধড়মড় করে জেগে উঠে তনয়। নেভিগেশন সিস্টেম থেকে অ্যালার্ম আসছে। হায় সর্বনাশ, নভোজান তো অন্যদিকে চলে যাচ্ছে! এটা তো অটো পাইলট মুডে থাকার কথা, এটাকে ম্যানুয়াল মুড থেকে অটোতে নেয়া হয়নি! এবার নিশ্চিত চাকরিটা যাবে স্টেশনে ফেরার পর। ঘুমটাই তনয়ের জীবনের সব যন্ত্রণার মূল। এই ঘুমটাকে একটু নিয়ন্ত্রন করতে পারলে আজকে তনয়ের একা একা এই দীর্ঘ বিরক্তিকর এক্সপেডিশনে যাওয়া লাগতো না। তনয়ই ঠিক করতো কে কোন এক্সপেডিশনে যাবে।
অবশ্য এক্সপেডিশনগুলো তনয়ের ভালই লাগে একদিক দিয়ে। এক্সপেডিশনে যাওয়া মানে বছর খানেক শীতনিদ্রায় যেতে পারা। প্রতিটা শীতনিদ্রার পর এত্তো সজীব লাগে, যা অন্যকোনোভাবেই পাওয়া সম্ভব না। বয়সটাও থেমে যায়। অনেক পরিশ্রম হয়েছে। এবার বিশ্রামের পালা। স্টেশনে পৌঁছতে বছর খানেক লেগে যাবে। শীতনিদ্রায় যেতে হবে। ভাবতেই তনয়ের চোখের পাতা আবার ভারী হয়ে এলো।
নভোযান এস্টরয়েড বেল্ট পার হচ্ছে খুব সাবধানে। কফিনের মতো শীতনিদ্রা যন্ত্রে শুয়ে শুয়ে নভোযানের ছোট্ট জানালা দিয়ে দূরে তনয় কিছু এবড়ো থেবড়ো এস্টরয়েড দেখতে পাচ্ছে। এস্টরয়েডগুলো চাঁদের মতো করে জোছনা তৈরি করছে। যদিও চাঁদের সৌন্দর্যের বা পৃথিবীতে তনয়ের দেখা জোছনার কাছে এটা কিছুই না। কিন্তু, এই নিঃসঙ্গ নিকশ কালো শীতল আঁধারে এইটুকু প্রাপ্তিই বা কম কি!

তনয়ের গান শুনতে শুনতে ঘুমানোর অভ্যাস। প্রতিবার শীতনিদ্রার আগে সে ভাবে গান শুনতে শুনতে শীতনিদ্রায় যাবে। কিন্তু, প্রতিবার শীতনিদ্রার প্রক্রিয়া শুরু হবার পর ওর এই কথা মনে হয় আর কেমন যেন একটা একাকীত্ব ওকে গ্রাস করে। এবার আর ভুল করেনি। দূর থেকে রবীন্দ্র সঙ্গীত ভেসে আসছে।
‘আজ জ্যোৎস্না রাতে সবাই গেছে বনে
বসন্তের এই মাতাল সমীরণে ।।
যাব না গো যাব না যে, রইনু পড়ে ঘরের মাঝে-
এই নিরালায় রব আপন কোণে।
যাব না এই মাতাল সমীরণে।।
আমার এ ঘর বহু জতন ক’রে
ধুতে হবে মুছতে হবে মোরে ।
আমারে যে জাগতে হবে, কি জানি সে আসবে কবে
যদি আমায় পড়ে তাহার মনে
বসন্তের এই মাতাল সমীরণে।।’
অপূর্ব এই গানটা শেষ পর্যন্ত শোনার জন্য তনয় অনেক কষ্ট করে জেগে থাকলো। তারপর ধীরে ধীরে গভীর ঘুমে ডুবে যেতে থাকলো, হঠাৎ তার মনে পড়লো সেই এলিয়েনদের কথা। ওটা কি আসলেই স্বপ্ন ছিল!! আরেকটা মিষ্টি গান ভেসে আসছে-
‘তুমি রবে নীরবে হৃদয়ে মম’
ঠোটের কোনে এক চিলতে হাসি নিয়ে তনয় গভীর ঘুমে তলিয়ে গেল!

সর্বশেষ এডিট : ০২ রা সেপ্টেম্বর, ২০১৬ সকাল ৮:১৮

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



