জাবিতে ছাত্রলীগে সংঘর্ষ কি অশুভ মহলের পরিকল্পিত ব্লুপ্রিন্ট?
জনকণ্ঠ রিপোর্ট ॥ নিছকই আধিপত্য বিস্তার, নাকি কোন অশুভ মহলের পরিকল্পিত ব্লুপ্রিন্টের ফসল জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের দু'গ্রুপের সশস্ত্র সংঘর্ষ_ এ নিয়ে জনমনে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। যুদ্ধাপরাধী ইসু্যতে যখন রাজপথ উত্তপ্ত, জামায়াতের বাঘা বাঘা নেতা জেলে, দেশের বিভিন্ন স্থানে চলছে জামায়াত-শিবিরের চোরাগোপ্তা হামলা। সরকারও যখন হার্ডলাইনে থেকে সবকিছু সামাল দিচ্ছে, ঠিক তখনই জনগণের দৃষ্টি ভিন্নখাতে প্রবাহিত করতে ছাত্রলীগে অনুপ্রবেশকারী ছদ্মবেশী চরদের দিয়েই এ ঘটনা ঘটানো হয়েছে কি-না, সরকারের হাইকমান্ড থেকে তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। বিভিন্ন ইসু্যতে সরকার ও বিরোধী দল এখন মুখোমুখি অবস্থানে। বিরোধী দলের আন্দোলন ও যুদ্ধাপরাধ ইসু্যতে রাজনৈতিক পরিস্থিতি উত্তপ্ত। বিশেষ করে বিভিন্ন নাশকতার আশঙ্কা সত্ত্বেও সরকার শক্ত অবস্থানে থেকে গ্রেফতার করেছে জামায়াতের তিন শীর্ষ নেতা মতিউর রহমান নিজামী, আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ ও দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে। হরতালের নামে নিরীহ মানুষের গায়ে আগুন ধরিয়ে দিয়ে হত্যাসহ ধ্বংসাত্মক কর্মকা-ের সঙ্গে জড়িত বিএনপির মির্জা আব্বাসসহ অনেক নেতাও এখন গ্রেফতার হয়ে কারাগারে।
সরকারের এমন শক্ত অবস্থানে দেশের মানুষের মনে বিশ্বাস জন্মেছে এবার আর যুদ্ধাপরাধীরা রেহাই পাচ্ছে না। সারাদেশেই যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবি প্রবল হচ্ছে। ঠিক তখনই সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে আবারও 'ছাত্রলীগ' নামক ট্রামকার্ড ব্যবহার নিয়ে রাজনৈতিক মহলে সন্দেহের তীর ক্রমশ প্রবল হচ্ছে। প্রশ্ন উঠেছে, প্রকাশ্য দিবালোকে সশস্ত্র মহড়া ও গুলিবর্ষণের ঘটনার সঙ্গে জড়িত যুবকরা সত্যিই কী ছাত্রলীগের আদর্শিক কমর্ী, নাকি অনুপ্রবেশকারী জামায়াত-শিবিরের অনুচর? এ নিয়ে আলোচনা-সমালোচনার ঝড় উঠেছে। ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের দ্রম্নত শনাক্ত করে গ্রেফতারের নির্দেশ দিয়েছেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
এ বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এ্যাডভোকেট সাহারা খাতুন মঙ্গলবার সাংবাদিকদের বলেন, অনেকে বলছে ছাত্রলীগে শিবির ঢুকেছে। শিবির থাক আর যেই থাক ছাত্রলীগের নামে কেউ কিছু করলে ছাড় দেয়া হবে না। তাদের গ্রেফতারে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী নির্দেশ দিয়েছেন। হঠাৎ করেই কেন এ ঘটনা ঘটল এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, যে কোন ঘটনা তো ঘটতেই পারে। এতে কি করার আছে। পুলিশ আসতে তো সময় লাগে। পুলিশ এসে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এনেছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ছাত্রলীগের