পড়ন্ত বেলার শেষে অনিমেশ যখন বাস থেকে নামল তখন দুরের মেঘগুলো আরও কাছে চলে এসেছে। সারাদিনের ঘামে ভেজা জামায় এক ঝলক ঠান্ডা হাওয়া এসে ছুঁয়ে গেল একবার। আকাশের দিকে তাকিয়ে মনটা খুশিতে ভরে গেল অনিমেশের। যা অবস্থা, আজ বৃষ্টি না হয়ে যাবে না। সকাল থেকে যা গুমোট দিয়েছে। বৈশাখে মাঝামাঝি এই সময়টায় রোজই বিকেলের দিকে আকাশে কয়েকটা করে মেঘ উকি দিয়ে যায়। সন্ধ্যার কালচে অাকাশে আলোর হালকা চকমকি জ্বালে ওঠে এদিক ওদিক। কিন্তু ঐ পযর্ন্ত্যই। রাত যত গভীর হয়, জ্বলে ওঠা আলোগুলো যেন নিজেদের ছন্দ হারিয়ে ফেলে ক্রমশ। সংঘবদ্ধ মেঘগুলো একসময় নিজেদের মধ্যে হাতাহাতি করে ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে কোথায় যেন চলে যায় উদাস মনে। ঝাপসা চাঁদটা আবার স্ব-মহিমায় ফিরে আসে নিজের জায়গায়।
ইদানিং ছাদের তপ্ত মাটিতে সারাদিনের কমর্ক্লান্ত শরীরটাকে এলিয়ে দিয়ে অনিমেশ এইসবই দেখে। হাতদুটো মাথার পিছনে বালিস করে রাতের গভীর হওয়া দেখা তার বহুদিনের অভ্যাস। ছেলেবেলায় হাতি ঘোড়া কত বিচিত্র জন্তুর নক্সা তৈরী হত এই আকাশের গায়ে। কখনও ঠাকুমার কোলে কখনওবা বাবার কোলে শুয়ে একে একে কত তারা চিনেছিল সে। এখন দৃষ্টিভঙ্গি পালটে গেছে বটে, কিন্তু অভ্যাসটা রয়েই গেছে।
সন্ধ্যা থেকে রোজ নিয়ম করে দু’টি ঘন্টা লোডশেডিং। প্রায় দিনই তা অনিমেশের বাসায় ফেরার আগেই আরম্ভ হয়ে যায়। কোন কোন দিন গায়ের অধের্ক ঘাম শুকোবার সময়টুকু পাওয়া যায়। অন্ধকারে, আন্দাজেই ছাদে উঠে আসে অনিমেশ। বাড়ি ঢোকার মুখে যে মেঘটাকে মাথার ঠিক উপরে দেখেছিল তাকে আবিষ্কার করে বেশ কিছুটা দুরে। কোন কোন দিন আবার এটুকু সময়ের মধ্যে তা হারয়েও যায়।
আজ বোধহয় আর তা হচ্ছে না। ঘন মেঘ ক্রমশ আরও ঘনীভূত হচ্ছে আকাশে। এরা কেউ আর আর ছাই রঙা নয়, ঘন কালো। চোখের সামনে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে থাকা মাল্টিস্টোরিড গুলের ফাঁক দিয়ে অকাশের যতদূর দেখা যায় শুধু মেঘ, মেঘ আর মেঘ।
রাস্তা পেরিয়ে উল্টো দিকের ফুটপাতে আসতে আসতেই অবশ্য অনিমেশের খুশি খুশি ভাবটা মিলিয়ে গেল। হাতে ধরা ব্যাগটায় এখনও তিনটে চিঠি। এই তিনটে ডেলিভারী না করা পযর্ন্ত্য তার ছুটি নেই। শুভঙ্করদার রাগী রাগী মুখটা একবার কল্পনা করলো অনিমেশ। আড়ালে আবডালে তাঁকে সবাই ভয়ঙ্করদা বলে ডাকে। তারা তো কোন ছাড়, ক্যুরিয়র কোম্পানির মালিক স্বয়ং দিবাকর উপাধ্যায় –ও শুভঙ্করদাকে একটু সমঝে চলেন বলে গুজব শোনা যায়। রাগের চোটে ভদ্রলোক নাকি একবার নিজের চশমাই আছাড় দিয়ে ভেঙে ফেলেছিলেন। এবং চশমা বানাতে তিনদিন সময় ‘নষ্ট’ হওয়ার ফল সবাইকে ভুগতে হয়েছিল নতুন চশমা আসার পর। অনিমেশ অবশ্য তখনও এই ন্যাশনাল ক্যুরিয়রে যোগ দেয়নি।
