শেষ বিকালের আলো নিয়ে মানুষের যত আহ্লাদ! দেখলেই মুনিরের রাগ উঠে। শেষ বিকালের চিড়বিড়ে রোদটা তার অসহ্য লাগে। রোদ তো রোদই এটা নিয়ে আবার এত আহ্লাদের কি আছে? এই রোদের আবার একটা গালভরা নাম আছে। কন্যাসুন্দরী আলো। আরে রোদের নাম আলো হবে কেন? অবশ্য এই বিরক্তির মুল কারন এই রোদে প্রতিদিন তাকে টিউশনি শেষ করে হেটে মেসে ফিরতে হয়। রিকশা নিয়ে ফেরা যায়। কিন্তু হাটলে স্বাস্থ্য ভালো থাকে। তার স্বাস্থ্য ভালো না। হেটে স্বাস্থ্য ভালো রাখা তার জন্য অত্যন্ত জরুরী। অবশ্য রিকশা ভাড়াও বেঁচে যায়। আজকাল রিকশার ভাড়াও হু হু করে বাড়ছে। দশ টাকার ভাড়া পচিশ টাকা চায়। তবে সে প্রতিদিনই রিকশা দামাদামি করে। শেষ পর্যন্ত অবশ্য হেটেই ফিরে।
- এই খালি যাবা?
- জ্বি যাবো।
রিকশাওয়ালা হাই তুলতে তুলতে বলে।
- ধুর মিয়া কৈ যাবো না জিগায়াই বলো যে যাবা!
উত্তরে রিকশাওয়ালা লোকটা কিছু না বলে প্যাডেল মারতে মারতে চলে যায়। প্যাসেঞ্জার যাবে কি যাবে না এটা সে চেহারা দেখলেই বলতে পারে।
মুনির রিকশাওয়ালার ঔদ্ধ্যত্বে খানিকটা অবাক হওয়ার ভান করে। এরপর হাঁটা শুরু করে। কিন্তু আজকে যেহেতু তিনটা টিউশনির টাকা একসাথে পেয়েছে সে রিকশায় যেতেই পারে। এছাড়াও সারাদিন অভুক্ত সে। দুটো মেয়ে আর একটা ছেলেকে দুপুর দুটা থেকে পালাক্রমে পড়ায় সে।
মেয়েগুলোর মধ্যে প্রথমটা অতি ভদ্র। তবে মাথায় গোবরও আছে কিনা তার সন্দেহ। প্রতিদিন সেজেগুজে পড়তে বসে। বাড়ির কাজ কখনো করে না। মুনির বাড়ির পড়া জিজ্ঞাসা করা মাত্র বলে পড়া হয়নি। এরপর গুনগুন করে পড়তে থাকে। একটানা গুনগুন শব্দে মুনিরের ঘুম পেয়ে যায়। শেষ মুহুর্তে বিস্বাদ চা খেয়ে পড়া বুঝিয়ে দিয়ে চলে আসে। মাথায় কিছু না থাকায় তার সুবিধে অবশ্য। এই মেয়েকে নিয়ে তার বাবা মায়ের কোন টেনশান আছে বলে মনে হয় না। মেয়েটার বার্ষিক পরীক্ষার আগে এই টিউশনিটা ছেড়ে দিবে সে।
এরপর ছেলেটাকে পড়াতে যেতে হয়। ক্লাশের ফার্স্ট বয়। এই টাইপ ছেলে গুলো ভ্যাবলা হয়। বইয়ে মাথা গুজে পড়া না শেখা পর্যন্ত পেট ফুলে হিসু এলেও উঠবে না। পড়া পারে নি কখনও এমন হয় না। এই ছেলেটার সামনে সবসময় এটেনশান ভঙ্গিতে বসে থাকতে হয়।
পরের মেয়েটার মতো বু্দ্ধিমতী মেয়ে সে খুব কম দেখেছে। মুনির খেয়াল করেছে কোন অপ্রস্তুত ভাবনা ভাবলেই মেয়েটা তার চোখের দিকে তাকিয়ে ফিক করে হেসে দেয়। শুধু পড়ালেখায় অনিহা। এই টিউশনিটা ছেড়ে দেবার কথা মাঝে মধ্যে মাথায় আসে। কিন্তু পর মুহুর্তেই ছেড়ে ফেলে। বাকি দুটো টিউশনির সমান টাকা এখান থেকেই পায় সে।