একাধিক কেন্দ্রীয় নেতারও অভিযোগ, ছাত্রলীগে অনুপ্রবেশকারী শিবির ও হিযবুত তাহরীরের চররাই সরকারকে একের পর এক বেকায়দায় ফেলছে। ছাত্রলীগের অভ্যনত্মরে এখন তাদের শক্তিশালী অবস্থান। পরিকল্পিত উপায়ে অভ্যনত্মরীণ কোন্দল সৃষ্টি করে ৰণে ৰণে শিৰাঙ্গনকে উত্তপ্ত করা, সশস্ত্র মহড়া, সংঘর্ষ, এমনকি সাধারণ ছাত্রের প্রাণহানির ঘটনাসহ সবকিছুই শিবির ও হিযবুত তাহরির অনুচরদের বস্নুপ্রিন্টেই হচ্ছে। সরকারের বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনেও এসব অনুপ্রবেশকারীর বিষয়টি ষ্পষ্ট হলেও কার্যকর কোন পদৰেপ চোখে পড়েনি। আর এ সুযোগ নিয়েই জনগণের দৃষ্টি ভিন্নখাতে প্রবাহিত করতে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে সংঘটিত সংঘর্ষ ঘটেছে বলেই তাঁদের ধারণা।
ছাত্রলীগে ছাত্রশিবির কিংবা ছাত্রদলের অনুপ্রবেশের অভিযোগ নতুন কিছু নয়। ইতোপূর্বে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও এলজিআরডি মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম সাংবাদিক সম্মেলন করে এ অভিযোগ তুলেছিলেন। তাঁর অভিযোগ ছিল, ছাত্রলীগের ভেতরে চিহ্নিত শিবির ক্যাডাররা ঢুকে পড়েছে। পরিকল্পিতভাবে সন্ত্রাস সৃষ্টির জন্যই তারা ছাত্রলীগে অনুপ্রবেশ করেছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের অনেক নেতার বিরম্নদ্ধেই অনুপ্রবেশের অভিযোগ রয়েছে। ৰমতার পালাবদলের পর ছাত্রশিবির, ছাত্রদল ও হিযবুত তাহরীরের অনেক ক্যাডার রাতারাতি ভোল পাল্টিয়ে ছাত্রলীগে নাম লিখিয়েছে। অনুপ্রবেশকারী অনেকের বিরম্নদ্ধে অর্থের মাধ্যমে কমিটির বড় বড় পদ দখলের অভিযোগও বিশ্ববিদ্যালয়টির সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের মুখে মুখে। গত দেড় বছরে একাধিকবার এসব অনুপ্রবেশকারী পরিকল্পিত সংঘর্ষ ও সশস্ত্র মহড়া চালিয়ে খবরের শিরোনাম হয়ে সরকারের ভাবমূর্তি ৰুণ্ন করেছে।
সংশিস্নষ্টদের মতে, যুদ্ধাপরাধীদের ইসু্যতে তিন শীর্ষ জামায়াত নেতা গ্রেফতারের পর মরিয়া হয়ে উঠেছে স্বাধীনতাবিরোধী এই রাজনৈতিক দলটি। যে কোন মূল্যে দলের অসত্মিত্ব রৰা, শীর্ষ নেতাদের বাঁচানো এবং দেশকে অস্থিতিশীল করে সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে দেশে-বিদেশে কোটি কোটি টাকা ঢালছে জামায়াত। ঢাকাসহ সারাদেশে চোরাগোপ্তা হামলায় নামিয়েছে ছাত্রশিবিরকে। বিভিন্ন জঙ্গী সংগঠনকেও অর্থ দিয়ে চাঙ্গা করছে তারা। এরই ধারাবাহিকতায় বিপুল অর্থের মাধ্যমে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের ব্যানারে ছদ্মবেশে থাকা শিবির ক্যাডারদের দিয়ে এই হামলা-সংঘর্ষের ঘটনা সংঘটিত করার আশঙ্কা উড়িয়ে দেয়া যায় না।