১৯৭১ সালে দেশ স্বাধীন হয়েছে। ৯ মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর আমরা একটি স্বাধীন ভূখণ্ড পেয়েছি। পেয়েছি মানচিত্র, পতাকা, ভাষা, নিজস্ব সংস্কৃতি ইত্যাদি। ৪১ বছর পর আজ জ্ঞানী ব্যক্তিদের মুখ থেকে বের হয়ে আসছে—আমরা তো এমন স্বাধীনতা চাইনি। শাসকগোষ্ঠীর অত্যাচার, নির্যাতন, নিপীড়ন, নির্বিচারে খুন, হত্যা, গুম, ক্রসফায়ার, গণগ্রেফতার—এসব তাণ্ডব দেখে সুধীজনের মুখ থেকে বের হয়ে আসছে—এমন স্বাধীনতা আমরা চাইনি। আমরা চেয়েছিলাম একটি সুখী সমৃদ্ধশালী বাংলাদেশ—যা বিশ্ব দরবারে মডেল হয়ে থাকবে। যেখানে অবাধ গণতন্ত্রের চর্চা থাকবে, অনুশীলন হবে, সুশাসন প্রতিষ্ঠা, স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত হবে, মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তি আসবে, ভাষা, সংস্কৃতি ব্যবহারে মানুষ সভ্যতার পরিচয় দেবে—এমনই একটি স্বাধীনতা আমরা চেয়েছিলাম। স্বাধীনতা-উত্তর শাসকগোষ্ঠী স্বাধীনতার সুফলকে নিজেদের ঘরে তুলে নেয়ার চেষ্টা করেছেন। অবাধ লুটপাট হয়েছে, রিলিফের চাল, গম, আটা এমনকি কম্বল চুরি করেও রেকর্ড স্থাপন করা হয়েছে। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু দেশে ফিরে এলেন, সরকার গঠন করলেন। জাতি তাকে অনেক বড় মাপের নেতা হিসেবে সম্মান এবং শ্রদ্ধা করত। গণতন্ত্র, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা, ভাষা-সংস্কৃতির স্বাধীনতা, হত্যা-খুন-গুম ও পাকিস্তানি বৈষম্যবাদের বিরুদ্ধে নিরন্তর সংগ্রামে তিনি ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। জেলে ঢুকিয়ে, বরফ দিয়ে, মাথার ওপর পাওয়ার বাতি দিয়ে নির্যাতন করে তাকে আন্দোলন থেকে সরে আসার চাপ দেয়া হয়েছে। কিন্তু তিনি পিছপা হননি।
স্বাধীনতার পর আমরা তাকে কীভাবে দেখেছি? ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে তিনি রক্ষী বাহিনী, লাল বাহিনী, নীল বাহিনী এসব রংবেরঙের বাহিনী তৈরি করে এদেশের শিক্ষিত প্রতিবাদী যুবকদের ধরে নিয়ে হত্যা করেছেন। কেউ বলে ৪০ হাজার আবার কেউ বলে ৩৬ হাজার মেধাবী টগবগে যুবক তার রক্ষী বাহিনীর নির্যাতনে খুন হয়েছেন। ৫ হাজার দেশপ্রেমিক মানুষকে গুম করা হয়েছে। তাদের হদিস আজও মেলেনি। ২৬২টি সংবাদপত্র বন্ধ করে দিয়ে মাত্র ৪টি দালাল পত্রিকা চালু রাখা হয়েছিল। এরপরও জনগণের মুখ বন্ধ করতে না পেরে ’৭৫-এর জানুয়ারিতে সব রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ ঘোষণা করে একদলীয় বাকশাল কায়েম করা হয়েছিল। অর্থাত্ ভিন্ন মতের কোনো রাজনৈতিক দল এ দেশে থাকতে পারবে না। স্বাধীনতার স্বপ্নকে ভূলুণ্ঠিত করা হয়েছিল। মাত্র ১৩ মিনিটে গণতন্ত্রকে হত্যা করা হয়েছিল। ১৯৭৪ সাল, বঙ্গবন্ধু তখন প্রধানমন্ত্রী। সিরাজ সিকদারকে হত্যা করে পার্লামেন্টে দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘কোথায় আজ সিরাজ সিকদার?’ তার এ বক্তব্যের রেকর্ড এখনও পার্লামেন্টে বহাল তবিয়তে আছে। বঙ্গবন্ধু আদেশ দিলেন নকশাল দেখামাত্রই গুলি করতে হবে। মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী বঙ্গবন্ধুর এই ঘোষণার প্রতিবাদ জানিয়ে বলেছিলেন, এই মুজিব, নকশাল কারো গায়ে লেখা আছে নাকি? কে নকশাল আর কে বাকশাল তোমার পুলিশ কীভাবে চিনবে? মওলানা ভাসানীর এ ধমকে শেখ মুজিব প্রকম্পিত হয়েছিলেন। অথচ তাকে আজ রাজনৈতিক অর্থে খুনি বলা গুরুতর অপরাধ। তার বিরুদ্ধে কথা বললে আইন লঙ্ঘন হয়ে যায়। ’৭২ থেকে ’৭৫ সাল পর্যন্ত আইনশৃঙ্খলার চরম অবনতির কথা কে না জানে? প্রতি রাতে প্রতি গ্রামে দু’চার বাড়িতে ডাকাতি হতো। মানুষ একসের চাল কিনে সন্ধ্যার পর বাজার থেকে বাড়ি যেতে পারতেন না। রাস্তায় আওয়ামী লীগের দুর্ধর্ষ ডাকাতরা আগ্নেয়াস্ত্র, ছোরা, চাকু, লাঠি, বল্লম নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকত। সে ছিল এক বিভীষিকাপূর্ণ অবস্থা। ডাকাতরা ছিল ধরাছোঁয়ার বাইরে। আইন ছিল তাদের কাছে পরাজিত। তখন মানুষ মনে করতেন দেশ আজ ‘হীরক রাজার’ হাতে বন্দি। স্বাধীনতার পর মানুষ এমন লুটেরার হাতে বন্দি হবে এটা কেউ প্রত্যাশা করেননি। এমন লুটতরাজ হবে এটা ছিল মানুষের কল্পনার বাইরে। বঙ্গবন্ধু এমন হিংস্র হবেন এটাও ছিল ধারণার বাইরে। ভয়ঙ্কর এই শাসকগোষ্ঠীর তাণ্ডব দেখে মানুষ স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল। আতঙ্কগ্রস্ত জনতাকে রক্ষা করার জন্য মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, জাসদের মেজর জলিল, আসম আবদুর রব, শাজাহান সিরাজের মতো নেতারা এর প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন। গণবাহিনীর নেতা বর্তমান তত্তমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু ছিলেন তখন দেশের চতুর্থ শ্রেণীর নেতা। তিনিও মুজিবী দুঃশাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর ছিলেন। (ক্রমশ)

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




