দীর্ঘ আট বছরেও নিষ্পত্তি হয়নি শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে দায়ের করা গণভবন দখল মামলা। গণভবন দখল অবৈধ ও বেআইনি বলে কেন ঘোষণা করা হবে না-এই মর্মে শেখ হাসিনার প্রতি জারি করা হাইকোর্টের রুলনিশির জবাবও তিনি দেননি (আদালত অবমাননা!)। শেখ হাসিনা এই রুলের জবাব দিয়ে মামলা নিষ্পত্তির আবেদন না করায় বর্তমানে এ মামলাটি হাইকোর্টের কার্য তালিকার বাইরে রয়েছে। এদিকে হাজার কোটি টাকার সম্পদ ও দেশের ঐতিহ্য এ গণভবনের বরাদ্দ এখনো শেখ হাসিনার নামেই রয়েছে বলে গণপুর্ত অধিদফতর সুত্র জানিয়েছে। উল্লেখ্য, সরকারি এই ভবনটি বর্তমানে প্রধান উপদেষ্টার ভবন হিসেবে নামকরণ করা হয়েছে।
গণভবন দখলঃ শেরেবাংলা নগরে জাতীয় সংসদ ভবনের উত্তর-পশ্চিম কোণে বিশাল জায়গাজুড়ে অবস্হিত গণভবনই হচ্ছে দেশের প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন। ১৯৯৬ সালে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেয়ার পর শেখ হাসিনা এ ভবনে ওঠেন। ২০০১ সালে ক্ষমতা ছাড়ার মাত্র এক মাস আগে তিনি তার প্রধানমন্ত্রিত্বের প্রভাব কাজে লাগিয়ে দেশের ইতিহাস-ঐতিহ্যের সঙ্গে জড়িত ওই ভবনটি মাত্র এক টাকার বিনিময়ে তার নিজের নামে রেজিষ্ট্রি করিয়ে নেন। একই সঙ্গে তিনি এ ভবনে বিশেষ সুবিধা নিয়ে আজীবন থাকার জন্য ওই বছর ১৮ জুন সপ্তম জাতীয় সংসদের শেষ অধিবেশনে ‘জাতির জনকের পরিবারের সদস্যদের নিরাপত্তা বিধান-২০০১’ নামে একটি আইন পাস করান। এর আগে ১৪ জুন রাষ্ট্রপতির অনুমোদনের সময় এই আইনে গণভবনটি নিরাপত্তার অংশ হিসেবে উল্লেখ না থাকলেও সংসদীয় স্হায়ী কমিটি বিলটি যাচাই-বাছাইয়ের সময় ‘নিরাপত্তার জন্য স্হায়ী বাসস্হান হিসেবে গণভবনে থাকবেন’ শব্দগুলো অন্তর্ভুক্ত করে। সেইসঙ্গে ‘গণভবনের সব অবকাঠামোগত সুযোগ-সুবিধা যেমন এসএসএফ নিরাপত্তা, টেলিফোন, গাড়ি, আয়া, বয়, বাবুর্চিসহ অন্যান্য সুবিধাদি থাকবে’ শব্দগুলো অন্তর্ভুক্ত করে নেয়। ২০ জুন সংসদে এই আইন পাস করে নেয়া হয়। এই আইনের সুত্র ধরেই শেখ হাসিনা মাত্র এক টাকা মুল্য নির্ধারণ করে গণপুত্র অধিদফতর থেকে সম্পুর্ণ গণভবন এলাকার সব পর্যায়ের স্হাপনাসহ ভবনটি নিজের নামে রেজিষ্ট্রি করিয়ে নেন।
ওই বছর ৬ জুলাই শেখ হাসিনা বার্তা সংস্হা ইউএনবিকে দেয়া এক বক্তব্যে তার গণভবন নিজের নামে লিখে নেয়ার যৌক্তিকতা তুলে ধরে বলেন, ‘আমি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ৫ বছর এই গণভবনে বসবাস করে আসছি। ভবিষ্যতে দেশে থাকতে হলে আমাকে এই গণভবনেই থাকতে হবে।’ শেখ হাসিনা গণভবন নিজের নামে লিখে নেয়ার পাশাপাশি তার ছোট বোন শেখ রেহানাকেও ধানমন্ডি এলাকায় গণপুর্ত অধিদফতরের নিয়ন্ত্রণাধীন একটি বিশাল সরকারি বাড়ি রেজিষ্ট্রি করিয়ে দেন।
হাইকোর্টে মামলাঃ ২০০১ সালের ১৫ জুলাই শেখ হাসিনার ক্ষমতা ছাড়ার দুদিন পর ১৭ জুলাই হাইকোর্টে একটি মামলা দায়ের করা হয়। মামলার এজাহারে উল্লেখ করা হয়েছে, দেশের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সঙ্গে জড়িত এই গণভবন। বর্তমানে এই ভবন ও এর আশপাশের জমির মুল্যও হাজার কোটি টাকার ওপরে। শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী হিসেবে এ সম্পদের সংরক্ষণ করার জন্য শপথ নিয়েছেন। কিন্তু তিনি সেই শপথ ভঙ্গ করে প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার অপপ্রয়োগ করে এই হাজার কোটি টাকা মুল্যের