পকেট ভর্তি করে রাস্তায় বেরিয়ে ভালই লাগে তার। ইচ্ছা হলেই যে কোন কিছু কিনে ফেলতে পারবে এমন ভাবতে ভালই লাগে। যদিও কখনোই কিছু কিনে উঠতে পারে না। ইদানিং এখানে সেখানে মেয়েদের কসমেটিকস এর দোকান গজিয়ে উঠছে। মেসে ফেরার পথে এমন একটা দোকান সে প্রায়ই দেখে। মাঝারি একটা সাইনবোর্ডে লিখা “লেইস ফিতা” অবশ্য ভিতরে হুলুস্থুল অবস্থা। বিভিন্ন বয়েসী মেয়েদের ভিড় লেগেই থাকে। মুখে একটা তাচ্ছিল্যের হাসি ফুটিয়ে সে লেইসফিতায় প্রবেশ করে।
কি নেই দোকানটায়। নানা জাতের মেকাপ সামগ্রী, রং চং থেকে শুরু করে টেডি বিয়ার এমনকি মেয়েদের অন্তর্বাস, স্যানিটারি ন্যাপকিন পর্যন্ত আছে। কমবয়েসী মেয়েদের হয়তো লজ্জা শরম কম। সবার সামনে সাইজ মিলিয়ে দামাদামি করে অন্তর্বাস কিনছে। স্যানিটারি ন্যাপকিন কিনছে। সে হা হয়ে দেখে কিছুক্ষণ।
দোকানের পিচ্চি একটা ছেলে দাত বের করে হাসি ফুটিয়ে তাকে জিজ্ঞাসা করে
- কিছু লাগবো মামা?
- হুম লাগবে।
- কি লাগবে বলেন।
- ওই যে মেয়েরা যে রং দিয়ে ঠোট ঘষাঘষি করে। লিপ্সটিক ওগুলো কিনতে এসেছি।
- কি কালার নিবেন কন। সব কালার আছে।
- টিয়া কালার দে। নাইলে হলুদ। সবুজও দেখ আছে কিনা।
- টিয়া হৈলদা কালার নাইগো ভাইজান।
- তাইলে আর কি করা লাল রং দে। একদম টকটকে লাল। ভালো ব্র্যান্ড দেখে।
দোকানের বাচ্চাছেলেটা তার হালকা হিউমার বুঝতে পারে। আর সোৎসাহে বিভিন্ন ব্র্যান্ডের নামসহ লিপ্সটিকের গুণাগণ বর্ণনা করে। শেষমেষ চেরিব্লসম নামক একটা লাল লিপ্সটিক কিনে সে বের হয়। অনেকগুলো টাকা খরচ করে ফেলেছে। এই মাসটা একটু টানাটানি যাবে এই যা। তার খুব ইচ্ছা করছে লিপ্সটিকটা একটু শুঁকে দেখতে। তবে তার সংকোচ লাগছে। কারণ এই ইচ্ছাটার পিছনের কারণটা একটু অশ্লীল। তার মনে হতে থাকে লিপ্সটিকটার গন্ধটা কোন মেয়ের ঠোটের গন্ধের মতো হতে পারে। মেয়েদের ঠোটের গন্ধ কেমন হয় কে জানে।
এই একটা দিন তার বিকালের রোদে পার্কে বসে ঝালমুড়ি খেতে ভালো লাগে। সন্ধ্যা পার করে সে বাসায় যায়। মেস পার্কের কাছেই। আজ রুমমেট দুজনের কেউ নেই। ওরা বাসায় গেছে। চাবি তার কাছে। আজ অবশ্যি লেইস ফিতায় গিয়ে দেরী করে ফেলেছে সে। ঝালমুড়ি ওয়ালা চলে গেছে। আর সন্ধ্যাও হয়ে গেছে প্রায়। তবে ক্ষুধা আর লাগছে না এখন। সে আয়েশ করে বেঞ্চিতে বসলো। জিরিয়ে নেয়া যাক! জুতার দিকে তাকিয়ে মায়া লাগলো। নাহ! এবার ফেলে দিতেই হবে এগুলোকে। কম অত্যাচার যায়নি এদের উপর। ফেলে দিতেও মায়া হয়। পুরোনো জিনিশের উপর তার যত মায়া। মালার কথা মনে পড়ে যায়। এখনো মনকে সান্তনা দেয় সে যে মালা ফিরে আসবে একদিন। কিন্তু মালা