পশ্চিমা দেশগুলোতে হেমন্তকাল খুব উৎসবমুখর। হালকা ঠান্ডা আবহাওয়ার সাথে অক্টোবরের শুরু থেকেই বাতাসে উৎসবের গন্ধ। উইকএন্ডের দিনগুলো হ্যালোউইনের থীম নিয়ে পার্টি শুরু হয়ে গেছে অক্টোবরের শুরু থেকেই-- ৩১ শে অক্টোবর হ্যালোউইন-- অফিস আদালত, বাড়ি, ইশকুল, দোকানপাট, হাসপাতাল-- কোথায় কুমড়ো, ক্যান্ডি, কুকি আর চকোলেট নেই!!!!!! তারপর নভেম্বরে থ্যাংকস গিভিং, ডিসেম্বরে ক্রিসমাস। আর পরের বছরের প্রথম দিনটি-- নিউ ইয়ার্স। এই পুরোটা সময়ে পশ্চিমা দেশগুলো জমজমাট-- কারণ এটা হলিডে সীজন!! চারপাশে হাসিমুখ, মজার রান্নাবান্না, খাওয়াদাওয়া, কেনাকাটা, আত্মীয় আর প্রিয়জনদের সাথে দেখাসাক্ষাৎ-- আমাদের দেশের ঈদের সময়টুকুর কথা ভাবুন-- ঠিক যেন সেরকম আনন্দের ছোঁয়া চারদিকে।
হারভেস্ট ফেস্টিভ্যাল শুরু হয়ে গেছে, অনেকটা যেন বাংলাদেশের নবান্ন উৎসব, সারা পৃথিবীতে হেমন্তকাল বিভিন্ন সময়ে এলেও নতুন ফসল ঘরে ওঠার প্রেক্ষিতে নিজস্ব আবহে নাচ, গান আর মজার খাবারদাবারের সাথে নিজস্ব কিছু উৎসব পালন কিন্তু সর্বজনীন। এক ছুটির দিনে গিয়েছিলাম কান্ট্রিসাইডের দিকে এক ফার্মে। টিকেট কেটে ঢুকতে হয়। সেখানে ছিল শিশুদের জন্য বিভিন্ন ইভেন্ট- পনি রাইড, জাম্পেলিন, ট্রেন, কাররাইড, হিউম্যান বাবল, বিভিন্ন প্রাণীর সাথে মোলাকাত, বেশ কিছু প্রতিযোগিতামূলক খেলাধুলা, গান, নাচ, আর ইয়াম ইয়াম সব খাবার। বিভিন্ন স্টল আর বুথে ছিল গয়নাগাঁটি, পোশাক, খেলনা আরও অনেক কিছু!
হ্যালোউইন এর ধারণা কোত্থেকে এলো দেখা যাক। প্রাচীন কেল্টিক (বা শেল্টিক) স-ইন (Samhain) ফেস্টিভ্যাল থেকে এর উৎপত্তি। দু'হাজার বছর আগে কেল্টরা বর্তমান আয়ারল্যান্ড, ইউনাইটেড কিংডম ও উত্তর ফ্রান্স জুড়ে বাস করত। তাদের নববর্ষ ছিল নভেম্বর ১-- গ্রীষ্মের শেষ এবং ধূসর শীতের শুরুর এ সময়টিকে মানুষের মৃত্যুর সাথে একাত্ম করেও ভাবা হতো। কেল্টদের ধারণা ছিল, নববর্ষের আগের রাতে জীবিত আর মৃতের ভেতরের দূরত্ব আবছা হয়ে আসে, তাই অক্টোবরের ৩১ এর রাতে মৃত আত্মারা পৃথিবীতে হাজির হয় এবং তাদের উপস্থিতির মাধ্যমে কেল্টিক প্রীস্টরা (Druids) ভবিষ্যতবাণী করত আগামী বছর কেমন কাটবে। প্রাকৃতিক শক্তির কাছে সম্পূর্ণই প্রণত মানুষরা তাদের মানসিক শান্তির জন্য, সামনের শীতের দিনগুলোতে তাদের করণীয় সম্পর্কে সব ধরণের নির্দেশনার জন্য অপেক্ষা করত অধীরভাবে, তাই এই রাতের ভবিষ্যতবাণীর মূল্য ছিল অপরিসীম। বিরাট জনসমাবেশে এই রাতে কেল্টিক প্রীস্টরা দেবতাদের উদ্দেশ্যে আগুন জ্বালিয়ে (bonfire) তাতে শস্য আর প্রাণী নিক্ষেপ করত। প্রাণীর মাথা আর চামড়া দিয়ে তৈরি পোশাক পরে এই উৎসবে উৎসাহী সবার ভবিষ্যতবাণী করা হতো।
