somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

খইয়াছড়ার ডাক

২০ শে আগস্ট, ২০১৪ বিকাল ৫:৩২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

রাত ১০টায় ফোন দিলেন আরমান ভাই, ‘কালকে পাহড়ে ঢুকছি, কাজ-টাজ না থাকলে চলে আসেন।’ পরদিন আমার অনেক কাজ, বলে দিলাম যেতে পারছি না। ফোন রেখে ব্যাগ গোছাচ্ছি, অফিস থেকে বাসায় যাব। হঠাৎ করেই চোখের সামনে ভেসে উঠল পাহাড়ের সারি! অটল-অবিচল সবুজ পাহাড় ধবধবে সাদা মেঘের ভেতরে গলা ডুবিয়ে বসে আছে, তার মাথায় সবুজ চুলের বনে একটানা বাতাসে দোল খেতে খেতে শিস দিচ্ছে ফিঙে পাখির ছানা। আর সবকিছু ছাপিয়ে কোথা থেকে যেন ভেসে আসছে বিরামহীন ছরছর শব্দ। হাজার শব্দের মধ্যেও এই শব্দকে আলাদা করে চিনি আমি। মনের ভেতরে খুশির ফোয়ারা ছড়িয়ে দেওয়া মন-প্রাণ নাচানো এই শব্দ—ঝরনার পানির শব্দ। মাথা ঝাড়া দিয়ে চোখ ফেরালাম সাদা দেয়াল থেকে। চুলোয় যাক কাজ, পাহাড় আমাকে ডাকছে, এই ডাক উপেক্ষা করার মতো কলিজা এখনো আমার হয়নি। অফিসের হাসান ভাইকে রীতিমতো বেঁধে-ধরে এক কাপড়েই সায়েদাবাদ রওনা দিলাম। ঘড়ির কাঁটা রাত দুইটা ছুঁইছুঁই, ততক্ষণে আমরা ছেড়ে গেছি ধুলোর নগর ঢাকার সীমানা—গন্তব্য চট্টগ্রামের মীরসরাই।
.ভোর পাঁচটার কিছুক্ষণ আগে মীরসরাই বাজারে নেমে আরও কিছুদূর এগিয়ে গেলাম খইয়াছড়া বিদ্যালয়ের মাঠে। চট্টগ্রাম থেকে আরমান, অপু আর লিমন ভাইয়ের আসতে সময় লাগবে আর তিন ঘণ্টা। কাজেই এই তিন ঘণ্টার জন্য উদ্বাস্তু আমরা। সাজানো-গোছানো স্কুলের বারান্দায় গামছা পেতে শুয়ে পড়লাম আমি আর হাসান ভাই। পুব আকাশে ততক্ষণে আগুন লেগে গেছে! সূর্যের প্রথম আলো কেটেকুটে ফালাফালা করে দিচ্ছে ঘুমিয়ে থাকা মেঘের সারিকে। ভোরের বাতাসে এদিক-সেদিক ছুটে বেড়াচ্ছে উদ্ভ্রান্ত মেঘের দল। ঘুম মাথায় উঠল, শুয়ে শুয়েই দেখলাম মীরসরাইয়ের পাহাড়ের ওপাশ থেকে সূর্যের উঁকিঝুঁকি। ততক্ষণে চলে এসেছে আমাদের চট্টগ্রামের ‘পাহাড়ি বাহিনী’। পেটে দুটো পরাটা দিয়েই পা চালালাম পুবের পাহাড় লক্ষ্য করে। অপুর কাছে জানলাম এই এলাকায় একটা ঝরনা আছে, কোনো নাম নেই এটার। যেহেতু খইয়াছড়া এলাকায় অবস্থিত, তাই স্থানীয়রা একে ‘খইয়াছড়া ঝরনা’ বলে। আমরা যাচ্ছি এই ঝরনা দেখতেই। 
খইয়াছড়া স্কুলের উল্টো পাশের মূল রাস্তা থেকে পিচঢালা পথ চলে গেছে রেললাইন পর্যন্ত। সেখান থেকে মেঠোপথ আর খেতের আইলের শুরু। তারপর হঠাৎ করেই যেন মাটি সরে গিয়ে উদয় হলো একটা ঝিরিপথের। টলটলে শান্ত পানির চুপচাপ বয়ে চলার ধরনই বলে দিচ্ছে এর উৎস অবশ্যই বিশাল কিছু থেকে। স্থানীয় লোকদের খেতের আইলের পাশে বেড়ে উঠেছে আম, নারকেল আর পেঁপের বাগান। একটা বিশাল জামগাছে পেকে টসটসে হয়ে ঝুলে আছে অজস্র জাম। হাত দিয়ে একটা পাতা টানতেই ঝরঝর করে পড়ে গেল অনেক জাম। সে কী মিষ্টি! চলতি পথে এর বাড়ির