তিন সন্তানের জননী সে জানে। তবুও এই দিনটায় ছেলেমানুষী ভাবনা ভাবতে ভালো লাগে। মালার কথা ভেবে ধীরে ধীরে বিষাদ জমে ভিতরে। ভাবনা গুলোর ডালপালা ক্রমেই বিস্তার পেতে থাকে। আগামীকাল একটা চাকরির ইন্টারভিউ আছে। কত যে ইন্টারভিউ দিলো এই জীবনে ইয়ত্তা নেই। প্রতিবারই ফলাফল শুন্য। তবুও আগামীকালেরটা দিতে বাধা কি। ভাবতে ভাবতে কখন যে ঘুমিয়ে যায় টেরই পায় না সে। ঘুমের মধ্যে স্বপ্নে একটা অল্পবয়েসী মেয়ে আসে। দেখতে মালার মতো। বড় বড় চোখ তার। ঠোটে চেরিব্লসম ব্র্যান্ডের টকটকে লাল লিপ্সটিক। সমস্যা হলো তার গায়ে কোন কাপড় নেই। একটু অস্বস্তিতে পড়ে যায় সে। স্বপ্নেই মেয়েটার নাম দিলো সে নগ্নিকা।
খিলখিল শব্দে ঘুম ভেঙ্গে যায় তার। প্রথমেই তার হাত চলে যায় পকেটে। হাফ ছেড়ে বাঁচে সে! না মানিব্যাগটা চুরি হয়নি। আবারো খিলখিল শব্দ। জারুল গাছটার পাশ থেকে আসছে। ঘড়িতে দেখে সাড়ে এগারোটা বাজে। এতক্ষণ ঘুমিয়েছে সে! হুড়মুড় করে বসা থেকে উঠে দাঁড়ায় সে। বাসায় যাওয়া প্রয়োজন। কিন্তু খিলখিল শব্দটা তার মাথায় বাজছে। জারুল গাছটার দিকে এগিয়ে যায় সে। দুটো অল্পবয়েসী স্কুল ড্রেস পড়া মেয়ে এতরাতে ওখানে কেন খিলখিল করে হাসছে ভাবতেই পারছে না সে। অবাক হয় সে। পরী টরী না তো? পরী হলো জ্বীনের স্ত্রীলিঙ্গ। তাই তারা সবসময় ছেলেদের ভর করে। আর জ্বীন ভর করে সুন্দরী মেয়েদের। তার দাদাকে বুড়ো বয়সে পরী ভর করেছিল। বুড়ো খিকখিক করে হাসতো আর বলতো “ঘরের মইধ্যে নেংটা পরী!” এরপর সেই পরীর পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা দিতেন। শ্রোতার অভাব হতো না। অবশ্য আজকাল মুঠোফোন নামক যন্ত্রের কল্যাণে ওই রকম পরী দেখা কঠিন কিছু না। তবে এখন তার ভয় লাগছে কেন জানি। মনে হচ্ছে পরী আসলেই আছে। দুরুদ পড়ে বুকে ফুঁ দেয় সে। ভয় কেটে যায় তার। এখন মনে হচ্ছে মেয়ে দুটোর ওখানেই খিলখিল করে হাসা দরকার। অন্য কোথাও মানাবে না। মুগ্ধ হয়ে শোনে খিলখিল শব্দ। তার ক্ষ্ণীণ সন্দেহ হলো দুরুদ পড়ার সময় হয়তো ভুল করেছে সে। কারণ আজেবাজে চিন্তা আসছে মাথায়। ভয় কেটে গিয়ে আধো আধো আলোছায়াময় পার্কটা হঠাৎ নেশার মতো আকর্ষিত করে তাকে। সম্বিত ফিরে পেয়ে নিজেকে নিজেই বলে সারাদিন দৌড়াদৌড়ির পর ক্লান্তি কারণে এমন হচ্ছে বাসায় যাওয়া দরকার! বাসার দিকে রোবটের মতো হাটতে থাকে সে। মাথাটা ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। পেটে ক্ষুধা।