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক ছাত্রলীগ নেতার অভিযোগ, সোমবার জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে রক্তৰয়ী সংঘর্ষের ঘটনার মূল নায়ক ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক নির্ঝর আলম সাম্য মহাজোট সরকার ৰমতায় আসার আগে ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি হল শাখার ছাত্রদলের সহ-বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিষয়ক সম্পাদক ছিল। বর্তমান সরকার ৰমতায় আসার পর ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় নেতাদের সঙ্গে অাঁতাত করে বিশ্ববিদ্যালয় শাখার গুরম্নত্বপূর্ণ সাধারণ সম্পাদক পদ বাগিয়ে নেয় সাম্য। এ ব্যাপারে বেশকিছু তথ্যপ্রমাণ হাজির করা হলেও কেন্দ্রীয় কমিটির পৰ থেকে তার বিরম্নদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। এভাবে আরও কিছু ছাত্রলীগ নেতার বিরম্নদ্ধে অতীতে শিবির বা ছাত্রদল করার অভিযোগ পাওয়া গেছে। শুধু জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ই নয়, ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় কমিটি থেকে শুরম্ন করে সারাদেশেই সংগঠনটির কমিটিতে শিবির-ছাত্রদলের অনুপ্রবেশের বিসত্মর অভিযোগ থাকলেও তেমন কোন সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।
জানা গেছে, হঠাৎ করেই জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের দু'গ্রম্নপের সশস্ত্র মহড়া, গুলিবর্ষণ ও সংঘর্ষের ঘটনায় নড়েচড়ে বসেছে প্রশাসন। বিব্রত সরকারের হাইকমান্ড থেকে জড়িতদের বিরম্নদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। হাইকমান্ডের নির্দেশ পেয়ে সংঘর্ষের জড়িতদের গ্রেফতারে চিরম্নণি অভিযান শুরম্ন করেছে আইনশৃঙ্খলাবাহিনী। সোমবার গভীর রাতে চারটি হলে অভিযান চালিয়ে পুলিশ ১৫ জনকে গ্রেফতার করেছে। ১৭ জনকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাময়িক বহিষ্কারও করা হয়েছে। গ্রেফতারকৃত এবং সংঘর্ষের সঙ্গে জড়িত ছাত্রলীগের নেতাকমর্ীদের তালিকা করে তাদের অতীত রাজনৈতিক পরিচিতি উদ্ধারেও মাঠে নেমেছে সরকারের গোয়েন্দা বিভাগ।
ছাত্রলীগ নামক 'বিষফোঁড়া'র কারণে সরকারকে বার বার বেকায়দায় ফেললেও এই সংগঠনটিকে নিয়ে ৰমতাসীন আওয়ামী লীগের বিরম্নদ্ধে লুকোচুরি খেলারও অভিযোগ রয়েছে। দলটির অনেক সিনিয়র নেতাই ৰোভ প্রকাশ করে বলেছেন, গঠনতন্ত্র অনুযায়ী ছাত্রলীগ আওয়ামী লীগের কোন অঙ্গ বা সহযোগী সংগঠন নয়, ছাত্রলীগের দায়ভার আওয়ামী লীগ নেবে না_ সরকার ও দলের উচ্চ পদে বসে কিছু নেতামন্ত্রীর এমন বক্তব্যের কারণেই বেপরোয়া ছাত্রলীগকে বাগে আনা যাচ্ছে না। বরং সিনিয়র নেতাদের এমন প্রশ্নবিদ্ধ মনত্মব্যে ছাত্রলীগ নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়ছে, চেন অব কমান্ড ভেঙ্গে পড়েছে। দায় না এড়িয়ে এখনই শক্তহাতে ছাত্রলীগে শুদ্ধি অভিযান বা নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে আগামীতে সরকারের অনেক ভাল অর্জন ও উদ্যোগই প্রশ্নবিদ্ধ হবে বলে মনত্মব্য করেন তাঁরা

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