এ অঞ্চলটা মোটামুটি চেনা অনিমেশের। প্রায়ই আসতে হয় এদিকে। যেমন মোড়ের ডানদিকের চারটে বাড়ি ছেড়ে শিকদারবাবুর বাড়ি। কণের্ল ভদ্রলোক। মাসে দু-বার তাঁর বাড়িতে আসতেই হয়, দু’টো ম্যাগাজিন দিতে। তারপর যদুনাথ লেনের শ্রাবন্তী দাসগুপ্ত। কম্পিউটার টিচার। তাঁকেও ম্যাগাজিন দিয়ে যেতে হয়।
ব্যাগের তিনটে চিঠির মধ্যে দু’টো অনিমেশের চেনা ঠিকানা। এঁদেরকেও নিয়মিত চিঠি দিয়ে যায় সে। কেবল তিন নম্বর চিঠিটাই নতুন।
আকাশে মেঘের গজর্ন আরম্ভ হয়েছে। দিনের শেষে পাখিগুলোর মধ্যেও একটা ব্যস্ততা, বোধহয় বাসায় ফেরার তাগিদ। পা চালিয়ে অনিমেশ গন্তব্যের দিকে এগিয়ে গেল।
২৪৩/১২এ, ফণিভূষন সেন লেনে ঢুকতে আরও মিনিট সাতেক সময় লাগলো অনিমেশের। বেশ কিছুটা বাগান পেরিয়ে মূল দড়জার কাছে পৌছাতে হয়। এই রকম একটা অঞ্চলে এই ধরনের বাড়ি প্রায় ভাবাই যায় না। অনিমেশ জানে এই বাড়িতে তিনবার বেল না বাজালে কেউ সাড়া দেবে না। সুশান্ত পাল নামে যাঁর এল আই সি –র চিঠি সে দিতে আসে মাঝে মাঝে, তাকে কোনদিনই দেখেনি অনিমেশ। প্রত্যেকবার এক বুড়ি বেড়িয়ে এসে টিঠি নিয়ে যায়। মনে হয় কাজের লোকই হবে। মিনিট কয়েক বাদে সই করা কাজটা বুড়িই আবার ফেরত দিয়ে যায়। আজও তার ব্যাতিক্রম হল না।
বনলতা এ্যাপাটর্মেন্টে দ্বিতীয় চিঠিটা পৌছে দিয়ে অনিমেশ যখন রাস্তায় নামল, আকাশে ঘন ঘন বিদ্যুৎ চমকানো শুরু হয়েছে। সেই উজ্জ্বল আলোর ক্ষণিক ঝলকানি বলে দিচ্ছে আজ আর রেহাই নেই। গত কদিনে বার বার ভেঙে যাওয়া মেঘেরা যেন একসাথে প্রতিশোধ স্পৃহায় ঝাঁপিয়ে পড়তে চাইছে শহরের বুকে। দূরে কোথাও একটা বাজ পড়ল। আশেপাশের গাছগুলো থেকে একঝাঁক পাখি হঠাৎ উড়ে কয়েক পাক ঘুরে নিল।
এবার গন্তব্য নন্দরাম পালিত বাই লেন। এদিকে এমন কোন রাস্তা আছে অনিমেশ আগে দেখেনি। যাতায়াতের পথে সবকটা রাস্তার নামই সে মনে রাখার চেষ্টা করে। পরে নতুন চিঠির সময় এটা খুব কাজে দেয়। কিন্তু এ নামটা যেন খুবই অপরিচিত লাগলো তার কাছে। খুব মনযোগ দিয়ে চিন্তা করেও মনে করতে পারলো না অনিমেশ। অগত্যা, স্থানীয় কারো সাহায্য নেওয়া ছাড়া উপায় নেই।
দ’জায়গায় নিরাশ হয়ে অনিমেশ যখন কি করবে ভাবছে তখনই পাশে দাঁড়ানো এক ভদ্রলোক হঠাৎ আগ বাড়িয়ে বললেন, ‘নন্দরাম পালিত লেন –এ যাবেন তো?’
