যেসব বাংগালীর বয়স ৬০ বছর, কিংবা বেশী, তাঁরা যুদ্ধ দেখেছেন; যাঁদের বয়স ৫৬ বা তার উপরে, তাঁরাও দেখেছেন, কিন্তু পুরোপুরি অনুধাবন করতে পারেননি। আবার যাঁরা রণাংগন এলাকাগুলো থেকে বেশ দুরে ছিলেন, তারা সবকিছু সঠিকভাবে দেখেননি; তাঁরা হয়তো তাঁদের এলাকায় ২/১ দিনের আক্রমণে কিছু মানুষের হত্যাকান্ড দেখেছেন, বাড়ীঘর পোড়ায়ে দিতে দেখেছেন। ঢাকা ছিল পরাজিত শহর; ৯ মাস ঢাকা পাকী বাহিনীর পুরো দখলে থাকাতে, সেখানে ২৫ মার্চের হত্যাকান্ডের পর, সামনাসামনি যুদ্ধ হয়নি; রাজারবাগ পুলিশ লাইনে, ২৫ শে মার্চ যুদ্ধ হয়েছিলো, ৭/৮ ঘন্টা; রাতে হওয়ায় মানুষ গোলাগুলির আওয়াজ শুনেছেন, মানুষ পালিয়েছিল; ফলে, খুব একটা দেখার সুযোগ পাননি। ডিসেম্বরের ১৪ তারিখের পর, ঢাকা অবরোধ হওয়ার পর, ঢাকা শহরবাসী বুঝেেছিল যে, ঢাকায় যুদ্ধ হবে; ১৬ তারিখ পাকি বাহিনী সারেন্ডার করায়, অলিতে গলিতে যুদ্ধ হয়নি, ভালো হয়েছে, এতে প্রচুর মানুষ প্রাণ হারাতেন।
যারা যুদ্ধ দেখেননি, যুদ্ধে অংশ নেননি, যুদ্ধ সম্পর্কে তাঁদের ধারণা কি ছিলো ১৯৭১ সালে; আজকে ৪৮ বছর পর, তাদের সেই সময়ের ধারণাটুকু কিভাবে উনাদের জীবনের উপর কাজ করছে, জাতির পক্ষে, নাকি তেমন কোন অনুভুতি নেই?
জাতি আক্রান্ত হয়ে যখন যুদ্ধে গেছে, তখন যোদ্ধার দরকার ছিলো; এই ধরণের গণযুদ্ধ শুরু হলে, সাধারণ মানুষকে, শিক্ষিতদের যুদ্ধ করতে হয়; শুরুতে আমাদের মুলযোদ্ধারা ছিলেন ইপিআর, কিছু বেংগল রেজিমেন্ট, পুলিশ ও আনসার বাহিনীর সামান্য সদস্য; এরপর, যোগদেন মুলত গ্রামের তরুণরা: গ্রামের তরুণদের মাঝে বেশীরভাগ ছিলেন চাষীবাসীর ছেলেরা, কৃষিকাজে নিয়োজিত শ্রমিক শ্রেণীর লোকেরা, গ্রামের ছাত্ররা।
আমাদের শিক্ষিত সমাজ, চাকুরীজীবিগণ, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালেয়ের শিক্ষকগণ ও তাদের পরিবারের লোকেরা যুদ্ধে মোটামুটি অংশ নেননি; যুদ্ধে সাধারণ মানুষের উপস্হিতি দেখে মনে হয়েছে, পাকি বাহিনীর সাথে যুদ্ধ করা একমাত্র গরীবদের ও অশিক্ষিতদের দায়িত্ব। আমাদের শিক্ষিতরা যু্দ্ধের সময় কোথায় ছিলেন? তারা চাকুরী করেছেন; এদের অনেকের অবস্হা এমন ছিলো, চাকুরী না করলে পরিবার চালানোর অবস্হা ছিলো না। গরীবদের পরিবার এমনিতেই চলতো না; ফলে, যুদ্ধে গেলেও চলেনি, বাড়িতে পালিয়ে থাকলেও চলেনি। গরীবেরা সহজে সবকিছু ফেলে যুদ্ধে চলে গিয়েছিলেন; কারণ, 'সবকিছু' বলতে তেমন কিছুই ছিলো না: ছিলো হয়তো, মা-বাবা, স্ত্রী, সন্তান। ধনীদের ছিলো বড় বাড়ীঘর, ব্যবসা বাণিজ্য, চাকুরী, সরকার।
চাকুরী থেকে ধরে নিয়ে হত্যা করা ছিল সহজ; বাড়ীতে থাকলে, বাড়ী থেকে ধরে নিয়ে হত্যা করা ছিলো সহজ; ফলে, অনেক পরিচিত মুখ, যারা পাকিস্তানের পরাজয় কামনা করতেন, কিন্তু চাকুরী করেছেন, বাড়ীতে ছিলেন, এই ধরণের দেড়/দুই হাজারের বেশী পরিচিতদের ধরে নিয়ে হত্যা করেছে ইসলামী ছাত্র সংঘের (শিবিরের বড় ভাইয়েরা) জল্লাদেরা। যুদ্ধ থেকে ধরে নেয়া মোটামুটি অসম্ভব; যুদ্ধকে বুঝার দরকার ছিলো; আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রতিপক্ষকে বুঝার দরকার ছিলো। সবচেয়ে বড় কথা, যুদ্ধ লাগলে, মাতৃভুমির জন্য যুদ্ধ করতে হয়; যারা মায়ের জন্য যুদ্ধ করেনি, যোদ্ধাদের সাহায্য করেনি, তাদের কাছে মাতৃভুমির তেমন কোন মুল্য নেই!
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই ডিসেম্বর, ২০১৮ সন্ধ্যা ৭:০৩