উঠান, ওর বাড়ির সীমানা পেরিয়ে অবশেষে ঢুকলাম পাহাড়ের মূল সীমানায়। এরপরে শুধু ঝিরিপথ ধরে এগিয়ে যাওয়া। কিছুক্ষণের মধ্যেই নিজেদের আমরা আবিষ্কার করলাম লাল আর নীল রঙের ফড়িংয়ের মিছিলে! যত দূর পর্যন্ত ঝিরিপথ গেছে তত দূর পর্যন্ত তাদের মনমাতানো গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে। হাঁটতে হাঁটতেই শুনতে পাচ্ছি পানি পড়ার শব্দ। চারপাশে মন ভালো করে দেওয়া সবুজ দোল খাচ্ছে ফড়িংয়ের পাখায়। একটু দূরে কোনো একটা প্রাণী ডেকে উঠল। লিমন ভাই জানালেন, ওটা মায়া হরিণ। হরিণের ডাক আবার শোনার জন্য কান খাড়া করে ফেললাম। তার বদলে শোনা যাচ্ছে একটানা ঝিমঝিম শব্দ! ওই শব্দের উৎসের দিকেই আমাদের যাত্রা। কিছুদূর হেঁটে একটা মোড় ঘুরতেই চোখের সামনে নিজের বিশালতা নিয়ে ঝুপ করে হাজির হলো খইয়াছড়া ঝরনা। অনেক ওপর থেকে একটানা পানি পড়ছে, হাঁ করে দেখার মতো কিছু নেই। এমন ঝরনা আমি এর আগেও গোটা বিশেক দেখেছি। অপু জানালেন, এটা নাকি এই ঝরনার শেষ ধাপ! বলে কি! আমি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালাম, আরও আছে নাকি? অপু হেসে বললেন, দম বন্ধ করতে, সৌন্দর্যের শুরু নাকি এখান থেকেই, এলাকার লোকজন সব নাকি এখান পর্যন্ত এসেই চলে যায়, ওপরের দিকে আর যায় না। এই ঝরনার ওপরে আরও আটটা ধাপ আছে, আমরা দাঁড়িয়ে আছি নবম বা শেষ ধাপের গোড়ায়।
তড়িঘড়ি করে প্রায় খাড়া ঢাল ধরে হাঁচড়ে-পাঁচড় উঠে চললাম উৎসের দিকে। ঝরনার ষষ্ঠ ধাপে এসে মাথা ঘুরে যাওয়ার দশা। চোখের সামনে যা দেখছি বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে। চশমা খুলে মুছে নিয়ে আবার বসালাম নাকের ওপরে। না, ভুল দেখিনি। আমার সামনে একেবারে খাড়া হয়ে ঝুলে আছে খইয়াছড়া ঝরনার তিনটা ধাপ! প্রতিটা ধাপ থেকে সমান তালে পানি পড়ছে। মনে হচ্ছে যেন বিশাল একটা সিঁড়ি চিৎ হয়ে পড়ে আছে সবুজের বাজারে। প্রতিটা ধাপেই ফুটে আছে রংধনু! আমার আর আরমান ভাইয়ের অবাক হওয়া দেখে মজা পাচ্ছে বাকিরা, ওরা আগেও এসেছে। ওপরে নাকি আরও তিনটা ধাপ আছে, সেখানে আছে একটা গভীর বাথটাব, লাফ-ডুব-সাঁতার সবকিছুই হবে ওখানে।
বাংলাদেশের অনেক ঝরনাই আমি দেখেছি। আমার কাছে সৌন্দর্যের দিক থেকে সবাইকে যোজন যোজন মাইল পেছনে ফেলে এগিয়ে আছে বান্দরবানের জাদিপাই ঝরনা। তবে এই ঝরনা দেখার পর আমার ওই বিশ্বাসটা টলতে শুরু করেছে, কে বেশি সুন্দর? জাদিপাই নাকি খইয়াছড়া!
এখানকার নয়টা ধাপের প্রতিটিতেই রয়েছে প্রশস্ত জায়গা, যেখানে তাঁবু টানিয়ে আরাম করে পূর্ণিমা রাত পার করে দেওয়া যায়। একটু চুপচাপ থাকলেই বানর আর হরিণের দেখা পাওয়া যায়। অদ্ভুত সুন্দর এই সবুজের বনে একজনই সারাক্ষণ কথা বলে বেড়ায়, বয়ে যাওয়া পানির রিমঝিম ঝরনার সেই কথা শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়া যায় নিশ্চিন্তে।