পার্কের পাশেই স্টেডিয়াম। ওখানে নিশিকণ্যাদের মেলা বসে বলে সে শুনেছে। কোনদিন দেখা হয়নি। বাসার পথে পা বাড়িয়েও সে নিজেকে ওই মাঠে আবিষ্কার করে যেন কিছুটা খুশিই হলো। অন্য সময় হলে তার একটু লজ্জা লজ্জা লাগতো। কিন্তু এখন কেন জানি সব অনুভুতি ভোতা হযে আছে। স্টেডিয়ামটার কয়েকটা কোণে লাইট জ্বলছে। সে স্টেডিয়ামের গলিঘুঁচি খুঁজতে থাকে। কিছুটা এডভেঞ্চার মনে হলো তার। তবে সেটার প্রয়োজন ছিল না।
মাঠের মধ্যেই বিভিন্ন বয়েসী পাঁচ ছয়টা মেয়ে। সে তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে তাদের দিকে তাকায়। আপাদমস্তক তাকিয়ে দেখে। প্রচুর পাওডার দেয়া এবং টকটকে লাল রংদেয়া ঠোটের মেয়েগুলোর হাড্ডিসার দেহে কিছু আছে বলে মনে হলো না তার। প্রতিটাই শুকনো পাটকাঠি। তবে একটা মেয়েকে দেখলো কমলা বা হলুদের কাছাকাছি কোন একটা রঙ্গের কামিজ পড়ে আছে। ফিনফিনে ওড়নাটা গলায় ঝুলিয়ে রেখেছে। অকারণে হাসছে একটু পরপর। অবশ্য চেহারার ছিরি নেই কোন। মেয়েটার দিকে এগুতে গিয়েও থেমে যায়। পরক্ষণেই নিজেকে ধিক্কার দেয় সে। এসব কি করতে যাচ্ছে সে। সে কিন্তু ভেতরের একটা ক্ষুধার্ত স্বত্ত্বা তাকে সামনে এগুতে বলছে।
সে পিছায় শেষ পর্যন্ত। প্রচন্ড পানির পিপাসা পেয়েছে। আবার পার্কটাতে গিয়ে বসতে ইচ্ছা হচ্ছে। তার আগে পানির পিপাসা মেটানো দরকার। আবার মেসেও যেতে ইচ্ছা করছে না। খানিক আগে ঘটে যাওয়া মুহুর্ত গুলো মাথায় ঘুরছে। ওই মেয়েটার সাথে মালার চেহারার কোন মিল নেই। আবার মালার কথা মনে পড়ায় বিষাদ স্পর্ষ করলো তাকে। জারুল গাছটার আড়ালে স্কুল ড্রেস পড়া মেয়েগুলো আছে কিনা এখনো দেখতে ইচ্ছা করছে। যদিও খিলখিল শব্দ আর শোনা যাচ্ছে না। ক্লান্ত লাগতে থাকে তার। ধীরে ধীরে পেটের প্রচন্ড খুধা অস্তিত্ব জানান দিতে থাকে। ঠিক একটা স্বত্বার মতো।
বাস স্ট্যান্ডের কাছে “আল মদিনা ভাতের হোটেল” হয়তো এখন খোলা। বাস স্ট্যান্ডের দিকে হাটা দেয় সে। সবচেয়ে সস্তায় ওখানেই রাতের খাবার সে প্রায়ই খায়। এবং শুধু মাত্র রাতেই এই হোটেল খোলা থাকে। হাটতে থাকে সে। মালার হাতের রান্না কেমন কে জানে। মালার কথা মনে হতেই বিরক্তি লাগলো তার। আর স্টেডিয়ামের মেয়েটার দিকে সে কিভাবে তাকালো ভেবে পায় না। পকেটে থাকা চেরিব্লসম নামের লিপ্সটিকটা আগামীকাল ইন্টারভিউ দিয়ে আসার পথে ফেরত দিতে হবে। এত টাকা গচ্ছা দিলো কেন ভেবেই পাচ্ছে না সে। ফেরত না নিলে রুমমেটের কাছে বিক্রি করে দিবে। তার গার্লফ্রেন্ড আছে। এখন তার সামনে ভাসছে ধোয়া ওঠা গরম ভাত, একবাটি ডাল আর একটু খানি মাছের তরকারি। একটু নুন দুটো কাঁচামরিচ। মাত্র তিরিশ টাকার মিল।
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৪ রাত ৮:১৫