পাপা দোল দিবে। দোল দেয়া মানে পায়ের উপর রেখে পা দোলানো। আমার বাচ্চার বয়স এখনো তিন হয়নি। কিন্তু আহ্লাদিতে ষোল আনা। সে আমার পায়ের দোল ছাড়া রাত্রে ঘুমাতে পারে না। এই বদ অভ্যাসটা তার মা শিখিয়েছে। দোল দেয়ার পূর্বে সে আমাকে হাগ দিবে তারপর পাপ্পা দিবে। আমি হয়ত দুই গালে পাপ্পা নিয়ে তাকে শোয়ালাম সে চেঁচিয়ে উঠবে পাপ্পা কপালে দিব, কপালে দিব। মেয়ে পায়ের উপর নিয়ে আমি হয় ফেসবুকিং করি অথবা একটা বাবল সু্ট্যার বলে অখাদ্য এক গেম আছে সেটা খেলি। কিন্তু গত কিছুদিন ধরে আমি না পারছি ঠিক মত ফেসবুকিং করতে না পারছি গেম খেলতে। মাথায় বিভিন্ন দুশ্চিন্তা। আমি শঙ্কিত। না আমাকে কেউ হত্যার হুমকি দেয়নি বা আমার বড় ধরনের কোন অসুখও ধরা পড়েনি। আমি শঙ্কিত আমার মেয়ের ভবিষ্যৎ নিয়ে। যে দেশে আমার মেয়ে বড় হবে সে দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে।
আজ সকালে ফেসবুকে ঢুকে দেখলাম কোন এক পেজ থেকে শেয়ার করা হয়েছে খুবি অদ্ভুত একটা ছবি। যেখানে লেখা "দেশ আজ বিভক্ত, আপনি কার পক্ষে? শাহবাগ চত্বর, নাকি মতিঝিল চত্বর। আসলেই কি দেশ বিভক্ত? নাকি বিভক্তির চেষ্টা করা হচ্ছে। নিজে কখনো এভাবে চিন্তা করিনি। নিজের যুক্তির কাছে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করলাম কে ঠিক?
বাংলাদেশের ৮৫% মানুষ মুসলমান। এই দেশের মানুষ যথেষ্ট ধর্মভীরু। এদের আপনি সহনশীল মুসলমান বলতে পারেন। আপনি চাইলেই এমন কিছু বলতে পারেন না যা তাদের ধর্মের মুলে আঘাত করবে। চাইলেই আপনি এমন কিছু লিখতে পারেন না যা তাদের ধর্মবিশ্বাসের ভিতকে নাড়িয়ে দেবে। দুঃখের বিষয় হচ্ছে দিনের পর দিন এমন কিছু হিংসাত্মক, উগ্র, অস্বাভাবিক লেখা হয়েছে যেটা প্রকাশিত হলে সাধারণ মানুষদের মাঝে ধর্মীয় উন্মাদনা ছড়াতে বাধ্য। বাক স্বাধীনতাকে পুঁজি করে কাউকে আক্রমণ কখনো সভ্য হতে পারে না। এটা তাদের বোঝা উচিত ছিল যারা এই হিংসাত্মক, উগ্র এবং অস্বাভাবিক লেখাগুলো লিখেছিলেন। অবশ্য দোষ দেয়ার চেয়ে বলা উচিত ওই লেখকদের বোঝার ভুল ছিল।
এ দেশে ধর্মীয় মানুষের যেমন অভাব নেই ঠিক তেমনি ধর্ম ব্যবসায়ীরও অভাব নেই। এরা সবসময় চায় এমন কিছু যাকে পুঁজি করে এরা এদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে পারে। আমাদের ব্লগাররা বস্তুত সেই পরজীবী ধর্ম ব্যবসায়ীদের সাহায্য করেছেন। সাহায্য করেছেন যখন তাদের অস্তিত্ব প্রশ্নের সম্মুখীন তখন তাদের ঘুরে দাড়াতে। ধর্মীয় আবেগপ্রবণ মানুষ চেয়েছে সমস্যার সমাধান। তাদেরকে দেখানো হল, বোঝানো হল তারা যা চেয়েছে তাতো তারা পাবেই না বরং তাদের দাবিকে উপেক্ষা করে অন্যায়কে সমর্থন করা হচ্ছে। গুটিকয়েক কিছু ব্লগারের হিংসাত্মক লেখাগুলো যখন ধর্ম ব্যবসায়ীদের দ্বারা মিডিয়ায় আসা শুরু করেছিল তখনো আমাদের ব্লগ নেতৃবৃন্দ সহনশীল হওয়ার তাগিদ বোধ করেননি। তাগিদ বোধ করেননি পরবর্তী পদক্ষেপ নির্ধারণে। ওনারা তর্কের খাতিরে তর্ক চালিয়ে গেছেন। প্রমাণ করতে চেয়েছেন যা লেখা হয়েছে তার সবি ঠিক আছে। ধর্মীয় আবেগকে উপেক্ষা করে বস্তুত এটাকে উস্কে দেয়া হয়েছে। সেই উস্কানির চূড়ান্ত করেছে ধর্ম ব্যবসায়ীরা। আমাদের দূরদর্শিতার অভাবেই ৬ই এপ্রিল এত বড় শো-ডাউন হল। এখনো আমরা দূরদর্শিতা দেখাতে পারছিনা। আমরা উস্কে দিচ্ছি এই ধর্মীয় আগুন আরও প্রকট করে।
