আমি ষষ্ট শ্রেণীতে পড়ার সময়, ধানের মওসুমে, মাদ্রাসার জন্য চাঁদা তুলতে আসা মাদ্রাসার এক দরিদ্র ছাত্রের সাথে আমার পরিচয় হয়েছিলো, নাম ছিলো আবদুল করিম; মনে হচ্ছে, স্কুলে পড়ার আগ্রহ ছিলো তার; কিন্তু বাবা না থাকায় খরচ চালানোর উপায় ছিলো না। তিনি মাদ্রাসাও শেষ করতে পারেননি, মাদ্রাসা ছেড়ে, দিনমুজুরী করে সংসার চালাতেন; তার বড় বোনের বিয়ে হওয়ার পর, তার মায়ের মৃত্যু হয় কম বয়সে। বড় বোন ব্যতিত তার আর ভাইবোন ছিলো না; মনে হয়, দারিদ্রতা তাঁকে হতাশ করে তুলেছিলো, ১৫/১৬ বছর বয়সে তিনি নিরুদ্দেশ হয়ে যান; এবং ১১ বছর পর তিনি বাড়ীতে ফিরে আসেন।
যখন বাড়ীতে ফিরে এসেছিলেন, তাঁর হাতে টাকা পয়সা ছিলো, তিনি বাড়ীতে নিজের ঘর করেছিলেন ও বাড়ীর সামনে একখানা মসজিদ করেছিলেন; তিনি মানুষের সাথে তেমন আলাপ আলোচনা করতেন না; নিজের মসজিদে ইমামতী করতেন, গ্রামে গ্রামে ঘুরে বেড়াতেন, হাতে থাকতো একখানা বড় লাঠি; তাঁর আয়ের ব্যাপারে কেহ কিছু জানতো না, মানুষ মনে করতো যে, তাঁর টাকার উৎস হলো জ্বীন; তাঁকে জ্বীনের বাদশাহ নাম দেয় গ্রামের লোকেরা।
আমার চাকুরী জীবনের প্রথমদিকে তাঁর সাথে কথা হয়, পরেও আমি দুর থেকে তাঁকে হেঁটে যেতে দেখেছি, কিন্তু আলাপ হয়নি। সম্প্রতি আমি উনার উপর একটি পোষ্ট দিয়েছিলাম; ব্লগার জুন উনার সম্পর্কে আরো জানতে চেয়েছিলেন; আমি উনার খবর নিয়েছি: ২ বছর আগে উনার মৃত্যু হয়েছে; ৩ জন ছেলে আছে, ছেলেগুলো পড়ালেখা করেছিলো, চলছে।
নিরুদ্দেশ থাকাকালীন সময়ে, আসলে তিনি চট্টগ্রামের ভাটিয়ারীতে এক নির্জন পাহাড়েই ছিলেন; তিনি কখনো হাটবাজারে যেতেন না বলেই কেহ তার খবর জানতো না। ভাটিয়ারীতে, শিল্পপতি একে খানের কিছু পাহাড় ছিলো, সেগুলো অনাবাদী পড়েছিলো; সেখানে স্হানীয় একজন লোক ২টি গাভী পালন করতো; সেই লোক করিমকে গাভীগুলোর দায়িত্বে নিয়োগ করে। গরুর ঘরের পাশেই একটি কুঁড়ে ঘরে করিম থাকতেন, মালিক বাজার সাজার করে দিতেন, করিম নিজে রান্নাবান্না করে খেতেন। এক সময় করিম ৮টি গাভীর দেখাশোনা করতেন। দীর্ঘদিন সেখানে থাকার সময়, নিজেই কুঁড়ো ঘরটাকে ভালো করে বাঁধেন ও অনেক ধরণের ফল গাছ লাগিয়েছিলেন পাহাড়ে।
পাহাড়ে করিমের ১১ বছর কাটার পর, একদিন একে খান নিজের পাহাড়গুলো দেখতে এসে করিম ও গরুর খামার দেখতে পান; করিম তাঁকে খুব সন্মানের সাথে দুগ্ধ দিয়ে আপ্যায়ন করেন। একে খান করিমকে এককালীন ভালো পরিমাণ টাকা দেন ও উনার কারখানার শ্রমিক হিসেবে চাকুরী দেন। কিন্তু করিম বাড়ী গিয়ে মসজিদ করে ইমামতি করতে চান; একে খান বিনা কাজেই করিমকে প্রতিমাসে শ্রমিক হিসেবে বেতন দিতে বলেন উনার ম্যানেজারকে; ইহাই ছিলো করিমের আয়ের পথ। করিম নিজের কোন ব্যাপারে মানুষের সাথে আলাপ করতো না, মানুষ মনে করতো যে, জ্বীন করিমকে টাকা দিয়ে যায়।
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই ফেব্রুয়ারি, ২০২০ সন্ধ্যা ৭:৪৫