.কীভাবে যাবেন
পথের দিক হিসাব করলে বাংলাদেশের বেশ সহজপথের ঝরনা এটা। ঢাকা থেকে চট্টগ্রামের বাসেউঠে ভোরে নেমে যাবেন মীরসরাই বাজারে। সেখান থেকে সিএনজিচালিত অটোরিকশা ভাড়া করে চলে যাবেন খইয়াছড়া স্কুলে। এর উল্টো পাশের পাহাড়ের দিকে যে পিচঢালা রাস্তাটা চলে গেছে, সেদিকে হাঁটা দেবেন। ৪৫ থেকে ৫০ মিনিট পরে নিজেকে আবিষ্কার করবেন এই ঝরনার শেষ ধাপে। ঢাকা থেকে যাওয়া-আসার বাসভাড়া বাদ দিলে সারা দিনে এই ঝরনার পেছনে আপনার খরচ হবে ১০০ টাকারও কম আর সেটাও নির্ভর করবে আপনি কী খাবেন তার ওপর। সারা দিন ঘুরে রাতের বাসেই ঢাকার পথ ধরতে পারেন।

Click This Link
১টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে মুক্তিযোদ্ধাদের মুমিনী চেহারা ও পোশাক দেখে শান্তি পেলাম

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৭ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৯:৫৮



স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে স্টেজে উঠেছেন বত্রিশ মুক্তিযোদ্ধা তাঁদের চব্বিশ জনের দাঁড়ি, টুপি ও পাজামা-পাঞ্জাবী ছিলো। এমন দৃশ্য দেখে আত্মায় খুব শান্তি পেলাম। মনে হলো আমাদের মুক্তিযোদ্ধা আমাদের মুমিনদের... ...বাকিটুকু পড়ুন

দু'টো মানচিত্র এঁকে, দু'টো দেশের মাঝে বিঁধে আছে অনুভূতিগুলোর ব্যবচ্ছেদ

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ১২:৩৪


মিস ইউনিভার্স একটি আন্তর্জাতিক সুন্দরী প্রতিযোগিতার নাম। এই প্রতিযোগিতায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সুন্দরীরা অংশগ্রহণ করলেও কখনোই সৌদি কোন নারী অংশ গ্রহন করেন নি। তবে এবার রেকর্ড ভঙ্গ করলেন সৌদি... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমাদের দুই টাকার জ্ঞানী বনাম তিনশো মিলিয়নের জ্ঞানী!

লিখেছেন সাহাদাত উদরাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ২:৫৯

বিশ্বের নামীদামী অমুসলিমদের মুসলিম হয়ে যাওয়াটা আমার কাছে তেমন কোন বিষয় মনে হত না বা বলা চলে এদের নিয়ে আমার কোন আগ্রহ ছিল না। কিন্তু আজ অষ্ট্রেলিয়ার বিখ্যাত ডিজাইনার মিঃ... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমি হাসান মাহবুবের তাতিন নই।

লিখেছেন ৎৎৎঘূৎৎ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



ছোটবেলা পদার্থবিজ্ঞান বইয়ের ভেতরে করে রাত জেগে তিন গোয়েন্দা পড়তাম। মামনি ভাবতেন ছেলেটা আড়াইটা পর্যন্ত পড়ছে ইদানীং। এতো দিনে পড়ায় মনযোগ এসেছে তাহলে। যেদিন আমি তার থেকে টাকা নিয়ে একটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তিযোদ্ধাদের বিবিধ গ্রুপে বিভক্ত করার বেকুবী প্রয়াস ( মুমিন, কমিন, জমিন )

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৫:৩০



যাঁরা মুক্তিযদ্ধ করেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে লেখা তাঁদের পক্ষে মোটামুটি অসম্ভব কাজ। ১৯৭১ সালের মার্চে, কৃষকের যেই ছেলেটি কলেজ, ইউনিভার্সিতে পড়ছিলো, কিংবা চাষ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো, সেই ছেলেটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×