শাহবাগের আন্দোলন যে দাবিতে শুরু হয়েছিল তার প্রতি আমাদের মত সাধারণ মানুষের সমর্থনের কোন কমতি ছিল না। মানুষ যারা সারা জীবনে মিছিল সমাবেশ উপেক্ষা করেছিল তারাও গিয়েছিল সমর্থন করতে। এই গন জোয়ারের স্রোত দেখে আমাদের কর্মপন্থা ঠিক করা দরকার ছিল। আমাদের উচিত ছিল যে দাবিতে আমাদের আন্দোলন শুরু হয়েছিল তার প্রতি আস্থা রাখা। আমরা তা পারিনি। আমদের নেতৃবৃন্দের উচিত ছিল নাস্তিকতা নামের যে ময়লা তাদের দিকে ছোড়া হচ্ছে তা পরিষ্কার করে সামনে আগানো। সেটাতো তারা করতে পারেননি বরং সে ময়লা পুরো গায়ে মাখিয়েছেন। আমাদের বোঝা উচিত জোঁকের মুখেই লবণ দিতে হয় অন্য কোথাও না। হেফাজতে ইসলামের যে প্রধান দাবি ছিল তা যদি আমাদের নেতৃবৃন্দ মেনে নিতেন তাহলে পানি এতদূর গড়াত না। ব্লগার যারা ধর্মকে কটাক্ষ করে লিখেছিল তাদের আইনের আওতায় এনে বিচারের ব্যবস্থা করা। এটা যদি করা হত সেটা শাহবাগ আন্দোলনের জন্যে যেমন ভাল হত, ভাল হত ব্লগে মুক্ত চিন্তা প্রকাশে। ব্লগারদের দেখা হত সমাজ পরিবর্তনের অগ্রদূত হিসাবে।
হুজুররা যে আন্দোলন করছেন। তাদের সব দাবি শুধু অযৌক্তিক না অন্যায়ও বটে। নিশাত মজুমদার ও তাসফিয়া নাজনিনরা মাউন্ট এভারেস্ট জয় করেছে। এটা ছেলে খেলা না। এরা আমাদের দেশের পরিবর্তনের অগ্রদূত। নিজ নিজ কর্মক্ষেত্রে এরকম অগ্রদূত লাখে লাখে আছে। এদেরকে চাইলেই ঘরে রাখা যাবে সে তা আপনি যত ধর্মের দোহাই দেন না কেন। ভাস্কর্য আমাদের স্বাধীনতার প্রতীক। এটা ভাংতে চাইলে আপনাদেরই একটা বিশাল গোষ্ঠী আপনাদের সামনে দাঁড়িয়ে যাবে। আমাদের সংবিধান যে পরিমাণ কাটাছেঁড়া করা হয়েছে তাতে আবার নতুন করে ধর্মীয় শাসন ব্যবস্থার কথা লিখতে গেলে গেলে কাটা গাঁয়ে নুন দেয়ার মতই লাগবে। আপনারা আরও যুক্তিসংগত ভাবে এক দফা নিয়ে এগুনো দরকার ছিল। সেই এক দফা কি? ব্লগার যারা ধর্মকে কটাক্ষ করে লিখেছিল তাদের আইনের আওতায় এনে বিচারের ব্যবস্থা করা। এটা যদি করা হত তবে ধর্মীয় মূল্যবোধ আরও সমৃদ্ধ হত আর সরকার এই দাবি সহজেই মেনে নিত।
এখন লেজে গোবরে অবস্থা। দুই পক্ষই কেউ কাউকে বিশ্বাস করতে পারছে না। সবাই নিজ নিজ পক্ষকে শক্তিশালী দেখাতে গিয়ে এমন এক ধম বন্ধ পরিবেশ তৈরি করেছেন যে সামনের দিনগুলোর কথা ভাবতেই ভয় হয়। দেশের কথা, পরবর্তী প্রজন্মের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে দুপক্ষের উচিত নিজেদের সামলানো। গ্রহণযোগ্য কারো উচিত সমঝোতা করা। সরকারকেই রাজনীতির বাইরে গিয়ে উদ্যোগী হতে হবে।
আজ থেকে ২৫ বছর পরে আমার মেয়ে আমার পায়ে দোল খাবে না। কিন্তু আপনি, আমি, আমরা যাতে পা দোলাতে দোলাতে বলতে পারি আমাদের দেশটা রাজাকার মুক্ত, সাম্প্রদায়িকতা মুক্ত, ধর্ম ব্যবসায়ী মুক্ত, মুক্ত চিন্তার দেশ। আমাদের সন্তানরা যাতে সেই মুক্ত বাতাসে নিশ্বাস নিতে পারে।

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




