প্রতি রাতে বারান্দার রেলিং এর দাড়িয়ে আকাশ দেখার চেষ্টা করাটা আমার অভ্যেস হয়ে দাড়িয়েছে। ছোট্ট বারান্দাটা পুরোপুরিই নিজের করে নিয়েছি। ইনসমনিয়া পাকড়াও করলে রাতে বারান্দাই হয়ে দাড়ায় আমার খেলাঘর। ঠিক জোছনা বা অমাবশ্যা উপভোগ করতে বারান্দায় যাই তাও বলা যাবে না। বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকা ছাড়া কোন কিছুই আমি করি না। অন্তত অন্য কেউ দেখলে তাই বলবে। পুরো রাত চোখ খোলা মৃতের মতো দাঁড়িয়ে থাকি শুধু! এটা আমার খেলাঘর! খেলাঘরে এক ছায়ামুর্তির সাথে খেলাকরি আমি! আজও দাঁড়িয়ে আছি। অপেক্ষা করছি একটা ছায়ামুর্তির জন্যে। তাকে শুধু প্রথমে অনুভব করতে পারতাম! আমি তাকানো মাত্র গায়েব হয়ে যেত ছায়ামুর্তিটা। কিন্তু এখন তাকে নিয়ে তারা দেখি! কথা বলি তার সাথে! তাকে কফি বানিয়ে আনতে বলি!
প্রথম্যে খুব হাস্যকর লাগতো আমার কাছে। হ্যালুসিনেটিং অবস্থার একটা অংশকে সত্যি ভেবে বসেছিলাম! অদিতিকে বলেছিলাম পুরো ঘটনা। অদিতিকে আমি ডাকি কাজলকণ্যা। তার গায়ের রং কালো। আর তার চোখে সবসময় কাজল থাকে।
- কাজলকণ্যা জানো আমার রুমে এক পেত্নি থাকে।
- বলো কি? আর আমাকে কাজলকণ্যা না ডাকলে হয় না? আমি কালো সেটা বারবার মনে করিয়ে দিতে হবে?
- ওকে আর ডাকবো না কাজলকণ্যা। তবে পেত্নিটাকে কি করা যায় বলোতো? বিয়ে করে ফেলি তাকে? মানুষ আর পেত্নির বাচ্চাকে কি বলা যায় বলোতো?
সে এমন ভাবে তাকিয়েছিল যেন আমার মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছে। কাজলকণ্যা আমাকে ঠিক বুঝতে পারতো না। তখন সে অসহায় বোধ করতো দেখলেই মায়া হতো!
বাসায় এসে খুব হেসেছিলাম নিজের বোকামিতে। সেই রাতে খুব শান্তির ঘুম হয়েছিলো। পরদিন সন্ধ্যায় ঘরের ভিতর মনে হচ্ছিল কেউ বিষাদ গুলিয়ে মিশিয়ে দিয়েছে। ঘরের ভেতর কেমন বিষাদের একটা ছায়া ছিল। মনে হচ্ছিল পর্দার ওপাশে দাড়িয়ে আছে কোন একজন অভিমানী ছায়ামানবী। তাকে স্পর্ষ করা তো দুরের কথা তাকানো মাত্র উবে যাবে! জোর করে মাথা থেকে তার ভাবনা সরিয়ে রাখি। হাতের কাজ গুলো শেষ করতে হবে। প্রবন্ধ জমা দিতে হবে পরশুর মধ্যে।
কিছুক্ষণ পর অবাক হয়ে খেয়াল করলাম আমি লিখতে পারছি না। খাতার এককোণে কিছু লতাপাতা আঁকা শুধু। মাথা থেকে একটা শব্দ বেরুচ্ছে না। বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালাম। কতক্ষণ দাঁড়িয়েছি জানি না। অবাক হয়ে খেয়াল করলাম সেই ছায়ামানবীর জন্যে অপেক্ষা করছি আমি। কি হয়েছে আমার! বাকি রাতটা ঘর আর বারান্দা করে কাটিয়ে দিলাম। শুধু মনে হচ্ছে কোন এক ছায়ামানবীর অভিমান মিশ্রিত চাহনি আমাকে অনুসরণ করে বেড়াচ্ছে শুধু। সেই চাহনির সামনে আমি অসহায়!
