ব্রিটিশভক্ত ও মুসলিমবিদ্বেষী বঙ্কিমচন্দ্র চট্রোপাধ্যায়ের আসল রূপ !
সাম্প্রদায়িকতা তৈরি করলো কারা? তৈরি হলো কি ভাবে? কেন? প্রশ্নগুলির উত্তর পেতে গেলে আমাদের বারবার পিছনে ফিরে তাকাতেই হবে। ব্রিটিশ শাসনে কোলকাতা কেন্দ্রীক বর্ণ হিন্দু সাহিত্যিকদের রচনায় মুসলিম বিদ্বেষ ও সাম্প্রদায়িকতার বিষ ছড়িয়ে দেয়, সাম্প্রদায়িকতা চর্চার এই ধারাবাহিকতা ‘সাহিত্য চর্চার’ নামে এখনো চলছে।
কলকাতার মার্কসবাদী গবেষক সুপ্রকাশ রায় তাঁর লেখা ভারতের কৃষক বিদ্রোহ ও গণতান্ত্রিক সংগ্রাম তৃতীয় সংকলন কলকাতা ১৯৮০ বইতে লিখেছেন:
“ যে সময় মুসলমানরা ইংরেজ বিরোধী সংগ্রামে ব্যস্ত সেই সময় বঙ্কিম হিন্দুদের মুসলমান বিদ্বেষে ইন্ধন যোগাইয়া ভারতে সাম্প্রদায়িকতার বীজ বপন করিয়াছেন।“
ঠিক একই রকম কথা বলেন ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির শুরুর দিকের নেতা কমরেড মুজাফফর আহমদ, তাঁর মতে,
“বঙ্কিম চন্দ্র চট্রোপাধ্যায়ের ‘আনন্দ মঠ’ হতে সন্ত্রাসবাদী বিপ্লবীরা প্রেরণা লাভ করতেন। এই পুস্তকখানি শুরু হতে শেষ পর্যন্ত সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষে পরিপূর্ণ।এর মূল মন্ত্র ছিল বন্দেমাতরম গান।“
[আমার জীবন ও ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি, পৃষ্ঠা ২৮]
বাংলাদেশের বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা, স্বাধীনতা যুদ্ধে ঐতিহাসিক ‘চরমপত্র’ ও ‘আমি বিজয় দেখেছি’ বইয়ের লেখক এম আর আখতার মুকুল বলেনঃ
“কোনো রকম লুকোচুরি না করে বঙ্কিম চন্দ্র তাঁর রচিত আনন্দ মঠ উপন্যাসে সুস্পষ্ট ও দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলেছেন যে, এদেশ সম্পূর্ণ ভাবে ইংরেজদের পদানত হওয়ার ফল শুভ হতে বাধ্য । কারণ একটাই এবং তা হচ্ছে এই যে, ইংরেজরা এদেশে না আসলে সনাতন ধর্মের ( হিন্দু ধর্ম ) বিজয় কেতন উড্ডীন সম্ভব হতো না ।“
[এম আর আখতার মুকুল, কোলকাতা কেন্দ্রীক বুদ্ধিজীবী, ২৫১]
কলকাতার মার্কসবাদী লেখক সুপ্রকাশ রায় বলেনঃ
“বঙ্কিম বুঝাইতে চাহিয়াছেন যে, মুসলমান শাসনে হিন্দু ধর্ম বিনষ্ট হইয়াছিল, কিন্তু ইংরেজ শাসন তাহা পুনরুদ্ধার করিবে এবং তাহা জয়যুক্ত হইবে।যে সময় মুসলমানরা ইংরেজ বিরোধী সংগ্রামে ব্যস্ত সেই সময় এইভাবে তিনি হিন্দুদের মুসলমান বিদ্বেষে ইন্ধন যোগাইয়া ভারতে সাম্প্রদায়িকতার বীজ বপন করিয়াছেন।” [ভারতের কৃষক বিদ্রোহ ও গণতান্ত্রিক সংগ্রাম,তৃতীয় সংকলন,কলকাতা ১৯৮০]