দিন গড়ালো। ৪৩ খ্রীস্টাব্দে কেল্টিক এলাকায় রোমান সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হলো। তাদের চারশ' বছরের রাজত্বে রোমানদের নিজস্ব দুটি অনুষ্ঠানের সাথে কেল্টিকদের স-ইন ফেস্টিভ্যাল মিলে ইতোমধ্যে নতুন দুটি ফেস্টিভ্যাল তৈরি হয়েছে - ফেরালিয়া এবং আরেকটি দেবি পমোনাকে উদ্দেশ্য করে। পমোনা রোমানদের ফল এবং বৃক্ষের দেবী। বর্তমানে হ্যালোউইনের অ্যাপল-ববিং এর ধারণা সেখান থেকেই এসেছে।
নবম শতকে ইউরোপে খ্রিস্টান সাম্রাজ্যের বিস্তারের সাথে সাথে রোমান অনুষ্ঠানগুলোতেও কিছু পরিবর্তন আসে। ক্রিশ্চিয়ান ধারণায় ৮৩৫ খ্রিস্টাব্দ থেকে ৩১ শে অক্টোবরের কেল্টিক স-ইন ফেস্টিভ্যাল পরিবর্তিত হয়ে নতুন নামকরণ হয় All-hallows Evening বা Halloween. নভেম্বর ১ হলো All Hallows' Day এবং নভেম্বর ২ হলো All Saints' Day। কাজেই সমন্বিতভাবে এই তিনদিনকে বলা হয় Allhallowtide-- সেইন্টদেরকে সম্মান জানানোর সাথে সাথে সদ্যমৃত আত্মারা- যারা এখনো স্বর্গে পৌঁছাতে পারেনি, তাদের জন্য প্রার্থনার জন্য বাৎসরিকভাবে এই সময়কে নির্ধারণ করা হয়। বারো শতকে এই তিনদিনের পবিত্র সময়ে ইউরোপে ক্ষুধার্তদের জন্য তৈরি করা হতো Soul cake; ট্রিক-অর-ট্রিটিংএর ধারণার উৎপত্তি এখান থেকেই বলে মনে করা হয়। গরীব শিশুরা এক বাড়ীর আঙিনা থেকে আরেক বাড়ী ছুটে যেতো কিছু খাবারের আশায়-- বিনিময়ে দাতাদের মৃত আত্মীয় স্বজনদের জন্য তারা প্রার্থনা করত।
আমেরিকার ম্যারিল্যান্ডে ক্যাথোলিক কলোনিস্টরা এবং অ্যামেরিকান সাউথে অ্যাংগলিকান কলোনিস্টরা হ্যালোউইন উদযাপন করত প্রথম থেকেই। কিন্তু নিউ ইংল্যান্ড কলোনিস্টরা ( colonies of Connecticut, Colony of Rhode Island and Providence Plantations, Massachusetts, and Province of New Hampshire) ছিল পিউরিটান। তারা হ্যালোউইনসহ অনেক অনুষ্ঠানের একেবারেই বিপরীতে ছিল। উনিশ শতকে ঢালাওভাবে স্কটিশ এবং আইরিশ ইমিগ্রান্ট আমেরিকায় আসে- তখন থেকে হ্যালোউইন আমেরিকার একটি জাতীয় উৎসবে পরিণত হয়।
হ্যালোউইনের কুসংস্কারগুলো বেশ মজার। মৃত আত্মীয় বা বন্ধুর জন্য খালি চেয়ার রাখা হয় টেবিলে- সামনে থাকে খাবারভর্তি প্লেট। কিছু খাবার রাখা হয় বাইরের ভূতদের জন্য। পিচ্চি ভূতদের জন্য চকলেট-ক্যান্ডি-কুকি তো আছেই! জ্যাক- ও- ল্যান্টার্ণে উঠোনে আলো জ্বালানো হয় যাতে প্রিয় মৃত আত্মারা পথ খুঁজে ঘরে ফিরতে পারে। কালো বিড়ালটা এই রাতে পাশ দিয়ে গেলো তো মহাবিপদ! তৈরি হন সামনের দুর্ভাগ্য বা ভয়াবহ খারাপ কিছুর জন্য! ঝুলে থাকা মইয়ের নিচ দিয়ে হাঁটা একেবারেই নিষেধ। এছাড়া ভাঙা আয়না, রাস্তায় ভাঙা কোন কিছুতে পা মাড়ানো অথবা কোনোভাবে লবণ ছিটকে পড়লো-- আপনাকে উচ্চস্বরে "সাবধান!!!!!!!" বলা ছাড়া আর কিই বা করার আছে আমার?