সপ্তাহ খানিক লিখতে না পারার কষ্টে ভুগলাম! গভীর রাতে ছায়ামানবীর একটা স্কেচ বানানোর চেষ্টা করছিলাম। সেই সময় হঠাৎ মনে হলো ঘরের ভিতর কেউ পায়চারি করছে। মিষ্টি একটা সুবাস! স্কেচটা অসম্পুর্ণ রেখে আমি লেখার খাতা নিয়ে বসলাম আবারো। ঝর্ণাধারার মতো শব্দ আসছে মাথায়। ঘরে কোন একজন ছায়ামানবীর অস্তিত্ব অনুভব করছিলাম আর সাথে মিষ্টি একটা সুবাস! সেই থেকে শুরু ছায়ামানবী আর আমার অবগাহন! সেদিন মনে হচ্ছিল আমার কল্পনার দেবী সে! সে চলে গেলে আমার কল্পনাও বন্ধ হয়ে যাবে। যে কল্পনায় আমি বেঁচে থাকি!
আমি গভীর রাত পর্যন্ত লেখালেখি করি আর ছায়ামানবী আমার আশে পাশে ঘুর ঘুর করে। আমি শুধু অনুভব করি ফিরে তাকাই না। তাকালে সে লজ্জা পায়! তবে একদিন তাকিয়েছিলাম! ছায়ামানবী চলে যায় নি! কিছুটা দ্বিধান্বিত ছিল মনে হয়েছে! এরপর ছায়াটা কাছে এসেই মিলিয়ে গেল! উষ্ণ একটা সুগন্ধী স্পর্শ রেখে গেল সাথে!
আমি আজকাল কবিতাও লেখা শুরু করেছি। সবই ছায়ামানবীকে নিয়ে। জানি না আমার কি হয়েছে। ছায়ামানবীকে আমি শুধু একবার স্পর্ষ করতে চাই। সে আমার মনের কল্পনা আমার ভাবতে ইচ্ছা করে না। মনে হয় সে আছে। শুধু তাকে প্রবল ভাবে অনুভব করলেই সে কায়ামানবীতে রুপান্তর হবে।
তার কায়ামানবীতে রুপান্তরের ইতিহাসটা বলি। সেদিন আমি মনোযোগ দিয়ে লিখছি প্রতিদিনের মতোই। আর ছায়ামানবী হেটে বেড়াচ্ছে ঘরের ভিতর। আচমকা আমার পিঠে নরম কোমল একটা হাতের উষ্ণ স্পর্শ অনুভব করলাম। ভীষন ভাবে চমকে উঠেছিলাম! চিৎকার করে বলেছিলাম “ কে কে?”
অন্য ঘর থেকে মা ছুটে এলেন।
- কি হয়েছে?
- কে যেন আমার পিঠে হাত রাখলো মনে হলো!
- কে কেউ তো নেই! রাতজেগে লেখালেখি করলে তো এমনই হবে! ঘুমিয়ে পড়!
আমি ছায়ামানবীর একচিলতে মুখটা দেখতে পাচ্ছিলাম না তবে মনে হয়েছিল সে খুব কষ্ট পেয়েছে! আর অপমানিত হয়েছে আমি তাকে বিশ্বাস করতে পারছি না দেখে। মনে হচ্ছিল সে কেঁদে দিবে। মুখে যেন আচঁল চাপা দিয়ে সে দৌড়ে কোথায় চলে গেল! সাথে আমার কল্পনার জগৎটাকে ও আঁচলে বেঁধৈ নিয়ে গেল!