“শতবর্ষের ফেরারি বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়” প্রবন্ধে সাহিত্যিক ও সাহিত্য সমালোচক ও আহমদ ছফা বলেনঃ
“বঙ্কিম ছিলেন আধুনিক বাংলা তথা ভারতের সর্বপ্রথম রাষ্ট্রবেত্তা।তিনিই সর্বপ্রথম একটি হিন্দু রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখেছিলেন”।… বাঙালি সমাজে বঙ্কিমচন্দ্রের প্রভাব সর্বাধিক ক্রিয়াশীল হতে পেরেছে, তার মুখ্য কারণ বঙ্কিম রচিত সাহিত্য গ্রন্থের অনন্যতা নয়, বঙ্কিমের রাষ্ট্রচিন্তা। মনে রাখতে হবে বঙ্কিমের মৃত্যুর প্রায় সত্তুর বছর পরে তাঁর রচিত ‘ সুজলং সুফলং মলয়জ শীতলং বন্দে মাতরম’ গানটি ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের দলীয় সঙ্গীত হিসেবে গৃহীত হওয়ার গৌরব অর্জন করেছিলো”
[আহমেদ ছফা,আহমেদ ছফার প্রবন্ধ,স্টুডেন্ট ওয়েজ,দ্বিতীয় সংস্করণ, ২০০০, পৃষ্ঠা ১৯]
এই প্রসঙ্গে আবদুল মওদুদ সাহেব বলেনঃ
“বঙ্কিম রক্ষণশীল হিন্দু সমাজ মনের প্রতিভূ হিসাবে এবং হিন্দু জাতীয়তা মন্ত্রের উদগাতা ঋষি হিসাবে বাংলার সাহিত্যাকাশে আবির্ভূত হয়েছিলেন। তীব্র সাম্প্রদায়িকতার যে বিষবহ্নি তিনি ছড়িয়েছিলেন লেখনি মুখে, জগতের ইতিহাসে আর দ্বিতীয় নজীর নেই। তিনি মানবতার যে অকল্যাণ ও অসম্মান করেছেন, পৃথিবীর ইতিহাসে তারও তুলনা নেই। ‘রাজ সিংহ’ ও ‘আনন্দ মঠ’ উপন্যাস দুটিতে তিনি মুসলিম বিদ্বেষের যে বিষবহ্নি উদগীরণ করেছেন, সে বিষ জ্বালায় এই বিরাট উপমহাদেশের দু’টি বৃহৎ বৃহৎ সম্প্রদায়ের মধ্যে যেটুকু সম্প্রীতির ফল্গুধারা প্রবাহিত ছিল, তা নিঃশেষ শুষ্ক ও নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিল। উপমহাদেশের মুসলমানদের অস্তিত্ব বঙ্কিমচন্দ্র অস্বীকার করে তাদের বিতাড়িত করে সদাশয় বৃটিশ জাতির আবাহনে ও প্রতিষ্ঠায় বার বার মুখর হয়ে উঠেছিলেন।”
[আবদুল মওদুদ,মধ্যবিত্ত সমাজের বিকাশ, সংস্কৃতির রূপান্তর, পৃষ্ঠা ৩৩৯]
বঙ্কিমের এই সাহিত্য রবীন্দ্রনাথ প্রত্যাখ্যান করেননি। বরং একে ‘জাতীয় সাহিত্য’ বলে অভিহিত করে মুসলমানদের সমালোচনার জবাবে তিনি বলেছিলেন, “মুসলমান বিদ্বেষ বলিয়া আমরা আমাদের জাতীয় সাহিত্য বিসর্জন দিতে পারি না। মুসলমানদের উচিত নিজেদের জাতীয় সাহিত্য নিজেরাই সৃষ্টি করা।”