মুখ ঘুরিয়ে লোকটাকে এক পলক দেখলো অনিমেশ। রোগা দোহারা গরন। একমুখ কাঁচা-পাকা দাড়ি, কপালে প্রায় ইঞ্চিখানেক একটা কাটা দাগ। হাতে ধরা বিড়িটাতে লম্বা একটা টান দিয়ে লোকটা আবার বলল, ‘নন্দরাম লেন তো?’
‘পালিত’। নামটা শেষ করল অনিমেশ।
‘আরে ঐ হল। সোজা গিয়ে ডানদিকে দেখবেন একটা টাইম কল। পাশ দিয়ে একটা ইটের সরু রাস্তা চলে গেছে দেখবেন।’
‘২/৪ নন্দ………….’
অনিমেশকে থামিয়ে দিয়ে লোকটি বললে ‘ঐ তো মশাই গোটা পনেরো বাড়ি, আর নম্বর ধরে বলতে হবে না। এখানে আর না হেজিয়ে যথাস্থানে গিয়ে একটু ঠক ঠক করুন, ঠিক পেয়ে যাবেন।’ বিড়িটাকে শেষ সুখটান দিয়ে লোকটা আবার বলল, ‘কোত্থেকে আসা হচ্ছে ?’
‘ন্যাশ মানে ক্যুরিয়র কোম্পানি।’
‘ও, তা জান ওখানে গিয়ে খোঁজ করুন। ও রাস্তাটার নাম সবাই জানে না। পাড়াটা প্রায় নতুনই হয়েছে।’
ইচ্ছা না হলেও লোকটার কথা বিশ্বাস করা ছাড়া রাস্তা নেই। এদিকে আকাশের যা অবস্থা, বেশী দেরী করাও ঠিক হবে না। মনে মনে গন্তব্যটাকে একবার পরিষ্কার করে নিয়ে অনিমেশ হাঁটতে শুরু করলো। পেলে ভালো, তা না হলে ঠিকানা পাওয়া যায়নি বলে লিখে দিলেই হবে। কিন্তু মুশকিলটা এখানেই। আজ সে না পেলে নিয়ম অনুযায়ী কাল অন্য কেউ এখানে আসবে। আর সে যদি একবার ঠিকানাটা পেয়ে যায়, আর দেখতে হবে না। শুভঙ্করদা তিন পুরুষ উদ্ধার করে ছাড়বেন।
২/৪ নন্দরাম পালিত লেন খুঁজে পেতে অবশ্য খুব বেশী হল না অনিমেশকে। গলিতে ঢুকে তিনটে বাড়ি পরেই একতলা বাড়ি। বাড়ির নম্বরটা বড় বড় হরফে লেখা দড়জার গায়ে। সামনের গ্রিল ঘেরা বাড়ান্দায় টিম টিম করে একটা কম ওয়াটের বাল্ব জ্বলছে। সেই আবছা আলোকে ম্লান করে বিদ্যুৎ চমকে উঠছে মাঝ মাঝেই।
কলিং বেলটা খুঁজে পেতে একটু সময় লাগলো অনিমেশের। বার দুই সেটা বাজিয়ে রাস্তার দিকে ফিরে তাকালো সে। মেঘের গজর্ন, বিদ্যুতের চমক সমানে চলেছে, কিন্তু বৃষ্টি সেই যে কয়েক ফোঁটা হয়ে বন্ধ হয়ে গেছে, অার কোন উচ্চবাক্য নেই। ভ্যাপসা গরমটা যেন আরও কয়েকগুণ বেড়ে গেছে এই দু’ফোঁটা বৃষ্টিতে। ঘন কালো মেঘগুলো মাথার উপর দিয়ে খুব ধীর গতিতে উড়ে যাচ্ছে। নিজের অজান্তেই একটা দীঘর্শ্বাস বেড়িয়ে এল অনিমেশের বুক ঠেলে। তবে বোধহয় আজও হল না। মেস বাড়ির দশ ফুট বাই দশ ফুটের ঘরটাতে আজও পচে মরতে হবে। আবার ভোরের দিকে সামান্য ঠান্ডা আমেজে ঘুম গাঢ় হবে। আবার উঠতে যথারীতি দেরী হবে, আবার অফিসে দেরী……….