আমি কিছুই লিখতে পারছিলাম না। লিখতে না পারার প্রবল অস্বস্তি আর আর মানসিক যন্ত্রনায় আমি নীল হয়ে যাচ্ছিলাম! আর আমার কাজলকণ্যার সাথে খারাপ ব্যাবহারের সীমারেখা অতিক্রম করছিলাম!
- কি হয়েছে তুমি ফোন ধরো না কেন?
- ইচ্ছা করে না তাই ধরি না। শুধু শুধু ফোন দিয়ে জ্বালাবে না!
- তুমি এমন ভাবে কথা বলছো কেন?
- আমি এমনই! থাকলে থাকো নাইলে ফুটো! ব্রথেলে যাও!
- এসব কি বলছো?
- ক্যান শুনছো না কি বলছি? খাঁটি বাংলায় বলছি!
- আমি কোনদিন তোমাকে ফোন দিবো না।
- তোকে দিতে কে বলেছে?
অদিতি ফোন রেখে দিবার আগেই আমি ফোনটা আছাড় দিয়ে ভেঙ্গে ফেলি। শুধু মনে হতে থাকে নিজেকে যত কষ্ট দিবো অভিমানী ছায়ামানবী তত দ্রুত ফিরে আসবে। আমার কল্পনার দেবী।
আরেকবার মনে হলো ধুর! আমার ডাক্তারের কাছে যাওয়া উচিৎ! গিয়েছিলামও! সাথে অদিতি ছিলো। ডাক্তার এক প্রশ্ন ডজনখানেক বার করে আমার ধৈর্য পরীক্ষা নিলো। যেই পরীক্ষায় আমি ফেল করলাম।
- তাহলে আপনি বলছেন আপনি আপনার রুমে কোন মেয়েকে দেখতে পান?
- না তা বলিনি।
- তাহলে?
- কয়বার জিগাবেন? একবারে কানে যায় না? কানে শুনিস না ডাক্তারি করতে আসছিস? তুই কানের ডাক্তারের কাছে যা! থাব্রায়ে কান লাল করে দিবো হারামজাদা!
অদিতি বহুকষ্টে আমাকে নিয়ে এলো সেখান থেকে। আমার মায়ের সাথে অদিতির ভালো রকম চেনাজানা হতে শুরু করলো।
- বুচ্ছো মা ওর বাপের দিকে পাগলের ছিট আছে। ওর বড়দাদা ছিল পাগল। ঘরে নেংটা মাইয়া মানুষ দেখতো। বটি নিয়া নাকি দাড়ায়া আছে। তাবিজ ছাড়া গতি নাই ওগো।
বড়দাদা নেংটা মেয়ে মানুষ দেখতো আর আমি দেখি ছায়ামানবী। মায়ের বাঁধা হাফ ডজন তাবিজ আমার গলায় হাতে ঝুলিয়ে ঘরে শুয়ে থাকি। অসহায় লাগতো নিজেকে। একরাতে বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিলাম! ছায়ামানবীর উপর ভীষন অভিমান হচ্ছিল। কান্না পাচ্ছিল। আমার কল্পনার জগৎটকে সে সাথে করে নিয়ে গেছে। এমন সময় কাঁধে আলতো কোন স্পর্ষ অনুভব করলাম। আমার কল্পনার দেবী মাসখানিক আমাকে কষ্ট দিয়ে ফিরে এলো! ছায়ামানবী রূপে না কায়ামানবী রূপে। আমি মুগ্ধ হয়ে দেখি আমার কল্পনার দেবীকে। কিছুটা অদিতির মতো দেখতে সে। আবার রুপার মতো গালে টোল পড়ে তার! চুল গুলো এলোমেলো ঢেউ খেলা কোকড়ানো। অবিন্যাস্ততার মাঝেও বিন্যাস্ততার ছায়া আছে। নীলার কথা মনে পড়ে যায় আমার! কিন্তু চোখ দুটি সম্পুর্ণ আমার কল্পনার মতো! কাজল টানা নয় শুধু মায়া দিয়ে ভর্তি।
কণ্ঠে হাহাকার ঝড়িয়ে আমি বললাম!
