১.
কোন কিছুতে মন বসছে না। অনেক কাজ জমে আছে, কিন্তু করার কোন তাগিদ পাচ্ছি না। কেমন যেন স্যাঁতস্যাঁতে হয়ে আছে মনের আঙ্গিনা। যেন আজব একটা ঘোরের মধ্যে আছি। আজকাল নতুন করে একটা বাজে নেশা জন্মেছে। রাত বাড়লে ব্যাল্কনিতে চেয়ার পেতে বসে থাকি, মেঘের আড়াঁলে লুকিয়ে পড়া চাঁদটাকে আঁতিপাতি করে খুঁজি। আমার মনের কোণেও বোধহয় মেঘ জমেছে।
২.
আমার ব্যাল্কনি থেকে বাইরের চারপাশটা অদ্ভূত সুন্দর মনে হয়। সামনে মর্নিংসাইড পার্ক, যদিও আমার চোখে ছোটখাটো একটা বন। বনের ভেতরে একরাশ নুড়ি-পাথর বুকে করে একটা পুঁচকে-ঝর্ণা দাড়িয়ে আছে। আর একপাশে ঘাড় উচু করে চাইলে- অন্টারিও লেক, বিকালবেলার চুপসে যাওয়া আলোয় ওটাকে দারুণ নীলচে দেখায়। গত ক’মাস অবশ্য বারান্দায় দাড়ালে কেমন শুন্য লাগতো, গাছগুলো সব ন্যাড়া ছিল; এখন রঙ লাগতে শুরু করেছে। লাল, সবুজ, হলুদ, কমলা, গোলাপী, এমনকী সাদা পাতার গাছও আছে অনেকগুলো। তাকিয়ে থাকলে চোখে ধাঁধা লেগে যায়। বিকেলবেলাটা সু্যোগ পেলেই এখানে কাটাই, অবশ্য সু্যোগ খুব বেশি মেলে না। আজকাল সময়রেখাও কমার্শিয়ালিজমের বাইরে নয়। খুব গুণে গুণে খরচ না করলে খেই হারিয়ে ফেলি।
৩.
আজ একটা বিরক্তিকর ক্লাশ ছিল, দায়সারা ভাবেই ক্লাশ শেষ করে বেড়িয়ে খানিকক্ষণ ডান্ডাস স্কোয়ারে দাঁড়িয়ে ছিলাম। এক জাপানী তরুণ অজানা কতগুলো বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে মাঝে মাঝে বোল তুলছিল। রোদে পোড়া গায়ের রঙ, অনেকটা রেড ইন্ডিয়ান বা মঙ্গোলিয়ানদের মতো মুখের আদল। বাজনা শেষে নিজের কথা বললো, সুরের নেশায় দেশ বিদেশে ঘুরে বেড়ায়। তবে প্রচলিত যন্ত্র সঙ্গীতে না, বরং তার আগ্রহ প্রাচীন এবং ঐতিহ্য-অনুরাগী বাদ্যযন্ত্রে। মালি, আফ্রিকা, চায়না, থাইল্যান্ড, আরো কতগুলো দেশ ঘুরে ঘুরে ওদের দু’য়েকটা করে বাদ্য বাজাতে শিখেছে। এটাকেই বোধহয় passion বলে, ভালো বাংলাটা মনে পড়ছে না, আজকাল নিদারুণ অভাব বোধ করছি এর।
৪.
গত দু’দিন একটা বই পড়ছি, কাইট রানার, আফগান লেখক খালেদ হোসেইনির লেখা। শুনেছি, এটার উপর নাকি একটা চলচ্চিত্রও হয়েছে। আমির আর হাসান, দুই ভিন্ন গোত্রীয় আফগান কিশোরের পাশাপাশি বেড়ে ওঠার গল্প। এখনো বেশি দূর যাওয়া হয়নি, তবে ভালো লাগছে। হোসেইনিকে বেশ প্রভাবশালী লেখক মনে হয়েছে, আস্তে আস্তে পাঠককে তার চিত্রপটে নিয়ে যান। বাসে বসে পড়ছিলাম, খেয়াল করিনি কখন আমার গন্তব্যস্থল ছাড়িয়ে বেশ দূরে চলে এসেছি। নিজের উপর বিরক্ত হয়ে বাস থেকে নেমে অপেক্ষা করছিলাম ফিরতি বাসের জন্য। মজার একটা ব্যাপার চোখে পড়লো। বেশ দূর থেকে একটা শিশু সাবলীল চপলতায় তার প্যারাম্বুলেটরটা ঠেলে নিয়ে আসছে, পেছনে বোধহয় তার বাবা। কোন কারণ ছাড়াই ভালো লাগলো। যতক্ষণ না চোখের আড়াল হয় তাকিয়ে ছিলাম।
৫.
ল্যাপটপটা কোলের উপর নিয়ে আবারো ব্যাল্কনিতে বসে আছি। ইচ্ছে তারা গুনবো, কিন্তু সে সু্যোগ হচ্ছে না। এখানে আকাশে তারা চোখে পড়ে না, কালেভদ্রে দেখতে পেলেও তাতে কোন সুখ পাইনা। ভরা পূর্ণিমাতেও রাতের আকাশটাকে খুব নিঃস্ব মনে হয়, ভার্সিটির কফির দোকানের পাশে দাড়িয়ে থাকা ঐ জীর্ণবসন ভিখিরীর মতো। বাতাসে সেই মৃদু সুবাস খুঁজি, মরীচিকা ছোবার নেশায় ইন্দ্রিয় বারবার মিছে চেষ্টা করে যায়। মাঝে মাঝে বৃষ্টির জন্য তৃষ্ণার্ত কাকের মতো চেয়ে থাকি, বড় বড় ফোটার নিচে দাঁড়িয়ে সিক্ত হতে ইচ্ছে করে। তারপর ইচ্ছের প্রলাপগুলোকে ছাইচাপা দিয়ে উঠে যাই, অপূর্ণতাকে সঙ্গী করে।
৬.
কিছুক্ষণ আগে একটা এস,এম,এস পেলাম বাংলাদেশ থেকে, ইমরান পাঠিয়েছে, “দোস্ত, কি করছিস? ফ্রি থাকলে চল ঘুরে আসি, সেই আগের মতো গন্তব্যহীন ভাবে দু’জন টুকটাক গল্প করতে করতে হাটবো। তারপর মোড়ের হোটেলটায় বসে দু’কাপ চা, আর সমুচা। এবারের বিলটা কিন্তু তুই দিবি। দোস্ত মনে পড়ে তো?” গলাটা কেমন যেন ধরে আসে, নিজের অজান্তেই মুঠোফোনের ছোট্ট স্ক্রীণের উপর ক’ফোটা পানি গড়িয়ে পড়ে। ঝাপসা চোখে তাকিয়ে থাকি, অস্ফুট স্বরে বলি, মনে পড়ে বন্ধু, মনে পড়ে...... বন্ধুত্বের সংগাটা ওর কাছ থেকেই রপ্ত করেছিলাম, সময়ের পাল্লায় ১৪ বছর গড়িয়ে গিয়েছে, আজো ভুলতে দেয়নি।
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে মে, ২০০৯ সকাল ৮:১৬

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