[‘মুসলিম জননেতা নবাব নওয়াব আলী চৌধুরী একটি বক্তৃতায় মুসলিম বিদ্বেষপূর্ণ সাহিত্য বন্ধের প্রতি রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টি আকর্ষন করলে, “ভারতী পত্রিকা’য় রবীন্দ্রনাথ এই মন্তব্য করেন।]
উপরে উল্লিখিত বিখ্যাত ব্যক্তিদের কথার সত্যতা প্রমাণের জন্য আনন্দ মঠ উপন্যাস থেকে উদ্ধৃতি দেয়া যাক। বঙ্কিম চন্দ্র লেখেনঃ
“সেই এক রাত্রের মধ্যে গ্রামে গ্রামে নগরে নগরে মহাকোলাহল পড়িয়া গেল। সকলে বলিল, “মুসলমান পরাভূত হইয়াছে, দেশ আবার হিন্দুর হইয়াছে। সকলে একবার মুক্তকণ্ঠে হরি হরি বল |” গ্রাম্য লোকেরা মুসলমান দেখিলেই তাড়াইয়া মারিতে যায়। কেহ কেহ সেই রাত্রে দলবদ্ধ হইয়া মুসলমানদিগের পাড়ায় গিয়া তাহাদের ঘরে আগুন দিয়া সর্বস্ব লুঠিয়া লইতে লাগিল। অনেক যবন নিহত হইল, অনেক মুসলমান দাড়ি ফেলিয়া গায়ে মৃত্তিকা মাখিয়া হরিনাম করিতে আরম্ভ করিল, জিজ্ঞাসা করিলে বলিতে লাগিল, “মুই হেঁদু ” ।“
[আনন্দমঠ, চতুর্থ খণ্ড, প্রথম পরিচ্ছেদ, ৭৯]
“দলে দলে ত্রস্ত মুসলমানেরা নগরাভিমুখে ধাবিত হইল।…..সমস্ত লোক সমস্ত রাত্রি জাগরণ করিয়া কি হয় কি হয় চিন্তা করিতে লাগিল। হিন্দুরা বলিতে বলিতে লাগিল, “আসুক, সন্ন্যাসীরা আসুক, মা দুর্গা করুন, হিন্দুর অদৃষ্টে সেই দিন হউক।” মুসলমানেরা বলিতে লাগিল, “আল্লা আকবর! এতনা রোজের পর কোরাণসরিফ বেবাক কি ঝুঁটো হলো ; মোরা যে পাঁচু ওয়াক্ত নমাজ করি, তা এই তেলককাটা হেঁদুর দল ফতে করতে নারলাম। দুনিয়া সব ফাঁকি।” এইরূপে কেহ ক্রন্দন, কেহ হাস্য করিয়া সকলেই ঘোরতর আগ্রহের সহিত রাত্রি কাটাইতে লাগিল ।“ (উপরোক্ত সূত্র)
” তখন বড় কোলাহল হইতে লাগিল। কেহ চীৎকার করিতে লাগিল, “মার, মার, নেড়ে মার |” কেহ বলিল, “জয় জয়! মহারাজকি জয়।” কেহ গায়িল, “হরে মুরারে মধুকৈটভারে!” কেহ গায়িল, “বন্দে মাতরম্!” কেহ বলে–“ভাই, এমন দিন কি হইবে, তুচ্ছ বাঙ্গালি হইয়া রণক্ষেত্রে এ শরীরপাত করিব?” কেহ বলে, “ভাই, এমন দিন কি হইবে, মসজিদ ভাঙ্গিয়া রাধামাধবের মন্দির গড়িব?” কেহ বলে, “ভাই, এমন দিন কি হইবে, আপনার ধন আপনি খাইব?” দশ সহস্র নরকণ্ঠের কল কল রব ……আর মধ্যে মধ্যে সেই সর্বজনমনোরম “বন্দে মাতরম্!”