এ অমুল্য সম্পদ মাত্র এক টাকা দিয়ে নিজের নামে রেজিষ্ট্রি করে নিয়েছেন। এ ধরনের লুটপাটের নজির বিশ্বে দ্বিতীয়টি নেই। শেখ হাসিনার গণভবন দখল দেশে একটি খারাপ নজির স্হাপন করেছে। ভবিষ্যতে দেশে যিনি প্রধানমন্ত্রী হবেন, পছন্দ হয়ে গেলে তিনি হয়তো বঙ্গভবনটিই তার নিজের নামে লিখে নেবেন। শেখ হাসিনা সংবিধানের ২৭, ২৯, ৩১ অনুচ্ছেদ এবং ৪র্থ তফসিলের ২(এ) অনুচ্ছেদ লংঘন করেছেন। একই সঙ্গে শেখ হাসিনা ১৯৭২ সালের গণপ্রতিনিধিত্ব অধ্যাদেশের ৯১(ই) ধারা লংঘন করেছেন। বিচারপতি সৈয়দ জে আর মোদাচ্ছির হোসেন ও বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্টের একটি ডিভিশন বেঞ্চে এ মামলার শুনানি অনুষ্ঠিত হয়। সংবিধানের ১০২ ধারার ক্ষমতাবলে জনস্বার্থে দায়ের করা এ মামলার বাদীর পক্ষে শুনানি করেন ব্যারিষ্টার মওদুদ আহমদ এবং শেখ হাসিনার পক্ষে শুনানি করেন ওই সময়ের এটর্নি জেনারেল মাহমুদুল ইসলাম। উভয়পক্ষের শুনানি শেষে হাইকোর্ট তার আদেশে উল্লেখ করেছেন যে, ‘জাতির জনকের নিরাপত্তা আইন-২০০১ এবং শেখ হাসিনার নামে গণভবন বরাদ্দ কেন অবৈধ, বেআইনি ও এখতিয়ার বহির্ভুত বলে ঘোষণা করা হবে না’-এই মর্মে আগামী ২ সপ্তাহের মধ্যে শেখ হাসিনা, গণপুর্ত সচিব, স্বরাষ্ট্র সচিব, প্রতিরক্ষা সচিব ও আইন সচিবকে তার জবাব দিতে হবে।
৮ বছর ধরে নিষ্পত্তির অপেক্ষায় মামলাটিঃ দুই সপ্তাহের মধ্যে গণভবন দখলের বিরুদ্ধে মামলার রুলের জবাব দেয়ার নির্দেশ থাকলেও শেখ হাসিনা এর জবাব দেননি। এ মামলাটি নিষ্পত্তির উদ্যোগও তিনি নেননি। ২০০১ সালের ১৬ আগষ্ট শেখ হাসিনা গণভবন ছাড়েন। পরে অষ্টম জাতীয় সংসদে ‘জাতির জনকের পরিবারের সদস্যদের নিরাপত্তা আইন-২০০১’ বাতিল করা হয়। তবে গণভবনের বরাদ্দ এখনো শেখ হাসিনার নামেই রয়েছে বলে গণপুর্ত অধিদফতরের একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন। শেখ হাসিনা গণভবনের দখল ছেড়ে দিয়েছেন, এ বিষয়টি গণপুর্ত অধিদফতর কিংবা হাইকোর্টকে অবহিত করা হয়নি। ফলে হাইকোর্টে মামলাটি এখনো বিচারাধীন। শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মামলার ভবিষ্যৎ সম্পর্কে সুপ্রিমকোর্টের প্রখ্যাত আইনজীবী অ্যাডভোকেট এম তাজুল ইসলাম বলেছেন, প্রচলিত বিধান অনুযায়ী হাইকোর্ট কোনো মামলায় রুলনিশি জারি করলে পরবর্তীতে এটি নিষ্পত্তির জন্য যে কোনো একটি পক্ষকে আদালতে আবেদন করতে হয়। আবেদন না করলে এটি কার্য তালিকার বাইরে পড়ে থাকে। যখনই আবেদন করা হবে তখনই তা শুনানির জন্য উত্থাপিত হবে। শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে গণভবন দখল মামলাটিও একই প্রকৃতির। এই মামলায় যেহেতু বাদীর উদ্দেশ্য ছিল গণভবনকে অবৈধ দখলমুক্ত করা, সেটি ইতোমধ্যেই হয়ে গেছে। এখন শেখ হাসিনাকেই নিজের অবস্হান ব্যাখ্যা করার জন্য হাইকোর্টের দেয়া রুলের নিষ্পত্তির উদ্যোগ নিতে হবে। এখানে বাদীর উদ্যোগ নেয়ার কিছু নেই। যতদিন পর্যন্ত এটি নিষ্পত্তি না হবে ততদিন পর্যন্ত ধরে নিতে হবে ‘অফেস ইজ কমিটেড’। অন্যকোনো আইন বা যে কোনো কিছুর বিনিময়েই গণভবন দখলমুক্ত হোক না কেন, রুলের নিষ্পত্তি না হলে শেখ হাসিনা আজীবন গণভবন দখলকারী হিসেবেই আইনের দৃষ্টিতে বিবেচিত হয়ে আসবেন।
The Daily Amardesh, ২২ December 2008
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে ডিসেম্বর, ২০০৮ রাত ১:২০

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




