ছোট বেলায় আমি খুব ইচড়েপাকা ছিলাম। মা-খালারা বলেন আমি নাকি কখনো হাটতাম না, শুধু দৌড়ে ছুটতাম। আনুমানিক ক্লাস টুতে পড়া অবস্থায় আমার পাকামোটা এতই বেড়ে গিয়েছিল যে, বাবার পিটুনী না খেয়ে ভাত খাবার সুযোগ হতোনা। মা একটু সবসময় আমাকে লুকিয়ে রাখতেন। কিন্তু বাবা কোন নালিশ শুনলেই আমাকে বিভিন্নভাবে শাস্তি দিতেন। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে লঘু পাপে গুরুদন্ড পেতাম আর কি। এখন বড় হয়ে বুঝি যে বাবার ঐ সময়োপযোগী শাসান বারণ আমাকে একজন মানুষের মত মানুষ হবার ভীত গড়েদিয়েছিল। যার কারণে আজ আমি জীবনে একটা ভাল সময় অত্রিক্রম করতে পারছি। ঐ বয়সে আমার অনেকগুলো খেলার সাথী ছিল যাদের সকলের বর্তমান অবস্থান অজানা বা অদেখা। আমি যে গ্রামে বড় হয়েছি সে গ্রামের নাম গোপালগঞ্জ জেলার ঐতিহ্যবাহী গ্রাম চন্দ্রদিঘলিয়া। আমাদের বাড়ীটা বেশ বড় থাকায় লোকজনও বেশি। তাই আমার খেলার সাথীদের কোন অভাব হতোনা।
আমি এতটাই ইচড়েপাকা ছিলাম যে বাবাকে এবং আমার সেজ আপাকে বলতাম যে আমি একবারে ক্লাস টুতে উঠবো। আমার জন্ম হয়েছিল আমার বাবা-মায়ের পর পর চারটি কন্যা সন্তানের পর। তাই স্বভাবতই আমার একটু কদরও বেশি ছিল। বাবা রাগ করলে আমি ভাত খেতে চাইতাম না কিন্তু বাবার ধমক খেয়ে আবার খেতে বাধ্য হতাম। যাহোক বাবা আমাকে নিয়ে স্কুলে ভর্তি করতে গেলে আমার সাইজ দেখে স্কুলের প্রধান শিক্ষক বললেন ওকে আদর্শলিপির বই কিনে দাও। সে সময় আমার ক্লাস ফাইভের কবিতা পর্যন্ত ঠুঠস্থ ছিল। আমি নাছোড় ছোকড়া, স্যারের কথায় রাজি না হয়ে ক্লাস টুতে ভর্তি হতে চাইলাম। বাবা তখন বললেন যে, আচ্ছা মাস্টারসাব তাহলে ওকে অনের বই দেন। আমি তাতেও রাজি হলাম না। তখন স্যার আমাকে আদর করে হাতে থাকা বেত দিয়ে আলতো করে একটু পিটুনি দিলেন। এসব ঘটনা যেহেতু মনে রাখতে পেরেছি, তারমানে বুঝতেই পারছেন যে কতটা ইচড়ে পাকা ছিলাম আমি। যাহোক শেষমেস স্যার আমাকে একটি কক্ষে নিয়ে গেলেন এবং আদর্শলিপির বিভিন্ন বর্নমালা, বানান, কার, ফলা ইত্যাদি জিজ্ঞেস করলেন। পটপট করে সকল প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছিলাম আর স্যারের প্রতি রাগ হচ্ছিলাম। এরপর স্যার ক্লাস অনের বাংলা বই পড়তে দিলেন তাও মুখস্থ। এর পরে ক্লাস টু এর বইয়ের ছড়া/কবিতা জিজ্ঞেস করলেন। সব পটাপট বললাম। এরপর আমাকে না দেখে একটা ছড়া লিখতে বললেন। লিখে ফেললাম। তখন আমি স্যারকে বললাম, স্যার আমি ক্লাস ফাইভের কবিতাও বলতে পারি। স্যার বললেন বলতো কোনটা পারো। আমি এক নিশ্বাসে রবীন্দ্রনাথের নীল নবঘনে আষাঢ় গগনে পড়ে দিলাম। স্যারতো থ হয়ে গেলেন। শেষ পর্যন্ত আমাকে ক্লাস টু'তে ভর্তি হতে দিলেন। টেস্ট পরীক্ষাতে দ্বিতীয় হলাম। ফাইনাল পরীক্ষাতে প্রথম হয়ে ক্লাস থ্রিতে উর্নীত হলাম। যাহোক যেকথা বলতে গিয়ে আমার ইচড়ে পাকামোর গল্প বলতেছিলাম তার কিছুটা হলেও সকলকে জানানো দরকার।
