আমাদের চারপাশে অসংখ্য ব্র্যান্ড প্রতিনিয়ত আমাদের মনোযোগ আকর্ষণের চেষ্টা করছে। কিন্তু কেবল কিছু ব্র্যান্ডই আমাদের হৃদয়ে স্থান করে নিতে সক্ষম হয়। এর পেছনে একটি বিশেষ কৌশল কাজ করে, যেটিকে বলা হয় ইমোশনাল মার্কেটিং। এই কৌশলের মাধ্যমে ব্র্যান্ডগুলো তাদের পণ্য বা সেবাকে গ্রাহকদের আবেগের সঙ্গে যুক্ত করে তোলে, যা তাদের মনে গভীর প্রভাব ফেলে। আজ আমরা ইমোশনাল মার্কেটিং কীভাবে কাজ করে এবং ব্র্যান্ডগুলো কিভাবে এটি ব্যবহার করে তা নিয়ে আলোচনা করবঃ
ইমোশনাল মার্কেটিং কী?
ইমোশনাল মার্কেটিং হল এমন একটি কৌশল যেখানে ব্র্যান্ডগুলো তাদের মার্কেটিং বার্তা এবং কন্টেন্টের মাধ্যমে গ্রাহকদের আবেগময় প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। এটি গ্রাহকদের মধ্যে আনন্দ, দুঃখ, ভালোবাসা, গর্ব, ভয়, বা স্নেহের মতো আবেগ উদ্রেক করতে পারে। এই আবেগগুলো গ্রাহকদের ব্র্যান্ডের প্রতি আরও আকৃষ্ট করে এবং তাদের ক্রয় সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করে।
ব্র্যান্ডগুলো কিভাবে ইমোশনাল মার্কেটিং ব্যবহার করে?
গল্প বলাঃ গল্প বলার মাধ্যমে ব্র্যান্ডগুলো তাদের পণ্য বা সেবার পেছনের গল্প তুলে ধরে, যা গ্রাহকদের আবেগময় প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। উদাহরণস্বরূপ, কোকাকোলার বিজ্ঞাপনে প্রায়শই বন্ধুত্ব, পরিবার এবং মিলনমেলার গল্প দেখানো হয়, যা আমাদের হৃদয়কে স্পর্শ করে।
সামাজিক প্রমাণঃ ব্র্যান্ডগুলো প্রায়ই তাদের পণ্য বা সেবার সন্তুষ্ট গ্রাহকদের অভিজ্ঞতা শেয়ার করে। এই অভিজ্ঞতাগুলো গ্রাহকদের মধ্যে বিশ্বাস এবং নিরাপত্তার অনুভূতি তৈরি করে। যেমন: নাইক, অ্যাডিডাস ইত্যাদি ব্র্যান্ড তাদের পণ্য ব্যবহার করা বিভিন্ন ক্রীড়াবিদ এবং সেলিব্রিটির কাহিনী তুলে ধরে।
মানসিক সংযোগঃ ব্র্যান্ডগুলো তাদের গ্রাহকদের সঙ্গে মানসিক সংযোগ গড়ে তোলার চেষ্টা করে। এটি হতে পারে সাধারণ মানুষের জীবনের ছোট ছোট মুহূর্তগুলোর সঙ্গে নিজেদের পণ্যকে সংযুক্ত করা। উদাহরণস্বরূপ, ডাভ তাদের বিজ্ঞাপনে নারীদের প্রকৃত সৌন্দর্যকে উদযাপন করে, যা নারীদের মধ্যে আত্মবিশ্বাস বাড়ায়।
সংবেদনশীল ছবি ও ভিডিওঃ ব্র্যান্ডগুলো তাদের বিজ্ঞাপন এবং কন্টেন্টে সংবেদনশীল ছবি ও ভিডিও ব্যবহার করে, যা দেখে গ্রাহকরা আবেগপ্রবণ হন। যেমন: "অলওয়েজ" ব্র্যান্ডের "লাইক এ গার্ল" ক্যাম্পেইন, যা নারীদের ক্ষমতায়ন এবং আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধির উপর জোর দেয়।