আরও তিন চার মিনিট এইসব অবান্তর কথাই অনিমেশ চিন্তা করল দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে। উল্টো দিক থেকে এখনও কোন সাড়া পাওয়া যায়নি। আশেপাশে কোথাও একটা অজানা ফুলের গাছ রয়েছে বোধহয়। একটা উগ্র গন্ধ হাওয়ায় ভেসে আসছে। কবজিতে বাধা ঘড়িটাতে একবার চোখ বোলাল অনিমেশ। ছ’টা কুড়ি। তার মানে মেসে পৌছাতে আরও ঘন্টা দেড়েক। যদি না এর মধ্যে জোরে বৃষ্টি আরম্ভ হয়। একটু বৃষ্টি হলেই তো গাড়ী কম। লোকের ঠাসাঠাসি, বাঁকা উক্তি, জ্যাম। কথাটা মনে হতেই নিজের মনে হেসে ফেলল অনিমেশ। দুর, আগে বৃষ্টিটাতো হোক। আগে থেকে কিছু ভাবলে সেটা হয়না, অনিমেশ দেখেছে। অন্তত তার জীবনে হয় না এটা সে মনে করে। তা না হলে শমির্ষ্ঠাকে নিয়ে এত কল্পনা, এত স্বপ্ন দেখার পর কী এমন হল যে……..
ভিতর থেকে একটা খুঁট করে শব্দ এসে অনিমেশের চিন্তার রেশটাকে ছিঁড়ে দিয়ে গেল যেন। আরও একবার বেলটা বাজিয়ে দিল অনিমেশ।
কয়েক সেকেন্ড পর অস্ফুট একটা আওয়াজ ভেসে এল, ‘কে ?’
দড়জার ওপার থেকে ভেসে আসা আওয়াজটাকে চাপা দিয়ে খুব জোরেই কোথাও একটা বাজ পড়ল। প্রায় একই সঙ্গে দপ করে নিভে গেল বাড়ান্দায় জ্বলা বাল্বটাও।
যা। নিজের মনেই কথাটা বলল অনিমেশ।
ওপারের ক্ষীণ আওয়াজটা আরও কাছে এসে জানতে চাইল, ‘কে?’
‘একটু খুলবেন, আমি ন্যাশনাল ক্যুরিয়র থেকে আসছি।’ যতটা সম্ভব উঁচু গলায় বলল অনিমেশ।
‘কি ব্যাপারে বলুন তো।’
‘একটা চিঠি আছে। শ্যামল দেবনাথ আছেন?’
