নারীর সমঅধিকার শব্দটা আমার কাছে কিছুটা ঘোলাটে। আমি ঠীক বুঝে উঠতে পারি না এটার ধারা কিসের অধিকারের কথা বলা হয়।
সেদিন তুমুল ঝগডা হল; নারীর অধিকার নিয়ে। স্বাভাবিক ভাবেই নারীদের সাথে। তাদের তুমুল যুক্তি পুরুষরা নাকি সুযোগ পেলেই মেয়েদের গায়ে হাত দেয়, মেয়েদের ঠকায় এবং আমাদের দেশে তাদের পিছিয়ে পডার জন্য নাকি আমরা মানে পুরুষরা দায়ী। ভাগ্যিস বেগম রোকেয়া অনেক আগেই মারা গেছেন তা না হলে আমাদের মেয়েদের অবস্থা দেখে উনি বিষ খেয়ে মরতেন। শরৎ বাবু একটা কথা বলেছিলেন “অধিকার কেউ কাউকে দেয় না অধিকার আদায় করে নিতে হয়ে”। আমি যতদুর জানি বেগম রোকেয়া ও তাই চেয়ে ছিলেন। অধিকারটা আদায় করে নেয়া। আজ শরৎ বাবুও নেই বেগম রোকেয়াও নেই কিন্তু আমাদের মেয়েদের নিজের অধিকারের জন্য অন্যের উপর দোষ চাপানো এখনো আছে। যেটা তখনো ছিল। উদহারন দিচ্ছি, সংসারের সমস্যা। স্বামী স্ত্রীর কথা বন্ধ। একদিন, দুইদিন পরেই পাশের রুম থেকে চিকন গলার নাকি কান্নার শব্দ আসবে। কান্নার মাঝখানের লিরিক শুনতে শুনতে হয়ত আপনারই হার্টফেল হতে পারে। আপনাকে বিয়ে করে নাকি তিনি তার জীবনের চরম ভুল করেছেন। আপনি তাকে বিয়ের পর থেকে এক বিন্দু শান্তি দেননি। এই না দেয়ার লিষ্টটা বড হতে থাকবে আর আপনার হার্টবিট বাডতে থাকবে।
পাবলিক বাসের সিট নিয়ে আমাদের এক নারীবাদী কলিগ খুবি উত্তেজিত। বাসের সিট বিন্যাস নিয়ে হঠাৎ করে তেলেসমাতি কারবার। ডানপাশের নয়টি সিট শিশু/প্রতিবন্ধি/মহিলাদের জন্য বরাদ্দ। যার মাথা থেকে এই গোবর বের হয়েছে সে একবারেও চিন্তা করলো না যে এটা করে মেয়েদের ঠকানো হয়েছে। অনুপাত হিসাবে মেয়েদের ৫০% আসন দাবি আদায় করার দরকার সেখানে কিনা নয়টাতেই সন্তুষ্টি। নারী আন্দোলনের নেত্রীরা তৃপ্তির ঢেকুর তুলতে পারেন, যাক আমাদের তো অনেক অধিকার হল।
পাবলিক পরিবহন যে কি জিনিস তা সবাই বুঝেনা। হয়ত আপনি তাল গাছ এক পায়ে দাডিয়ে কোনোমতে নিজের ইজ্জত বাচাচ্ছেন, পাশের প্রৌঢা হুঙ্কার দিয়ে উঠবেন একটু সরে দাডান এরকম গায়ে উঠে যাচ্ছেন কেন। আসে পাশের সবাই ভাববে আপনি ইচ্ছে করে ওই প্রৌঢার গায়ে উঠে উনাকে রেপ করার চেষ্টা করছেন।বাধ্যহয়ে আপনাকে হয় উটপাখি হতে হবে অথবা রেলিং এর উপর ঝুলে ঝুলে যেতে হবে। ঠিক উল্টোটা চিন্তা করেন; একজন প্রৌঢা ৫০% আপনার গায়ের উপর দাডিয়ে গজ গজ করছেন “কেন কেউ তাকে বসার সুযোগ দিচ্ছে না; যতসব বেয়াদপের দল” এবং পুরোটা পথই উনি গজ গজ করতে থাকবেন। আর একটা উদহারন দিচ্ছি, আপনি হয়ত রিকশা করে যাছেন, দেখলেন যে আপনার পাশের রিকশার মেয়েটার ওডনা আর একটু পরে রিকশার চাকার সাথের বেধে যাবে। আপনি সৌজন্যবশত ডেকে উনাকে তা বললেন। উনি এমনভাবে আপনার দিকে তাকাবেন যেন আপনি একটা হ্যাংলা, আপনার পারসনালিটি বলে কিছু নেই আর আপনি খারাপ নজর নিয়ে উনার ওডনার দিকে তাকিয়েছেন।
