
বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছর প্রচুর পর্যটক আসেন ভারতে। তাদের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক প্রথমে আসেন কলকাতায়। মূলত তিন ধরনের লোক এসে থাকেন। একদল অসুস্থ, তারা ডাক্তার দেখাতে আসেন। আরেকদল ব্যবসায়ী ,তারা বিভিন্ন পণ্য নিয়ে যেতে আসেন। তৃতীয় দল আসেন ঘুরতে। ভ্রমণ বিলাসী এই মানুষ রা সুযোগ পেলেই চলে আসেন কলকাতায়। দীর্ঘদিন ধরে কলকাতায় থাকায় বাংলাদেশ থেকে কেউ আসলে আমার সাথে যোগাযোগ করেন। আমার ও ভালো লাগে, দেশের মানুষের সাথে সময় কাটানো যায়, আড্ডা দেয়া যায়। তরুন বা যুবক বয়সীদের অনেকেই যারা ঘুরতে আসেন তারা মদ্যপানের প্রতি একটু বেশি আগ্রহী হয়ে থাকেন। আশপাশের পরিবেশই আসলে তাদের আগ্রহী করে তোলে।
২০১৩ সালের নভেম্বর মাস। সবে দূর্গা পুজো শেষ হলো। পূজোর ছুটিতে বাংলাদেশ গিয়েছিলাম। ছুটি শেষে কলকাতায় ফিরছি। সাধারণত যাতায়াতের সময় প্লেনেই যাই তবে ট্রেনেও যাওয়া হয়। সেবার ট্রেনে আসছিলাম। ট্রেনেই পরিচয় হয় তিনজনের সাথে। রাব্বি, সুমন ও অনিক তিনবন্ধু। তিনজনে একসাথে ঘুরতে যাচ্ছে। ওদের মধ্যে রাব্বি ও সুমন গল্পপ্রেমিক , অনিক একটু লাজুক। ওদের সাথে ভালোই খাতির জমে গেল। কলকাতা গিয়ে ওদের হোটেল ঠিক করে দিয়ে এসেছিলাম। বিকেলে ওদের সাথে দেখা করতাম। খুব একটা সময় দিতে পারতাম না। কিন্তু ওরা সবসময়ই যোগাযোগ করত। ওরা যেহেতু এবারই প্রথম এসেছে তাই ফোন করে বিভিন্ন বিষয় জেনে নিত।
একদিন শনিবার সন্ধ্যায় আমাকে ফোন দিল ওদের হোটেলে যাওয়ার জন্য। শনিবার বিকেলে খুব একটা কাজ থাকে না তারপরো পরদিন হলিডে , তাই চলে এলাম হোটেলে। হোটেলে এসে বুঝলাম কেন আমাকে এত জোর করে নিয়ে এল। হোটেলে গিয়েই দেখি ওরা কি যেন ফুসুর ফুসুর করছে, এ ওর দিকে তাকাচ্ছে। কিছু বলতে চাচ্ছে কিন্তু কেউ বলতে পারছে না। লাজুক ছেলে অনিকের তো গালই লাল হয়ে গেছে লজ্জায়। আমি কিছুটা অনুমান করতে পারলাম ওরা কি বলতে চাচ্ছে। আমার অনুমানই সত্য হলো । অবশেষে সুমন মুখ খুলল। লাজুক কণ্ঠে বলল যে ওরা বারে বা নাইট ক্লাবে যেতে চায়। আমার এখানে অতিথি হয়ে এসেছে তারা তাই তাদের কথা ফেলতে পারলাম না। নিয়ে গেলাম পার্ক স্ট্রীটের এক নামকরা নাইট ক্লাবে।
মদের গন্ধে চারপাশ ভরপুর। জোরে গান বাজছে আর মেয়েরা ডিসকো ডেন্স করছে। এসব দেখে তো ওরা স্তব্ধ। লাজুক ছেলে অনিক আড় চোখে মেয়েদের দিকে তাকাচ্ছে। আমার চোখে চোখ পড়তেই লজ্জায় মুখ লাল হয়ে গেল ওর। শুরু হলো মদ্যপান। ওরা ওয়াইন প্রেফার করল। আমিও ওদের সাথে যোগ দিলাম। ওরা তো একেবারে অনভ্যস্ত। কিন্তু ভালোই নাচছে তিনজন। আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ওদের নাচ দেখছি। মদের নেশা সেই সাথে নাচ। তাই মাতাল হতে আর ওদের বেশি সময় লাগলো না। নাচতে নাচতে তিনজন যে কোনদিকে গেল কাউকে খুঁজে পাচ্ছিলাম না। সুমন কে খুঁজে পেলাম কিন্তু