দড়জাটা এবার খুলে গেল। একজন ভদ্রমহিলা এগিয়ে এলেন হাতে মোমবাতি নিয়ে। ‘আর বলবেন না। রোজ সন্ধ্যায় এই এক ব্যাপার।’
‘সব জায়গায় একই অবস্থা।’ অনিচ্ছা স্বত্ত্বেও হেসে জবাব দিল অনিমেশ।
‘কিসের চিঠি বলুন তো?’ বাইরের দমকা হাওয়া থেকে মোমবাতির শিখাটাকে আড়াল করার চেষ্টা করতে করতে অন্যমনস্কভাবেই বললেন ভদ্রমহিলা।
‘মিস্টার শ্যামল দেবনাথের নামে আছে। ওরিয়েন্টাল ইনসিওরেন্স থেকে এসেছে।’ চিঠিটাকে উল্টে পাল্টে দেখে বলল অনিমেশ। ‘মিস্টার দেবনাথ……….।’
‘আমরা স্বামী।’
‘উনি কি আছেন?’
‘না তো।’ ভদ্রমহিলা আকাশের দিকে তাকালেন। ‘হবে মনে হয়?’
‘কি?’ বুঝতে পারে না অনিমেশ।
‘বৃষ্টি।’ হাতের মোমবাতিটা এক কোণে পড়ে থাকা টুলটাকে টেনে এসে রাখতে রাখতে বললেন ভদ্রমহিলা।
‘বুঝতে পারছি না। হতে তো ভালই, যা গরম দিয়েছে আজ সারাদিন।’ দায়সারা গোছের একটা উত্তর দিয়ে অনিমেশ কাজের কথায় ফিরে আসে, ‘চিঠিটা তবে আপনি রিসিভ করে নিন।’
কোন উত্তর না দিয়ে ভদ্রমহিলা আকাশের দিকে তাকিয়েই দাঁড়িয়ে রইলেন। বিদ্যুতের চমকের সাথে তার মুখ মাঝে মাঝে উজ্জ্বল হয়ে উঠছে। সেই হঠাৎ আলোর ঝলকানিতে অনিমেশ লক্ষ্য করল, গোল মুখশ্রীতে একটা উদাস ভাব যেন ছুঁয়ে রয়েছে। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম মুক্তোর মতন ছড়িয়ে রয়েছে। দু’এক গোছা চুল হাওয়ার সাথে সেই মুক্তো ছড়ানো কপালে লুটিয়ে পড়ছে। বয়স বড়জোর ত্রিশ হবে। পড়নের নীল হাউসকোটটার উপর চাপান ওড়নার একটা দিক নিজের অজান্তেই মাটিতে লুটিয়েছে হয়ত খেয়াল করেননি।
‘চিঠিটা তবে আপনাকেই দিয়ে যাই?’ প্রশ্নটা আবার করল অনিমেশ।
‘উনি তো এখানে থাকেন না।’
‘মানে?’
‘থাকেন না মানে বোঝেন না?’ ভদ্রমহিলা এবার প্রায় রেগে গেলেন।
‘আসেন তো মাঝে মাধ্যে?’
‘নো স্যার।’
কথাটা বলে ভদ্রমহিলা হেসে উঠলেন শব্দ করে।
‘তাহলে কি হবে?’
‘গো টু হেল। আমি জানি কি হবে?’
‘না মানে আপনার হাজবেন্ড যখন…….. ’ কথাটা শেষ হওয়ার আগেই একটা দমকা হাওয়া এসে মোমবাতিটা নিভিয়ে দিয়ে গেল। বিদ্যুতের আলোয় অনিমেশ লক্ষ্য করলো ভদ্রমহিলার মধ্যে কোন পরিবর্তন এল না। আগের মতই তিনি বাড়ান্দার রেলিং-এ হাত রেখে দাঁড়িয়ে রইলেন।
‘ম্যাম….।’ অনিমেশ আস্তে করে ডাকল একবার।
‘যে রাতে মোর দূয়ারগুলি ভাঙল ঝড়ে………….’ অস্ফুট কন্ঠে গেয়ে উঠলেন ভদ্রমহিলা।
পাগল নাকি রে বাবা। অনিমেশ কি করবে কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না। এ ধরনের অভিজ্ঞতা তার এই প্রথম। কোথায় ভেবেছিল তাড়াতাড়ি ঝামেলা মিটিয়ে বাসায় ফিরবে, তা না।
‘আপনি বোধহয় আমাকে পাগল ভাবছেন তাই না?’
