আমি তখন কলেজের ২য় বর্ষে, চট্টগ্রাম শহরের রাস্তায় একটি হিন্দু বিধবা মেয়ের সাথে দেখা হয়েছিলো, কম বয়সে তার বিয়ে হয়েছিলো, এবং সে অকালে বিধবা হয়েছিলো; তার জীবনের শুরুটা ছিলো কষ্টকর, পরে কি হয়েছে, আমি জানতে পারিনি; আশাকরি, সে সুখী হয়েছিলো।
আমি গ্রামের ছেলে, এইচএসসি পড়েছি চট্টগ্রাম শহরে; সাপ্তাহিক শেষ ক্লাশের পর, বাস ধরে গ্রামে চলে যেতাম প্রতি সপ্তাহে; সেইবার ভোটের আগে (১৯৭০ সাল), মিলিটারী দুরপাল্লার কয়েকটি বাসের ড্রাইবারকে কি কারণে পিটায়েছিলো, ১ দিনের বাস ধর্মঘট, আমি বাড়ী যেতে পারিনি; ছুটিরদিন দুপুরের একটু আগে সিনেমা দেখার জন্য হেঁটে দিনার সিনেমার দিকে যাচ্ছিলাম। আসকার দীঘির পাড়ে, দুর থেকে দেখছি একটি বিধবা মহিলা রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে আছে; আমি পাশ দিয়ে যাবার সময় মহিলার দিকে চোখ পড়লো, বিধবার শাড়ীপরা একটি কিশোরী মেয়ে; আমি আবার তাকিয়ে ভালো করে দেখলাম; চোখে চোখ পড়তেই মেয়েটা আমাকে জিজ্ঞাসা করলো,
-তুমি জামাল খান রোডের দিকে যাচ্ছ?
-হ্যাঁ।
-আমি তোমার সাথে যাবো, একা যেতে ভয় লাগে।
-তুমি কোথায় যাবে? আমি প্রশ্ন করলাম।
-পাথরঘাটা।
-তোমার বাসা পাথরঘাটায়, তুমি অতদুর হেঁটে যাবে?
-আমার কোন বাসা টাসা নেই, মামামামীর সাথে পাথরঘাটার খৃষ্টান পাড়ায় থাকি। তুমি কোথায় যাচ্ছ?
-আমি দিনারে সিনেমা দেখতে যাচ্ছি!
-আমার খুব ইচ্ছা করে সিনেমা দেখতে, মামামামী আমাকে নেয় না।
-একা যেতে পারো না?
-আমার কাছে পয়সা নেই!
-এখন যদি দেখতে চাও, আমি তোমার জন্য টিকিট কাটবো।
-তোমার কাছে অত পয়সা আছে?
-আছে।
সে খুবই খুশী হলো। আমি বললাম,
-তুমি বিধবার শাড়ী কেন পরেছ?
-কারণ আমি বিধবা, আমার স্বামীর মৃত্যু হয়েছে।
-তুমি তো এখনো কিশোরী, কখন তোমার বিয়ে হয়েছিলো?
-১১ বছর বয়সে; তারপর, ১ মাসের মাঝে সে কলেরায় মারা গেছে!
-মামার কাছে কেন, তোমার মা-বাবা নেই?
-না, আমার জন্ম্বের আগেই নাকি আমার বাবা আমাদের ফেলে ভারতে চলে গেছে; আমার স্বামীর মৃত্যুর খবর শোনার পর আমার মা জ্ঞান হারায়, জ্ঞান আর ফেরেনি।
-তোমার জীবনটা কষ্টের; যাক, ভালো সময় আসবে একদিন।
সে ৪র্থ শ্রেণী অবধি স্কুলে গিয়েছিলো; এখন বড় মামামামীর সাথে থাকে; সারাদিন পাতারবিড়ি বানায়; সেটাই তার মামার ব্যবসা। তার ছোট মামার পরিবার থাকে চকবাজারে; গত ২ দিন সেখানে ছিলো, আজ ফিরে যাচ্ছে। সিনেমা দেখার পর, পাশের দোকানে বসে চা খেয়ে তার আরো অনেক কাহিনী শুনলাম; সে কষ্টে আছে, কিন্তু হতাশ নয়। আমি বললাম,
-তুমি বিধবার শাড়ী পরো না; কোন ছেলে যদি তোমাকে পছন্দ করে, তুমি বিয়ে করো; স্বামীকে নিয়ে বিড়ি বানালে তুমি ভালোভাবে চলতে পারবে। আজকে আমি তোমাকে সামান্য টাকা দেবো, একটা শাড়ী কিনে নিও, বাইরে বের হলে, বিধবার শাড়ী কখনো পরো না।
আমি নোয়াখালীর বাস ষ্টপে যাওয়ার পথে, তাকে কতোয়ালীর মোড়ে নামিয়ে দিলাম; কয়েক ঘন্টার পরিচয়, জীবনে আর দেখা হয়নি; এখনো সেই কিশোরীকে মনে পড়ে।
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা এপ্রিল, ২০২১ রাত ১:২১