বাঙলাদেশের স্বাধীনতা পৃথিবীর অনেক দেশের মত সফল হয়নি। তারপরও হতাশার মধ্যে সবচেয়ে আশার কথা হচ্ছে আমরা পাকিস্তান নামক অপরাষ্ট্র থেকে বেরিয়ে আসতে পেরেছি। পাকিস্তান মানে ছিল ব্যাপক প্রতিক্রিয়াশীলতা, ধর্মানদ্ধতা, মধ্যযুগিবর্বরতা, গনতন্ত্রহীনতা, স্বৈরাচারিতা, সামরিক অপশাসন; যেগুলোর প্রায় সবকটি বর্তমান পাকিস্তানেও আরো ব্যাপকভাবে বিদ্যমান। তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের মনোভাব ছিল শোষন ও পীড়নমূলক যা পূর্ব পাকিস্তানকে টানা ২৪ বছর বুটের অশ্লীল আঘাতে পিষ্ট করেছে। বুটের অশ্লীল আঘাতে পূর্ব পাকিস্তানকে পিষ্ট করার জন্য পশ্চিম পাকিস্তান কায়েদে আজম, কায়েদে মিল্লাত্ এবং জেনারেলের পর জেনারেল প্রসব করেছে। সেই সকল মহান বীরসন্তানরা নিজের দেশ ভেবে পূর্ব পাকিস্তানকে শুধুমাত্র প্রেম ভালোবাসা দিয়ে তৃপ্ত না হয়ে ৫২' থেকে গুরু করে ৭১' পর্যন্ত যেখানে সম্ভব সেখানেই ধর্ষনের পর ধর্ষন করেছে। সেইসব বীরপ্রেমিকরা পরবর্তীতে দূরদেশে থেকে বুড়ো বয়সে শারিরীক ভালোবাসা দিতে না পেরে তাদের অমর ভালোবাসার স্মৃতিচারণ করে গেছেন। তারা আংশিক সত্য, অধিকাংশ মিথ্যা এবং মাত্রাতিরিক্ত অতিরন্জ্ঞন দিয়ে ধর্ষিত ফুলসজ্জা স্মৃতির যে চারণ ঘটালেন তা গাধাচারণ অথবা অপস্মৃতিচারণ ব্যতীত অন্য কিছু নয়। সেই সকল মহান বীর পুরুষরা (?!) হলেন জেনারেল ফজল মুকিমখান, গুল হাসান, আরিফ, নিয়াজী , ফরমান আলী।
আমাকে যে বইটি পড়ে বিবমিষায় ভুগতে হয়েছে সেটি হচ্ছে চিরশুন্যতায় প্রবেশমান মহান লেখক (!) জেনারেল রাও ফরমান আলী খান - এর হাউ পাকিস্তান গট ডিভাইডেড। বইটির অনুবাদ করেছেন শাহ আহমদ রেজা বাঙলাদেশের জন্ম নামে এবং ভূমিকা লিখেছেন মুনতাসীর মামুন। বইটির ভূমিকায় তিনি বলেছেন পাকিস্তানের যে ক'জন জেনারেলরা তাদের আত্মস্মৃতি লিখেছেন তাদের মধ্যে জেনারেল রাও ফরমানের বইটি গুরুত্বপূর্ন এবং গুনগতভাবে অন্যদের থেকে উন্নত, অন্তত রচনাশৈলী, বিন্যাসের দিক থেকে। এই যদি হয় মহান বীর পুরুষদের মানদন্ড তাহলে তাদের জন্য করুণাই হয়। বইটিতে প্রকৃতপক্ষে কোন ধারাবাহিকতা নাই, যা পাঠ ক'রে পাঠকরা তৃপ্তি পাবে; শুধু তাই নয় ঘটনার পূনরাবৃত্তি, পরস্পরবিরোধী বক্তব্য, সত্য-মিথ্যার আঁধারি, মনগড়া গল্প, আমাদের তৎকালীন গঠনমূলক ছাত্রসমাজকে চরমপন্থি গুন্ডা, তৎকালীন বাঙালিকে ক্ষুধার্ত বাঘের থেকেও হিংস্রে এবং কুকুরের থেকেও নিচ ও সংকীর্ণ জাতিতে পরিনত করতে এই জ্ঞানগর্ভ(?) বইটি অতুলনীয়। বইটি থেকে কয়েকটা উদ্ধৃতি দিলেই বোঝতে পারবেন।