প্রশ্নটা শুনে চমকে উঠলেও নিজেকে সামলে নিয়ে অনিমেশ বলল, ‘তা নয় ম্যাডাম, আসলে আমার একটু তাড়া ছিল ……….’
‘উহু, কল মি শর্মিষ্ঠা।’
নামটা শুনে আরও একবার চমকাল অনিমেশ।
‘কি ব্যাপার চেনা লাগছে নাকি নামটা? ওভাবে চমকে উঠলেন যে? অন্ধকারেও মেয়েরা কিন্তু অনেক কিছু বুঝতে পারে।’ এবার আর আস্তে নয়, অট্টহাসি করে উঠলেন তিনি।
‘ম্যাম, আমার কাজটা হয়ে গেলে আমি বাড়ি ফিরব।’
‘ম্যাম নয়। আগে বলুন শর্মিষ্ঠা।’
পাগল নয়। অনিমেশ বুঝতে পারলো এই সন্ধ্যাতেই ভদ্রমহিলা মদ্যপ অবস্থায় রয়েছে। কথাগুলো এবার আস্তে আস্তে জরিয়ে যাচ্ছে যেন।
‘প্লিজ ম্যা….. সরি শর্মিষ্ঠা, চিঠিটা প্লিজ রিসিভ করে নিন। আমায় অনেক দূর যেতে হবে। বৃষ্টি নেমে গেলে আমরা খুব অসুবিধা হবে।’ অনিমেশ অনুনয়ের সুরে কথাগুলো বলল।
‘হয় না জানেন? রোজ মেঘগুলো ভেসে ভেসে আসে, আবার নিজের খেয়ালে কোথায় চলে যায়। আকাশের বুকে কখনও পাহাড় তৈরী করে, আবার কখনও বা সমুদ্র। সমুদ্রের ঢেউ। এই, আপনি পাহাড় ভালবাসেন না সমুদ্র?’
অনিমেশ আবছা অন্ধকারেই খোলা দড়জার ভিতরে উঁকি দিয়ে অন্য কারো অস্তিত্ত্ব আছে কিনা বোঝার চেষ্টা করছিল। অন্ধকারে কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। ‘পাহাড়।’ অন্যমনস্বভাবেই জবাব দিল সে।
‘আমিও। আমাদের কত মিল তাই না?’ আবার জোরে হেসে উঠলেন তিনি।
‘আর কেউ আছেন?’
‘না থাকলে ভেতরে আসবেন নাকি?’ মুখ বেঁকিয়ে কথাটা বললেন শর্মিষ্ঠা।
কান লাল হয়ে গেল অনিমেশের। কথাটার মধ্যে কিসের ইঙ্গিত তা খুব স্পষ্ট বোঝা যায়।
‘না। থাকলে চিঠিটা তার হাতে দিয়ে আমার ছুটি।’ দৃঢ় গলায় বলল অনিমেশ।
‘বাবা রাগ তো খুব। আপনি রাগ করলেন?’
‘প্লিজ ম্যাডাম মোমবাতিটা জ্বালান। এই কাগজে একটা সই করে আমায় ছেড়ে দিন।’
‘আমায় অনেক দূর যেতে হবে, আমার বাড়ি অনেক দূর, আমায় ছেড়ে দিন। এছাড়া আর কোন কথা আপনি জানেন না?’ এক নিঃশ্বাসে বলে গেলেন শর্মিষ্ঠা।
আকাশের দিকে আরও কয়েক পলক তাকিয়ে থেকে শর্মিষ্ঠা বললেল, ‘দিন।’
‘আলোটা আগে জ্বালান। অন্ধকারে দেখবেন কি করে?’