আমার এক কলিগের উচু আওয়াজের যুক্তি আমাদের দেশে ছেলেরা সুযোগের অভাবে চরিত্রবান। মানতে পারলাম না। একটা মেয়ের জন্মের পর থেকে বিয়ের আগ পর্যন্ত তার আসে পাশের মানুষ বিশেষকরে তার মা তাকে এটাই শেখায় যে ছেলে মানেই খারাপ, সুযোগ সন্ধানি। একটা মেয়ের বিশ্বাসের ভিত আরো প্রবল হয় যখন সমাজের নিচু কিটদের কিছু খারাপ কাজের খবর খবরের কাগজে পাওয়া যায়। আসলেই কি তাই। না এটা করে মেয়েদের অন্ধ বানানো হচ্ছে। ছেলে মাত্রই যদি সুযোগের অভাবে চরিত্রবান হয় তাহলে তো সব ছেলের চরিত্রই খারাপ। তারমানে প্রত্যেকটা মেয়ের কাছে তার বাবা খারাপ, ভাই খারাপ, বন্ধু খারাপ, শিক্ষক খারাপ। নাকি তাদের ভালো খারাপের ব্যাবধানটা শিখানো দরকার ছিল। যাতে তারা বুঝতে পারে।
যাই হোক সমঅধিকারে ফিরে আসি। সমঅধিকারটা খুব বেশী দরকার মৌলিক অধিকারগুলোতে। একজন মেয়ের সবগুলো মৌলিক অধিকার পাওয়ার দাবি রাখে। তাকে তার সব মৌলিক অধিকার দিতে হবে যাতে সে বুঝতে পারে, বলতে পারে, আদায় করে নিতে পারে। এই মৌলিক অধিকারগুলো যে আমাদের সমাজ আমাদের মেয়েদের দিচ্ছে তাও না। বংশপরস্পরায় মেয়েরা ধরেই নিয়েছে এটা তাদের নিয়তি সুতরাং তাদের মৌলিক অধিকার নিয়ে কথা বলা তাদের মানায় না। সেদিন একটা বই পডলাম। ইয়েমেনের এক দশ বছরের বাচ্চার গল্প। সত্যি গল্প। ইয়েমেন হচ্ছে খোডা ধর্মীয় লেবাসে বন্ধি একটা দেশ। এই দশ বছরে তার বাবা তাকে বিয়ে দিয়েছে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে। মেয়েটি বুঝতে পেরেছিল তার অধিকার হরণ করা হয়েছে। সে শুধু তার স্বামীর নামেই নয় সে তার বাবার নামেও মামলা করেছিল। ইয়েমেনের ইতিহাসে সেই সর্বকনিষ্ট মেয়ে যে তার স্বামীকে ডির্ভোস দিয়েছে। অধিকার কিন্তু সে আদায় করেই নিয়েছে।
আমাদের অফিসের পিছনে কনস্টাকশনের কাজ চলছে। লেবারদের চিৎকার চেচামেচিতে আমি মাঝে মাঝে অস্থির হয়ে যাই। শাবলের ঘ্যাত ঘ্যাত শব্দে সেদিন উকি দিলাম। ষোলোজনের মত নারী শ্রমিক কাজ করছে। পুরুষদের সাথে সমান তালে কাজ করছে। শাডীর আটপোরে নিজেদের বেধে রাখেনি কিংবা পাশের লোকের সাথে ধাক্কা লাগবে বলে ঘরে বসে থাকেনি। উঠে এসেছে। বুক চিতিয়ে লডছে। কোদালের তীক্ষ কোপ দিয়ে তুলে আনছে অধিকার। কখনো হয়ত পিছলে যাচ্ছে হাত তারপরও ক্ষান্ত দেয়নি। শাবলের ভোতা মাথায় তুলে এনেছে জীবনের অধিকার, বেচে থাকার অধিকার, সমঅধিকার আর ঘ্যাত ঘ্যাত করে জানিয়ে দিচ্ছে তাদের যারা আরামে বসে অধিকার অধিকার বলে চিৎকার করে।
যতদিন না আমাদের মেয়েরা বুঝতে পারবে যে অধিকার তাদের আদায় করে নিতে হবে ততদিন তারা জীবন নিয়ে গজ গজ করবে, নিজের অদৃষ্টকে দুষবে আর হিন্দি সিরিয়ালের জীবনকে নিজের জীবন ভেবে মায়াকান্না করেই যাবে।

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