মুখবন্ধে তিনি বলেছেন, যখন পিছন ফিরে দেখি, আমি দেখতে পাই বিপুল পৈশাচিকতা আমার চোখের সামনে ওঠে আসছে। এ গ্রন্থটি আমি যেভাবে, সেই ঘটনাবলীকে দেখি তার বিবরণী। কিন্তু পুরো বইটিতে ফরমান যে পৈশাচিকতার বিবরণ দিয়েছেন তাতে শুধুমাত্র বাঙালিদের পৈশাচিকতার ভুল বানানো চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। যেমন কানা গলি অধ্যায়ে তিনি ৩ ও ৪ মার্চের বর্ণনায় বলেছেন, অস্থানীয় যুবতী মেয়েদের অপহরণ ও ধর্ষণ করার এবং শিশুদের জ্বলন্ত বাড়িতে নিক্ষেপ করার ঘটনার কথা পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর কখনো শোনা যায়নি; কিন্তু বাস্তবে অমনটিই ঘটেছিল। ক্ষমতা হস্তান্তর নিয়ে যখন টালবাহানা চলছিল তখন ২ মার্চ আওয়ামি লিগ হরতাল ডাকে এবং ঐ দিন রাত ৮ টা থেকে কারফিউ জারি করে সামরিক সরকার; ৩ ও ৪ তারিখও কারফিউ নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত বলবৎ থাকে। জনগনের মধ্যকার পুন্জ্ঞীভূত ক্ষোভ তখন আরো বেড়ে যায় এবং তারা স্বৈরাচারি কারফিউ লঙ্ঘন করে মিছিল আর স্লোগান দিতে থাকে। এতে পুলিশ ও সামরিক বাহিনীর সাথে জনগনের ধাওয়া হয় এবং সামরিক প্রশাসন গুলি করলে বহু জনসাধারনের রক্তে রাজপথ রঙিন হয়ে ওঠে। জনগন ক্ষিপ্ত হয়ে কিছু প্রশাসনিক এলাকায় ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগ করে; কিন্তু তা ঘটনা প্রবাহের নিয়ত পরিণতি বলা যায়। কিন্তু রাও ফরমানে ৩ ও ৪ মার্চের যে বর্ণনা করেছেন তা বাস্তব ও সত্য থেকে শত শত আলোক বর্ষ দূরে।
মিলিটারি অ্যাকশন অধ্যায়ে লিখেছেন, আমি বাঙালিদের নিষ্ঠুরতার একটি দৃষ্টান্ত দিতে পারি যেখানে বিহারীদের একটি সম্পূর্ণ গ্রামকেই নিশ্চিহু করে দেয়া হয়েছিল। ব্রাক্ষ্মনবাড়িয়ায় তিন শ' মহিলার মৃতদেহ পাওয়া গিয়েছিল; যেখানে একটি শিশুর মস্তক দেয়ালে গেঁথে রাখা হয়েছিল। সেখানকার পুরুষদের আগেই জবাই করা হয়েছিল। ময়মনসিংহে শিশুদেরকে তাদের নিজেদের পিতার জন্য কবর খুঁড়তে বাধ্য করা হয়েছিল। জাহানারা ইমাম তাঁর একাত্তরের দিনগুলি বইয়ে মুক্তিযুদ্ধের সময় বিহারিদেরকে হত্যার কথা বলেন। কিন্তু ফরমান যে বিপুল জ্বালাও পোড়াও নারী হত্যা শিশু হত্যা পিতার জন্য ছেলেদের কবর খুঁড়তে বাধ্য করার মত পৈশাচিকতার যে বিবরণ ফুটিয়ে তুলেছেন সেটি ছিল প্রকৃতপক্ষে বাঙালিদের (বিশেষ করে বাঙালি হিন্দুদের) প্রতি পশ্চিম পাকিস্তানিদের বাস্তবিক আচরণ : অপারেশন সার্চলাইট।