‘আমি পুরুষ মানুষ কিনা পকেটে সবসময় দেশলাই নিয়ে ঘুরছি। আপনার কাছে আছে?’ গম্ভির গলায় বললেন ভদ্রমহিলা।
‘আমি সিগারেট খাই না।’
‘গুড বয়। কাগজটা তবে দিন, আমি ভিতরে আলো জ্বালিয়ে সই করে আনি।’
চিঠি আর সই করার কাগজ নিয়ে শর্মিষ্ঠা ভিতরে চলে যেতেই অনিমেশ অনুভব করল সে বেশ ঘেমে গেছে। চারপাশে তাকিয়ে বুঝতে পারলো একটা মাঠের মতন অংশে পর পর বাড়িগুলি দাঁড়িয়ে আছে। আশেপাশের সবকটা বাড়িই নতুন। আধুনিক ডিজাইনের অনেক প্ল্যান প্রোগ্রাম মেনে তৈরী করা। এখানে কেউ বোধহয় কারোর খোঁজ রাখে না। এখনকার শহুরে কালচার যা হয়েছে আরকি। তা নাহলে এখানে এতক্ষণ এত কথাবার্তা হল। এত স্নায়ুযুদ্ধ, এত হাসির রোল উঠল কেউ টের পেল না? কাউকে তো বেড়িয়ে আসতে দেখা গেল না। হয়ত বা পেয়েছে। অন্ধকারে কারো কারো উৎসাহী চোখ হয়ত নজর রাখছে তাদের। এমন রগরগে গসিপের সুযোগ কেউ ছাড়ে?’
আবার জোরে জোরে বিদ্যুৎ চমকানো শুরু হয়েছে। মেঘ ডাকছে ঘন ঘন। ঠান্ডা একটা হাওয়া উঠে আবার মিলিয়ে গেল। হাত ঘড়িটাতে চোখ রাখতেই চমকে উঠল অনিমেশ। সর্বনাশ। সাতটা দশ।
আরও মিনিট পাঁচেক এভাবে কেটে গেল। শর্মিষ্ঠার কোন দেখা নেই। অনিমেশ এবার বিচলিত হয়ে উঠল। চিঠিটা যায় যাক, কিন্তু মাতাল মহিলা যদি পিওডি সিটটা ছিঁড়ে ফেলেন তাহলে আর চাকরী থাকবে না।
‘শুনছেন?’ গ্রিলের গায়ে ঝোলানো তালাটা দিয়ে তিনবার ধাক্কা দিল অনিমেশ।
‘আসছি।’ বেশ কিছুটা দুরে থেকে উত্তরটা ভেসে এল।
‘নিন।’ মিনিট খানেক পর বেড়িয়ে এলেন শর্মিষ্ঠা।
‘এটা……….’ অবার চোখে তাকাল অনিমেশ।
‘যা ভাবছেন তা নয়। নির্ভেজাল চা।’
‘আমার কাগজটা?’
‘পাবেন পাবেন। আসুন।’ গ্রিলের তালাটা খুলে দিতে দিতে শর্মিষ্ঠা বললেন।
‘ভেতরে?’ প্রায় আঁতকে উঠল অনিমেশ।
‘কেন আমি বাঘ না ভালুক।’
‘ঠিক তা নয়, আমার তো দেরী হয়ে যাচ্ছে, তাই মানে …………..’ আমতা আমতা করতে থাকে অনিমেশ।
‘আচ্ছা মুশকিল তো। চা কি কেউ রাস্তায় দাঁড়িয়ে খায়। বাইরে যা অন্ধকার, কাপে একটা কিছু পড়লে?’
তর্ক করে নিস্তার নেই বুঝতে পেরে অনিমেশ বাড়ান্দায় উঠে এল। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব চা শেষ করে মানে মানে কাগজটা নিয়ে বেড়িয়ে পড়তে পারলে হয়।
‘এখানে মোমবাতি নিভে যেতে পারে। তখন আবার বলবেন না যেন। তার চেয়ে ভেতরে চলুন। ভয় নেই শুধু ড্রয়িং রুম পর্যন্ত্য, বেড রুমে যেতে বলব না।’ ভ্রু নাচিয়ে কথাগুলো বললেন শর্মিষ্ঠা।
অগত্যা। মদ্যপ মহিলার তালে তাল দেওয়া ছাড়া উপায় নেই দেখে অনিমেশ মুখে কিছু না বলে শর্মিষ্ঠাকে অনুসরণ করলো।
ছোট ঘরটার সোফায় বসে দু-তিন চুমুক নীরবে পান করার পর শর্মিষ্টা হঠাৎ বললেন, ‘আমার স্বামির কথা বলছিলেন না?’