আর দুজন কে খুঁজে পাচ্ছি না। হঠাত দেখলাম অনিক মাতাল অবস্থায় এক মেয়ের কাঁধে মাথে রেখে দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে। মেয়েটা শিশার নেশায় উন্মাদ। কিছুক্ষণ পর পর অনিকের গালে চুমু দিচ্ছে। অনিকের সে দিকে হুঁশ নেই। ও একেবারে ঘোর মাতাল। সুমন বলল, ইশ আমি থাকলে মেয়েটাকেও একটু চুমু দিতাম। এই বলে ও অনিক কে টেনে সরাতে গেল। আর অমনি সুমনের গালে এক থাপ্পড় বসিয়ে দিল ঐ মেয়ে। সুমন ও আরেকটু হলে হাত তুলতে যাচ্ছিল ,আমি ওকে আটকালাম। মেয়েটা আমাদের সামনে থেকে চলে গেল। অনিককেও সাথে করে নিয়ে গেল, দেখে মনে হচ্ছিল অনিক যেন ওর বয়ফ্রেন্ড। ইশ, বেচারা অনিকের যদি হুঁশ থাকত তাহলে হয়ত লজ্জায় ওর সর্বাঙ্গ লাল হয়ে যেত।
আরো কিছুক্ষণ থাকলাম, বুঝলাম আর থাকা যাবে না। অনিকের কোন হুঁশ নেই, সুমন পুরো মাতাল। ও শুধু চিৎকার করে বলছে, পাখি আমি তোমায় ভালোবাসি।পরে জেনেছিলাম এই পাখি মেয়েটা কে তা ও নিজেই জানে না। মদের নেশায় অবচেতন মনে কার নাম বলেছে তা মনে নেই। বেরিয়ে যাব কিন্তু রাব্বির কোন দেখা নেই। পরে দেখি এক জায়গায় মেয়েরা গোল করে নাচছে। আর ওদের মাঝে রাব্বি নাচছে। বেশ ভালোই গোল আসর বসিয়েছে। অতটা মাতাল হয় নি ও। ওকে পরে আমার ভীষণ কাজে লেগেছিলো। কারণ আমি আর রাব্বিই কেবল স্বাভাবিক ছিলাম কিন্তু বাকি দুজনেই ঘোর মাতাল। যাইহোক অনেক কষ্টে ওদের সামলে ট্যাক্সিতে তুলেছিলাম। কিন্তু রাস্তায় একেকজন কি করেছে তা ভাষায় প্রকাশের নয়। অনিক ট্যাক্সিতেই প্রস্রাব করে দিয়েছিল। ভাগ্যিস ট্যাক্সি চালক দেখে নি। ফেরার পথে সুমনের চেঁচা মেচিতে এক পুলিশ সার্জেন্ট রাস্তায় আমাদের আটকে জিজ্ঞাসাবাদ করছিল। পুলিশ অফিসার বলছিল এত মাতাল হয়ে কোথায় ফিরছেন? আমি কিছু বলার আগেই সুমন কেঁদে উঠল। সেই হাউমাউ কান্না। কাঁদছে আর বলছে, "স্যার আমাকে পাখির কাছে নিয়ে যান। আমি পাখিকে ভালোবাসি। " পুলিশ অফিসার ও হেসে দিলেন। ভালো মানুষ ছিলেন উনি। ট্যাক্সি চালককে আমাদের সাবধানে হোটেলে নামিয়ে দিতে বলে চলে গেলেন। হোটেলে গিয়েই ওদের বমি শুরু। পুরো হোটেল হইচই পরে গিয়েছিলো ওদের কারণে। অনেক কষ্টে সামলাতে হয়েছে ওদের। সেদিনই পণ করেছিলাম বাংলাদেশ থেকে কেউ বেড়াতে আসলে আমি আর তাদের আগে পিছে নেই। যদিও সেই পণ বেশি দিন রাখতে পারি নি।
চলবে....
[সংবিধিবদ্ধ সতর্কীকরণঃ আমাদের দেশে সামাজিক ও ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে মদ্যপান সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। কাউকে মদ্যপানের প্রতি আসক্ত করে তোলা আমার লেখার উদ্দেশ্য নয়। আমার ব্যক্তিগত জীবনে ঘটে যাওয়া কিছু ঘটনা শেয়ার করাই আমার উদ্দেশ্য।]
সল্টলেক, কলকাতা
৩ ডিসেম্বর, ২০১৫
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা ডিসেম্বর, ২০১৫ রাত ১১:২১

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




