পাথরঘাটা প্রাইমারী স্কুল তখন লম্বা টানা দালানে ছিল, যার দুপাশে দুটো করে চারটি শ্রেণীকক্ষ, আর মাঝখান থেকে একটু ভেতরে অফিসকক্ষ এবং ক্লাস ফাইভের অপেক্ষাকৃত ছোট রুমটি। অফিসের সামনের জায়গাটিতে গেটফুলের মাচা, স্যারদের সাইকেল রাখার জায়গা। স্কুলের সামনে খোলা আঙিনা, অনতিদূরে ঝাকড়া আমগাছ, দুটো তালগাছ আর বাঁদিকে বলফিল্ড।
তখন স্কুলের সামনে টিফিনের সময় আইসক্রিম, কটকটি আর চিট বিক্রি হতো। আইসক্রিমের দাম ছিল চারআনা করে, দুধমালাই আটআনা। কটকটি অনেকটা চানাচুরের মতো স্বাদ, গোলাকার কয়েলের মতো। আর চিট হলো বেশ বড় গোলাকার কেকের মতো শক্ত একরকম মিঠাই, যা কেটে কেটে বিক্রি করা হতো।
আমরা বাঘমার্কা চারআনা বা লাউ কুমড়ো মার্কা আটআনা পেতাম বাড়ী থেকে। টিফিনের সময় তাই প্রায়শ চিট খাওয়া হতো।
আমাদের স্কুলের কোন ড্রেস ছিল না। নিতান্তই গরীব ছিল অধিকাংশ গ্রামের মানুষ। অনেক ছাত্ররা লুঙ্গি পরে ক্লাসে আসতো। ছেলেমেয়ে একসাথের ক্লাস। এখন মনে হয় মেয়েরা যেন কেমন পরিণত ছিল আমাদের থেকেও, হয়ত গ্রামীন পরিবেশ, বাড়ীতে মা-চাচীদের তাগিদ আর পরামর্শ তাদের বয়সের চেয়েও বড় করে তুলেছিল। এমন হলো যে আমাদের ক্লাসের অধিকাংশ মেয়ে আর হাইস্কুলে গেল না, তাদের ফাইভে থাকতেই বিয়ে হয়ে গেল!
ছেলেদের মধ্যে অনেকেই হাইস্কুলে ভর্তি হলো না। তাদের কেউ কেউ নামে মাত্র ঝাউডাংগা হাইস্কুলে ভর্তি হলো , তবে ঐ সিক্স সেভেন পর্যন্ত।
তবে, প্রাইমারীর দিনগুলো যতটা মনে পড়ে খুব মুখর আর আনন্দের সময় ছিল। একটা লোহার ঘন্টা ছিল অফিসের সামনে টানানো। একদিন আমি তখন মনে হয় ক্লাস থ্রিতে পড়ি, আমাকে পরীক্ষার সময় স্যার একটা ঘন্টা বাজাতে বলে আমি ভুল করে তো ছুটির ঘন্টা বাজিয়ে দেই! আহা, কি সব স্মৃতি!
রকিব স্যার ছিল খুব রাগী। চোখে সানগ্লাস পরে আসতেন। সমাজপাঠ পড়াতেন। একটু ভুল হলেই বেতের ব্যবহার করতেন। সে বড় সাংঘাতিক শাসন। ঘরচালা স্যার কানের গোড়ায় চড় মারতেন, উনি বাংলা ক্লাস নিতেন। হাতের লেখা খাতায় একটি টিকচিহ্ন ছিল উনার সাইন। উনার সাইকেলটি ছিল একেবার বেল ব্রেকহীন।
মালেক স্যারের কথা মনে পড়ে। প্যান্ট শার্ট পরে আসতেন, একটু ভারী শরীরের। আর পান্জাবী পরা লাষ্ট স্যার, আমি খুব বেশি দিন উনাকে পাইনি। আকবর স্যারের কথা আগেও বলেছি। গফুর স্যার, হেডস্যার আব্দুল বারী। তার আগের রাজেন্দ্র হেডস্যার। আর একজন ছিলো বুড়ো স্যার। উনি ছিলেন মনে হয় হিন্দু ব্রাক্ষণ সম্প্রদায়ের। একটি চাদর গায়ে দিয়ে আসতেন। একদম সিনেমার পন্ডিত মশাইদের আদলে।
মাঝে মাঝে স্কুলের সেই অবায়ব মনে পড়ে। মাচা জুড়ে গেটফুলের সমাহার। গরমের ঝিরঝির বাতাসের ভেতর টিফিনে ছুটছি চিটওলার দিকে, গামছা দিয়ে চিট ঢাকা।চারআনার চিট দাঁত দিয়ে কামড়াতে কামড়তে কোমরের হাফপ্যান্টের হুক ঢিলা করা।
সেই সময় আসবে না।
(চিট আর কটকটির ছবিগুলো অনলাইন থেকে সংগ্রহ করা।)
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে মে, ২০২৩ রাত ১২:১৮