‘অ্যা। না মানে ওনার নামে চিঠি তো তাই উনি নিজে নিলে আমাদের সুবিধা হয় আর কি। তা নাহলে রিসিভারের সঙ্গে কি সম্পর্ক, আরও হেনা তেনা নানা প্রশ্নের উত্তর দিতে হয়। এই আর কি।’
‘আমার সঙ্গে কি সম্পর্ক দেবেন?’
ভারী অদ্ভুত প্রশ্ন। মনে মনে হাসল অনিমেশ। ‘আপনিই তো বললেন আপনার হাজবেন্ড।’
‘যদি মিথ্যা বলি।’ খিল খিল করে হেসে শর্মিষ্ঠা অনিমেশের প্রায় গায়ের কাছে গড়িয়ে পড়লেন।
আবার সমস্যায় পড়ল অনিমেশ। ‘উনি কি তবে আপনার ………….’
‘স্বামী, স্বামী, স্বামী। উনিই আমার প্রাণনাথ।’ হঠাৎই যেন চিক চিক করে উঠল শর্মিষ্ঠার দুটো চোখের কোল।
অস্বস্তিটা ক্রমশই বাড়ছে অনিমেশের। টেবিলের উপর রাখা মোমবাতির ক্ষীণ শিখায় অদ্ভুত মেহময়ী লাগছে শর্মিষ্ঠাকে। তাঁর শরীরের গরম তাপ অনুভব করছে অনিমেশ তার নিজের গায়ে। ঘরের কোথাও রজনীগন্ধা ফুল রাখা আছে নিশ্চই। সেই মাতাল করা গন্ধ যেন হালকাভাবে এসে মিশে যাচ্ছে শর্মিষ্ঠার শরীরে। নিজের ক্ষণিক দূর্বলতাকে এক ঝটকায় কাটিয়ে অনিমেশ উঠে দাঁড়াল।
‘এবার আমি যাব।’
‘যাবে? সত্যিই যাবে?’
‘হ্যা। আমার কাগজটা দেবেন প্লিজ।’
‘ঐ টিবিলের উপর।’ নিজের শরীরটাকে সোফার নরম পাঁকে গুজে দিয়ে শর্মিষ্ঠা আঙুল তুলে দেখালেন।
‘ধন্যবাদ’ তড়িৎ গতিতে কাগজটা তুলে নিয়ে অনিমেশ পা বাড়াল।
‘একটা কথা।’
‘বলুন?’ এক পলক ঘুরে তাকালো অনিমেশ।
‘আমায় বোধহয় খুব বাজে মেয়ে মনে হল, তাই না?’
‘কই না তো?’
‘ঠিক বলছেন? মন থেকে?’
কথার ফাঁকেই অনিমেশ বাড়ান্দার গ্রিল ছাড়িয়ে বাইরে চলে এসেছে। বদ্ধ ঘরের বাইরে আসতেই একঝাঁক ঠান্ডা হাওয়া এসে অনেক কৌতুহল নিয়ে যেন তাকে ঘিরে ধরল।
‘তালাটা লাগিয়ে দিন, বাইরে খুব অন্ধকার।’
কোন লাস্যময়ীর উত্তর পেল না অনিমেশ। রাতের সিগ্ধ বাতাসের বুক চিড়ে কেবল একটা চাপা কান্নার সুর ভেসে এল। আকাশ ভেঙে তখনই প্রবল বেগে বৃষ্টি নেমে ভিজিয়ে দিল অনিমেশকে।

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