আঠারো শতকের দিকে অন্য ধরণের আচারও পালন হত হ্যালোউইনে। বিয়ের সাথে সম্পর্কিত ছিল কিছু অনুষ্ঠান। তখন স্কটল্যান্ডে এই দিনে কুমারী মেয়ে তার সম্ভাব্য বিয়ের প্রার্থীদের নাম একেকটি হেইজেলনাটে লিখে ফায়ারপ্লেসের আগুনে ছুঁড়ে মারত। যার নাম সম্বলিত নাট না ফেটে আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে যাবে সর্বপ্রথম, তিনিই সম্ভাব্য বর! অথবা আজ রাতে স্বপ্নে যিনি আসবেন, তিনিই হয়ত সেইজন! কুমারী মেয়েরা কাঁধের ওপর দিয়ে আপেলের ছাল ছুঁড়ে ফেলত পেছনে-মাটিতে পড়ে থাকা ছালের থেকে তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে ধারণা করা হতো বরের নামের আদ্যাক্ষর! ছেলেদের পার্টিতে আপেল ডুবানো পানির গামলা থেকে যে প্রথম আপেল তুলে আনতে পারবে মুখ দিয়ে ( হাতে স্পর্শ করা যাবে না) সেই আপেল-ববার হল সৌভাগ্যবান পুরুষ, যার কপালে সবার আগে বৌ জুটবে। এমন আরও শত শত (কু)সংস্কারে ঘেরা ছিল আগেকার হ্যালোউইন উদযাপন।
এই সময়কার হ্যালোউইন উৎসব কিরকম? ট্রিক-অর-ট্রিটিং, কস্টিউম পার্টি, হ্যালোউইন ডেকোরেশন, পাম্পকিন কার্ভ করে জ্যাক-ও-ল্যান্টার্ণ বানানো, বনফায়ার, অ্যাপল- ববিং, ফরচুন-টেলিং গেইমস, হন্টেড অ্যাট্রাকশনগুলোতে বেড়াতে যাওয়া, হরর মুভি টাইম ছাড়াও আছে চার্চের পক্ষ থেকে মৃতদের জন্য মোম জ্বেলে সম্মান জানানো। মৃতদের সম্মানে কেউ কেউ এই রাত্তিরে একেবারে ভেজেটেরিয়ান- মাংসজাতীয় কোন খাবার মেন্যুতে রাখেন না। তবে আমেরিকার সমসাময়িক হ্যালোউইন উদযাপন ধর্মভিত্তিক না বলে বিনোদনমূলক বলাটাই বেশি যৌক্তিক হবে। সন্ধ্যে হওয়ার সাথে সাথে শিশু-কিশোররা নানারকম কস্টিউম পরে বাড়ি বাড়ি ট্রিক-অর ট্রিটিং এ যায়- অভিভাবভাবকরা সাথেই থাকেন। এখনকার স্বাস্থ্যসচেতন ট্রিটাররা ক্যান্ডি-কুকির পাশাপাশি মিনিপ্যাক প্রেৎযেল, জুস, খেলনা, স্টিকার, পেন্সিল, ইরেজার, এমনকি টুথব্রাশের মত বিশেষ দরকারী জিনিসগুলোও উপহার হিসেবে রাখেন। বড়দের আছে নিজস্ব পার্টি-- এক বাসায় দেখেছি ওপেন পার্টি ফর অল-- যে কেউ এসে জয়েন করতে পারে সেখানে। কস্টিউমেও অনেক বৈচিত্র্য এসেছে-- শুধু ভূত প্রেত ডাইনি নয়-- ব্যাটম্যান সুপারম্যান থেকে শুরু করে সাই-ফাই ক্যারেক্টারগুলোও সব জায়গা করে নিয়েছে এই উৎসবে।
এবার কিছু ব্যক্তিগত মতামত। পৃথিবীতে ধর্মের সংখ্যা কম নয়- ৪২০০ এরও বেশি। আমি বা আপনি যেমন নিজ নিজ ধর্ম ধারণ করেছি, অন্যরাও তাই। এক ঈশ্বরে বিশ্বাস থাকলে ঈশ্বর পুরো মানবজাতিকে সৃষ্টি করেছেন- এ ভাবনাটাই তো স্বাভাবিক। সে হিসেবে নিজেকে বড় বা পুরোপুরি অন্যরকম ভাবার কিছু নেই। অন্য কোন ব্যক্তি আপনার-আমার থেকে বড় নয়, ছোটও নয়, মানুষ হিসেবে আমরা সবাই সমান। অ্যামাজন রেইন ফরেস্টে মুসলমান, হিন্দু, খ্রিস্টান বা বৌদ্ধদের পা পড়েনি, তাই সেখানে এই ধর্মগুলোর প্রচার বা প্রসার হয়নি। সেক্ষেত্রে অ্যামাজন রেইন ফরেস্টের অধিবাসীরা সেখানে তাদের নিজস্ব আচার পালন করবে- সেটাই কি স্বাভাবিক নয়? প্রকৃতি বৈচিত্র্যময়। সেজন্যই প্রকৃতি সুন্দর। ভাবুন ফুলের কথা- প্রকৃতি শুধু আপনার পছন্দের ফুল লাল গোলাপ দিয়ে ভরে আছে- একদিন আপনার কাছে তাতে অস্বস্তিবোধ শুরু হবে না? আপনি যদি সম্মান চান, অন্যকেও সম্মান দিন। এক পৃথিবীর অধিবাসীদের সব ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধা রাখুন। অন্য ধর্ম পালন করার কথা বলছি না, আমরা যেন শুধু অন্য কোন ধর্মকে অসম্মান না করি।
সবাইকে হ্যালোউইনের শুভেচ্ছা!!!!!!
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই নভেম্বর, ২০১৫ রাত ২:২৫