আমরা বিভিন্ন প্রকার খেলার আয়োজন করতাম। যেমন, সিন্দুক টোকাটুকি, চি বুড়ি, গোল্লাসুট, মোরগ লড়াই, পুথিবাড়ী, মার্বেল, সাত চাড়া, চাড়া, লুকোচুরি, বুদ্ধিমন্তর, পুতুল বিয়ে, বিয়ে বিয়ে ই্ত্যাদি। সবাইকে একটু হলেও আন্ন্দ দেবার জন্য আমার ছোট্ট বেলার বিয়ে বিয়ে খেলা সম্পর্কে কিছু বলা যেতে পারে যার উদ্দেশ্যে এই ব্লগ লিখছি। আমার খেলার সাথীদের বেশিরভাগই ছিল মেয়ে। প্রায় ১১জনতো হবেই। এদের সবাইকে আমি ছোট্ট বেলায় একেক জনকে অনেকবার বিয়ে করেছি। যারা একটু বড় ছিল তারা এই বিয়ে সাদীর আয়োজন করতেন। খড় আর কাঞ্চি দিয়ে কুড়ে ঘর তৈরী করা হতো বা লাউ গাছের নিচে কিছু খড় দিয়ে বাসা বানানো হতো। যেখানে বিয়ের পরে বউ কচুরী পনার কই মাছ, ইদুরের মাটির ভাত, আর পোড়া মাটি গুলিয়ে ডাল রান্না করতো। আমার বিয়ের পরের কাজ হলো চাকুরী করা। তখন চাকুরী করার মানে ছিল বউয়ের রান্না খাবার খেতে হলে অনেক টাকা পয়সা আয় করতে হবে। আতা ফল গাছের পাতা দিয়ে একশত টাকার নোট থেরী করতাম। আ কাগজের টুকরা দিয়ে ৫০০টাকার নোট বানিয়ে অনেকগুলো একসাথে নিয়ে বউয়ের রান্না থেকে যেতাম। গিয়ে দেখতাম শাপলাফুলের ভিতরের অংশদিয়ে বৌয়ের কানের দুল তৈরী করা হয়েছে, কলমি আরো নানা রংয়ের ফুল দিয়ে বৌকে সাজানো হয়েছে। তখন বাসর ঘরে একা যাবার কোন নুযোগ ছিলনা। সবাই একসাথে বাসর ঘরে যেতাম আর মিছামিছি খাবার খেয়ে ইমমম অনেক মজা অনেক মজা বলা প্রসংশা করতাম। হঠাৎ মা অথবা বাবা ডাক দিলে বউটউ সব রেখে বাড়ি দৌড়াতাম। এরপরে ঐ খেলার সাথীর সাথে কোন বিষয় নিয়ে মনমালিন্য দেখা দিলে একে অপরের সাথে সম্পর্ক ভেঙ্গে দিতাম। তার বৃদ্ধা আঙুল আর আমার বৃদ্ধা আঙ্গুল মিশিয়ে কাটাকাটি করে দিতাম। আবার কখনো সম্পর্ক জোড়া লাগানোর প্রয়োজন হলে দুজনের কানি আঙুল মিশিয়ে চুড়ান্ত করতাম। আবার কখনো কখনো রাগ হয়ে একদিনে আরেকজনকে বিয়ে করে ফেলতাম। এভাবে ছোট্ট বেলায় আমি অনেক বিয়ে করেছি। এই জন্য আমার স্ত্রীকে সবসময় বলি যে, তুমি আমার কত নম্বর বউ তা আমি নিজেও জানিনা।
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে মার্চ, ২০১২ রাত ১১:১১

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