[ আনন্দমঠ, তৃতীয় খণ্ড, অষ্টম পরিচ্ছেদ, ৬৯]
বঙ্কিম তার লেখা প্রায় সবকটি গালি ‘আনন্দমঠ’ উপন্যাসে মুসলমানদের উদ্দেশ্যে প্রয়োগ করেছে। ‘ম্লেচ্ছ' হতে শুরু করে ‘যবন’ পর্যন্ত। এমনকি প্রাচীনকালে বৌদ্ধদেরকে দেয়া ‘নেড়ে’ গালিটাকেও সে উহ্য রাখেনি। শুধু তাই নয়; তারা ম্লেচ্ছ, যবন, নেড়ে বলা ছাড়াও মুসলমানদেরকে পাষ-আত্মা, পাপিষ্ঠ, পাপাত্মা, দুরাত্মা, দূরাশয়, নরাধম, নরপিশাচ, পাতকী, বানর, এঁড়ে, দেড়ে, ধেড়ে, অজ্ঞান, অকৃতজ্ঞ, ইতর- এ জাতীয় কোনো গালিই দিতে বাদ দেয়নি।
আনন্দমঠে বঙ্কিমে খুবই নির্লজ্জভাবে ইংরেজ শাসনকে বৈধতা দিয়েছেন। উপন্যাসের চরিত্রের মুখে তিনি বলার চেষ্টা করেন ইংরেজ বাঙ্গালীর শত্রু নয় বরং মিত্র।
বঙ্কিম তার আনন্দমঠ, দেবী চৌধুরানী ইত্যাদি উপন্যাসে খুবই সফলতার সাথে তখনকার হিন্দু অভিজাতদের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশের রাজনৈতিক চিন্তাভাবনাকে তুলে ধরতে পেরেছিলেন, যারা ভারতে একটি হিন্দু রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পথ সহজ করতে ব্রিটিশ উপনিবেশিক শাসনকে স্বাগত জানিয়েছিল এবং একই সাথে সার্বিকভাবে মুসলমানদেরকে ক্ষমতাহীন করতে সহায়তা করেছিল। অধিকন্তু, বঙ্কিম এমন একটি হিন্দু রাষ্ট্রের রাজনৈতিক এবং দার্শনিক রূপরেখা প্রস্তাব করেছিলেন, যার মতো একটি রাষ্ট্র ভারতে কায়েম হোক তা আগে থেকেই এ অঞ্চলের ইংরেজি-শিক্ষিত হিন্দু অভিজাতদের একটি অংশ চেয়ে আসছিল। হিন্দু অভিজাত শ্রেণীর সদস্যরা মুঘলদের ধ্বংসাবশেষের উপর দাঁড়িয়ে ব্রিটিশ উত্থানকে সব সময়ই ইতিবাচক হিসেবে মনে করে এসেছে। আর বঙ্কিমচন্দ্র এই চিন্তাকে তত্ত্বগত ভিত্তি দেয়ার চেষ্টা করেছেন।
১৮৮৮ সালে ‘ধর্মতত্ত্ব’তে তিনি লিখেছেন
‘স্বাধীনতা কোনো স্থানীয় ধারণা নয়; এটা ‘লিবার্টি’ এর অনুবাদ হিসেবে ইংল্যান্ড থেকে এসেছে। ‘স্বাধীনতা’র মানে এই নয় যে, রাজাকে বাধ্যতামূলকভাবে স্থানীয় কেউ হতে হবে। অনেক সময় স্থানীয় রাজাও স্বাধীনতার শত্রু হতে পারে। আবার কোনো বিদেশী রাজাও হতে পারে স্বাধীনতার বন্ধু।’
[বঙ্কিমচন্দ্র চট্টপাধ্যায়, ধর্মকথা, বঙ্কিম রচনাবলী: সাহিত্যসমগ্র, তুলি-কলম, কলকাতা, ১৩৯৩ বাংলা, পৃষ্ঠা ৬০৯]
সে সময়ের মুসলিমবিদ্বেষী হিন্দু অভিজাতদের সবচেয়ে প্রভাবশালী বুদ্ধিবৃত্তিক প্রতিনিধি বঙ্কিম কোনো দ্বিধা ছাড়াই স্বীকার করেছেন:
”মুসলিম শাসনের পর যখন ব্রিটিশরা শাসক হল তখন হিন্দুরা নীরব থাকলো। বাস্তবে হিন্দুরাই ব্রিটিশদেরকে শাসনভার গ্রহণ করতে ডেকে নিয়ে এসেছিল। হিন্দু সৈন্যরা ব্রিটিশদের পক্ষ হয়ে (মুসলমানদের বিরুদ্ধে) লড়েছে। সৈন্যরা তাদের নিজেদের হিন্দু রাজ্যকে ইংরেজদের হাতে তুলে দিয়েছে। কারণ, ব্রিটিশদের ‘বিদেশী’ পরিচয়ের ব্যাপারে হিন্দুদের মনে কোনো বিদ্বেষ ছিল না। ভারত ব্রিটিশদের শাসনের প্রতি পূর্ণ আনুগত্যশীল থাকবে।“ ( একই সূত্র)
#From Facebook Post
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই জুলাই, ২০১৮ রাত ১:০৬