বিশেষ অনুষ্ঠান ও উৎসবঃ ব্র্যান্ডগুলো প্রায়ই বিশেষ অনুষ্ঠান ও উৎসব উপলক্ষে ইমোশনাল মার্কেটিং ক্যাম্পেইন চালায়। উদাহরণস্বরূপ, ঈদ, বড়দিন, পহেলা বৈশাখ ইত্যাদি উৎসব উপলক্ষে বিভিন্ন ব্র্যান্ড তাদের পণ্যকে আবেগময় বার্তার সঙ্গে প্রমোট করে।
মানবিক মূল্যবোধঃ ব্র্যান্ডগুলো মানবিক মূল্যবোধের উপর ভিত্তি করে ইমোশনাল মার্কেটিং ক্যাম্পেইন পরিচালনা করে। উদাহরণস্বরূপ, P&G-এর "থ্যাঙ্ক ইউ, মম" ক্যাম্পেইন, যেখানে মায়েদের প্রতি সন্তানের ভালোবাসা এবং কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা হয়।
ইমোশনাল মার্কেটিং-এর সুফলঃ ব্র্যান্ড লয়াল্টি বৃদ্ধি: গ্রাহকরা আবেগময় সংযোগের মাধ্যমে ব্র্যান্ডের প্রতি লয়াল্টি বা বিশ্বস্ততা বৃদ্ধি পায়।ক্রয় সিদ্ধান্ত প্রভাবিত করা: আবেগের মাধ্যমে গ্রাহকদের ক্রয় সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করা সহজ হয়।
ব্র্যান্ড পরিচিতি বৃদ্ধি: ইমোশনাল কন্টেন্ট সহজেই ভাইরাল হয়, যা ব্র্যান্ডের পরিচিতি বৃদ্ধি করে।মানসিক প্রভাব: গ্রাহকদের মনে ব্র্যান্ডের একটি স্থায়ী ছাপ ফেলে।
বাংলাদেশের ব্র্যান্ডগুলোর কিছু উদাহরণ তুলে ধরা হলোঃ
১। গ্রামীণফোন
গ্রামীণফোন বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় মোবাইল নেটওয়ার্ক অপারেটর। তাদের ইমোশনাল মার্কেটিং কৌশলের কিছু উদাহরণ:
"বন্ধু" ক্যাম্পেইন
গ্রামীণফোনের "বন্ধু" ক্যাম্পেইনটি বন্ধুত্বের গুরুত্ব এবং মানুষের জীবনে এর প্রভাব নিয়ে তৈরি। বিজ্ঞাপনে সাধারণ মানুষের বন্ধুত্বের গল্প তুলে ধরা হয়, যা দেখলে হৃদয় স্পর্শ করে।
"জীবনের গল্প"
গ্রামীণফোনের "জীবনের গল্প" ক্যাম্পেইনটি মানুষের জীবনকে আরও উন্নত করার জন্য প্রযুক্তির প্রভাব নিয়ে তৈরি। এখানে গ্রাহকদের বিভিন্ন জীবনমুখী কাহিনী তুলে ধরা হয়, যা তাদের সঙ্গে মানসিক সংযোগ স্থাপন করে।
২। রবি
রবি বাংলাদেশের আরেকটি শীর্ষস্থানীয় মোবাইল নেটওয়ার্ক অপারেটর। তাদের ইমোশনাল মার্কেটিংঃ
"মা ও মেয়ের গল্প"
রবি আজিয়াটার "মা ও মেয়ের গল্প" ক্যাম্পেইনটি মা ও মেয়ের সম্পর্কের গুরুত্ব এবং তাদের জীবনে মোবাইল যোগাযোগের প্রভাব নিয়ে তৈরি। এই ক্যাম্পেইনটি মা-মেয়ের আবেগময় সম্পর্ককে তুলে ধরে, যা দর্শকদের মন ছুঁয়ে যায়।
"দূরত্বে নয়, সম্পর্কের বন্ধনে"