মুসলিম বাঙলার পরিবর্তনের ধারা অধ্যায়ে লিখেছেন, সাধারণ বাঙালিদের চোখে প্রতিফলিত হত পশ্চিম পাকিস্তানের বিরূদ্ধে ঘৃণা। একই অধ্যায়ের অন্য জায়গায় লিখেছেন, বাঙালি অফিসাররা পশ্চিম পাকিস্তানি অফিসারদের সঙ্গে মেলামেশা করতেন না। . . . পশ্চিম পাকিস্তানি অফিসারদের বাঙলায় কথা বলতে না পারা ছিল এর অন্যতম কারণ। আসলেই কি বাঙলা বলতে না পারার জন্যই পশ্চিম পাকিস্তানি অফিসারদের সাথে বাঙালিরা কথা বলত না! আসেন রাও ফরমানের আরেকটি উদ্ধৃতি দেখি, মুসলিম বাংলার পরিবর্তন অধ্যায়ে লিখেছেন, বিগত আট বছর ধরে ডিডিএমও পদটিতে ছিলেন কর্ণেল ওসমানী, একজন পূর্ব পাকিস্তানি। পরবর্তীকালে যদিও তিনি মুক্তিবাহিনীর জেনারেল হয়েছিলেন, কিন্তু পাকিস্তানের সেনাবাহিনীতে তাঁকে পদোন্নতি পাওয়ার যোগ্য বলে বিবেচনা করা হত না। তিনি বাঙালি ছিলেন এবং সম্ভবত উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা তাঁকে বিশ্বাস করতেন না। এই হল পশ্চিম পাকিস্তানিদের মনোভাব, যারা শুধুমাত্র পীড়ন ও শোষন করত কিন্তু মুখে ভারতীয় ইন্ধন ও বাঙালি জাতীয়তাবাদের গোজবকে দায়ী করত।
একই অধ্যায়ে আরো বলেছেন, পশ্চিম পাকিস্তানের আধিপত্যের প্রতীক হিশেবে বিবেচিত উর্দুর বিরুদ্ধে প্রচারাভিযান এত প্রবল ও ব্যাপক ভিত্তিক ছিল যে, উর্দুতে লেখা কোন সাইনবোর্ড কোথাও দেখা যেত না, সকল দোকানেই ছিল বাঙলা সাইনবোর্ড। ঢাকার কোনো বাজারের মধ্যে গিয়ে কেউ উপস্থিত হলে নিজেকে তার বিচ্ছিন্ন ও বিদেশী মনে হত। উনার কথা শুনে মনে হচ্ছে পশ্চিম পাকিস্তানের সকল জায়গায় বাঙলা সাইনবোর্ড দেখা যেত। উনাদের বাঙলাপ্রীতির আস্ত্রিক ভালোবাসা আমরা ১৯৫২ সালে দেখেছি।
মুসলিম বাঙলার পরিবর্তন ধারা অধ্যায়ে বলেছেন, নগরীর সর্বত্র দেয়ালে দেয়ালে লেখা ছিল "আইউবশাহী ধ্বংস হোক" স্লোগান। আবার ১৯৭০ এর নির্বাচন-এ বলেছেন, আইউবের প্রতি জনগনের সমর্থন এবং শ্রদ্ধা ছিল। এরকম আরো অনেক পরস্পরবিরোধী অনেক বক্তব্যই একটু খেয়াল করে পড়লেই ধরা পড়ে। ১৯৭০ এর নির্বাচন-এ বলেছেন, যখনই ইচ্ছা করত তখনই ছাত্র সংগঠনগুলো সরকারের বৈধ ও আইনসঙ্গত কর্তৃত্বকে অমান্য করত। তাদের দর্শন ছিল জাতীয়তাবাদী, সমাজতন্ত্রী ও ইসলামবিরোধী। এই হচ্ছে পাকিস্তান; যা আইনের শেকলে বন্দি করে প্রচার করত ধর্মান্ধতা, সমাজতন্ত্রের মত একটি আদর্শ মতবাদকে বুটের তলায় পিষ্ট করতে সারাক্ষন ব্যগ্র ছিল আর শিরায় উপশিরায় উগ্রজাতীয়তাবাদী ছিল।