- তুমি কোথায় গিয়েছিলে?
- কোথাও না আমি এখানেই থাকি এখানেই ছিলাম। তুমি দেখতে পাওনি।
- তোমার নাম কি?
- নাম? আমার নাম কি? আসলেই তো! আমার নাম নেই।
- তোমার নাম ছায়ালীনা।
- ছায়ালীনা! আমার নাম ছায়ালীনা!
আমি শুয়ে চোখ বন্ধ করলাম! কপালে ছায়ালীনার উষ্ণ হাতের স্পর্ষ অনুভব করতে লাগলাম! সে ফিস ফিস করে আমার কানে কানে বললো “অদিতিকে তুমি খুব ভালোবাসো তাই না?” কণ্ঠে প্রকাশ পাওয়া দুঃখ টুকু আমাকে ছুয়ে গেল। আমি মৃদু হেসে বললাম “ছায়ালীনা তুমি কাল থেকে কাজল দিবে চোখে। অদিতি কাজল ছাড়া বাঁচে না।” ছায়ালীনা গালে টোল ফেলে হাসলো।
কাজলকণ্যাকে অনেক দিন কিছু দিই না। তাকে কাজল কিনে দিবো। কাজল পেলে মেয়েটা যে কি খুশি হয়! নানা দোকান ঘুরে সবচেয়ে ভালো কাজলটা কিনলাম। এসব ব্যাপারে আমার অভিজ্ঞতা শুণ্যের কাছে। তবে বিষ কেনায় আমার অভিজ্ঞতা পুরোনো। কাজল আর বিষ একসাথে কিনলাম! এক পকেটে কাজল আর এক পকেটে বিষ! কাজলকন্যা ভিড়মি খাবে। ওর ভিড়মি খেয়ে অসহায় হয়ে যাওয়া মুখটা দেখি না অনেক দিন। সেই মুখটা দেখলেই মনে হয় ওকে জড়িয়ে ধরি।
চোখে কাজল দেয়ারও কত ভঙ্গি আছে কাজলকণ্যার কাজল না দেয়া দেখলে বুঝতে পারতাম না। কাজল দেয়ার পর তাকে মনে হচ্ছিল রুপকথার দেশের রাজকণ্যা। আলতো করে জড়িয়ে ধরে ধরে ওষ্ঠ স্পর্শ করলাম তার! ওর সবটুকু বেদনা আমি নিযে নেবো আজকে। মনে মনে বললাম “খুব কষ্ট হবে না কাজলকণ্যা! শুধু বাসায় গিয়ে ঘুমিয়ে পড়বে তুমি। তোমার একটুখানিও কষ্ট হবে না। শুধু ঘুম ঘুম লাগবে আর কিছু না। অধরের সবটুকু রস আগে আমাকে দিয়ে যাও! ঘুমিয়ে পড়ার আগে!”
কাজলকণ্যা বাসায় চলে গেল। ঘুমিয়ে পড়বে সে আমি জানি। ঘন্টা পাঁচেক লাগবে তার চিরতরে ঘুমাতে। কাঁজলে মিশিয়ে দেয়া বিষটা দেরীতে কিন্তু কার্যকর কোন সন্দেহ নেই। অভিজ্ঞতা আমার তাই বলে।
গভীর রাতে বাসায় ফিরে গিয়ে দেখলাম ছায়ালীনার চোখে কাজল। তার চোখ দুটো অবিকল কাজলকণ্যার মতোই। ফিস ফিস করে বললাম ঘুমাও কাজলকণ্যা তুমিও এখন আমার কল্পনার অংশ! তোমাকে নিয়ে যেভাবে ইচ্ছা আমি খেলবো!
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে জুলাই, ২০১৩ বিকাল ৫:৫৮