রবি আজিয়াটার এই ক্যাম্পেইনটি দূরত্বে থাকা প্রিয়জনদের সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষা করার গুরুত্ব নিয়ে তৈরি। বিজ্ঞাপনে দূরত্বে থাকা পরিবারের সদস্যদের কাহিনী তুলে ধরা হয়, যা আবেগময় প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে।
৩। আরলা ফুডস (দুগ্ধজাত পণ্য)
আরলা ফুডস তাদের "ডানো" ব্র্যান্ডের মাধ্যমে ইমোশনাল মার্কেটিং ব্যবহার করে। তাদের ক্যাম্পেইনঃ
"মায়ের আদর"
ডানোর "মায়ের আদর" ক্যাম্পেইনটি মায়ের ভালোবাসা এবং সন্তানের জন্য তার যত্নের গুরুত্ব তুলে ধরে। বিজ্ঞাপনে মায়ের যত্ন এবং সন্তানের স্বাস্থ্যকর বৃদ্ধির গল্প তুলে ধরা হয়, যা মায়েদের সঙ্গে গভীর সংযোগ স্থাপন করে।
"সুখের সংসার"
এই ক্যাম্পেইনটি পরিবারের সুখ এবং সুস্থতার গুরুত্ব নিয়ে তৈরি। ডানোর দুধ এবং অন্যান্য পণ্যগুলো কিভাবে পরিবারের সুস্থতা বজায় রাখতে সাহায্য করে তা তুলে ধরা হয়।
৪। ব্র্যাক ব্যাংক
ব্র্যাক ব্যাংক তাদের ইমোশনাল মার্কেটিং কৌশলে সাধারণ মানুষের জীবনের সঙ্গে ব্যাংকিং সম্পর্কিত কাহিনী তুলে ধরে।
"স্বপ্ন পূরণের গল্প"
ব্র্যাক ব্যাংকের এই ক্যাম্পেইনটি সাধারণ মানুষের স্বপ্ন পূরণের গল্প তুলে ধরে। এখানে বিভিন্ন পেশার মানুষের গল্প দেখানো হয়, যারা ব্যাংকের সহায়তায় তাদের স্বপ্ন পূরণ করতে পেরেছে। এই গল্পগুলো গ্রাহকদের মনকে স্পর্শ করে এবং তাদের মধ্যে ব্র্যান্ডের প্রতি বিশ্বাস সৃষ্টি করে।
৫। প্রাণ আরএফএল
প্রাণ আরএফএল তাদের পণ্যগুলোর মাধ্যমে গ্রাহকদের জীবনের সঙ্গে সংযোগ স্থাপনের জন্য ইমোশনাল মার্কেটিং ব্যবহার করে।
"বাংলার স্বাদ"
প্রাণের "বাংলার স্বাদ" ক্যাম্পেইনটি বাংলাদেশের স্থানীয় খাবারের স্বাদ এবং ঐতিহ্য তুলে ধরে। বিজ্ঞাপনে বিভিন্ন স্থানীয় খাবারের কাহিনী দেখানো হয়, যা মানুষের আবেগময় প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে।
"পরিবারের জন্য"
প্রাণ আরএফএলের এই ক্যাম্পেইনটি পরিবারের সুখ এবং মিলনের গুরুত্ব নিয়ে তৈরি। বিজ্ঞাপনে পরিবারের সদস্যদের একসঙ্গে খাওয়ার এবং সময় কাটানোর গল্প তুলে ধরা হয়।
ইমোশনাল মার্কেটিং হল একটি শক্তিশালী কৌশল যা ব্র্যান্ডগুলোকে তাদের গ্রাহকদের সঙ্গে গভীর এবং অর্থবহ সংযোগ স্থাপন করতে সহায়তা করে। এটি কেবলমাত্র পণ্য বিক্রয়ের জন্য নয়, বরং একটি দীর্ঘমেয়াদী সম্পর্ক গড়ে তোলার জন্যও অত্যন্ত কার্যকর। সঠিকভাবে ব্যবহৃত হলে, ইমোশনাল মার্কেটিং আপনার ব্র্যান্ডকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যেতে পারে।





অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।