কানা গলিতে বলেছেন, তাজউদ্দিন, গোঁড়া ভারতপন্থি আওয়ামি লিগার, ভেতরে এলেন এবং বসলেন। তিনি পশ্চিম পাকিস্তানকে এবং সম্ভবত পাকিস্তানকেও ঘৃণা করতেন। তিনি আট বছর বয়স পর্যন্ত হিন্দু ছিলেন বলে একটি প্রচারণা ছিল। আমি গল্পটিকে সত্য মনে করিনে। কিন্তু তাঁর মানসিক গঠনে এর যথেষ্ট প্রকাশ ঘটত। মিলিটারি অ্যাকশনে বলেছেন, জগন্নাথ হল, যেখানে হিন্দু ছাত্ররা বসবাস করত, ছিল পাকিস্তানবিরোধী তৎপরতার জন্য সবচেয়ে কুখ্যাত। এই হলটি সবচেয়ে মারাত্মক প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল। এই ছিল পাকিস্তান: প্রতিক্রিয়াশীলতা ধর্মান্ধতা হিন্দুবিদ্বেষীর এক উৎকৃষ্ট উদাহরণ। আওয়ামি লিগের সবচেয়ে সৎ ও প্রগতিশীল নেতাকে যারা গোঁড়া ভারতীয় হিন্দুয়ানী টিকত্বের লেজ পরিয়ে দেয় তাদের চিন্তাধারা যে মধ্যযুগীয় হবে এটাই স্বাভাবিক। পাকিস্তানিদের পচা মাথায় ভারতীয়-হিন্দুয়ানী ভুত ঢুকে পাকিস্তান স্বাধীন হওয়ার পর থেকেই, আর এটি তড়িৎ গতি লাভ করে ১৯৫২ সালের পর থেকে। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারির পরবর্তীতে এক বিবৃতিতে তৎকালীন পাকিস্তানের গভর্ণর (?) কায়েদে মিল্লাত নুরুল আমিন বলেন, শত্রুর (ভারতীয়-হিন্দুয়ানি) ইন্ধনের ফলেই ছাত্র-জনতা এমন উগ্র হয়ে উঠেছিল, যা আমরা সামাল দিতে সক্ষম হয়েছি(ছাত্রদের হত্যা করে) । যা পরবর্তীতে জেনারেলদের ঘাড়ে চাপে এবং তারা পূর্ব পাকিস্তানে ভারতীয় কাল্পনিক আগ্রাসন ঠেকাতে শোষন পীড়ন ও দমননীতি (নির্বাচনের পর অধ্যায়ে বলেছেন, . . . আমি আরো বললাম আমি দেখেছি পূর্ব পাকিস্তানে আপনার অ্যাকশন কঠোর না হয় তাহলে পরিস্থিতির অবনতি ঘটে এবং তা নিয়ন্ত্রনের বাইরে চলে যায় ) চালাতে থাকে। কিন্তু সত্য কথা হচ্ছে বৈষ্যমের শিকার হয়ে একটি জাতি যখন সমস্ত অন্যায় ও অপনীতির বিরুদ্ধে দাঁড়ায় তখন কোন বিশেষ ব্যক্তি ও ইন্ধনদাতারা বিপ্লবকে কিছুটা বেগবান করতে পারে, কিন্তু ইতিহাসের অনিবার্য পরিণতির ধারায় তারা গৌণ হয়ে ওঠে।
-অসমাপ্ত-