বয়স বাড়ার কারণে কিছু কিছু বিষয়ে একটু এডজাষ্ট করতে হয় আজকাল, সেই ধরণের একটা কাহিনী।
চাকুরী পেয়েছি বাসা থেকে ৮০ মাইল দুরে; বাস মাস, ট্রেন ম্রেন কোনকিছুই কাছাকাছি যায় না; ড্রাইভিংই না করে উপায় নেই; চোখের সমস্যার কারণে, ডাক্তার আড়াই বছর আগেই ড্রাইভ করতে না করে দিয়েছে: সন্ধ্যার পর, আমি সামনের গাড়ীগুলোর পেছনের লাল লাইট ২টি ব্যতিত গাড়ীর বাকী অংশ দেখি না; আসল সমস্যা কিন্তু এর থেকে সামান্য বড়, আমি গাড়ীগুলোকে ডবলও দেখি, কোনটা কোনলাইনে চলছে কে জানে! তদুপরি, আমার চোখ সামনের গাড়ীর দুরত্বও মাপতে পারে না, উহা কি কাছে, নাকি দুরে, আমি সহজে বুঝতে পারি না।
শীতের সময় কাজ থেকে বের হলে, অন্ধকার দেখে মনে হয় মাঝরাতে রাস্তায় বের হয়েছি; আমি আমার গাড়ীর হাজার্ড লাইট (ব্লিংকিং লাইট) জ্বালিয়ে ৬৫ মাইল স্পীডের যায়গায় ৩৫ মাইলে চালিয়ে আমি নিজকে বিপদমুক্ত রেখে চালিয়ে যাচ্ছিলাম ভালোই; আমার পেছনের ড্রাইবারেরা আমার হাজার্ড লাইট দেখে পাশ কেটে চলে যায়। কিন্তু ফেব্রুয়ারী মাসের শেষ সপ্তাহে সমস্যায় পড়লাম; সেদিন একজন ড্রাইবার প্রায় ১০ মিনিট আমার গাড়ীর পেছনে গাড়ী চালাচ্ছিল; আমার সন্দেহ শুরু হলো, কিছু একটা সমস্যা আছে; শেষমেষ আমার সন্দেহই সত্য হলো, পুলিশ; উহা আমাকে সিগন্যাল দিলো থামার জন্য; আমি গাড়ী থামালাম, সাথে সাথে হ্যান্ড ব্রেকটা সামান্য টেনে দিলাম
-স্যার, ড্রাইবার লাইসেন্স ও গাড়ীর রেজিষ্ট্রেশন বের করেন। আপনি হাজার্ড লাইট দিয়ে কেন গাড়ী চালচ্ছেন, গাড়ীর সমস্যা কি?
-সমস্যা বুঝতে পারছি না, গাড়ীর স্পীড বাড়ছে না; গাড়ীর ঠান্ডা লেগেছে মনে হয়!
-এটা জোকের ব্যাপার নয়, হাইওয়েতে সমস্যাপুর্ণ গাড়ী চালানো বেশ যুঁকির ব্যাপার; এজন্য টিকিট দেয়া হয়।
আমি চোখের সমস্যার কথা বলতে পারি না; বললে, যদি আমাকে গাড়ী চালাতে না দেয়, সেটা হবে বিশাল সমস্যা; আমাকে টিকেট দিয়ে ডাক্তারের কাছেও পাঠিয়ে দিতে পারে; তা'হলে আমার বোরোটা বেজে যাবে। পুলিশ অফিসার গাড়ীর চারিপাশ ঘুরে দেখে বললো,
-গাড়ী তো তেমন পুরাতন নয়, ইহার স্পীড কেন কম?
-শীতের কারণে হতে পারে নাকি?
-না, শীতে ইন্জিন ঠান্ডা থাকে, সেটা গাড়ীর জন্য ভালো।
পুলিশ অফিসার দরজার কাছে দাঁড়ি্যে গাড়ীর ভেতরে দেখলো কিছুক্ষণ; হঠাৎ বললো,
-গাড়ীর ডেশবোর্ডে "ব্রেক" সাইন কেন?
-আমি ব্রেকে পা দিয়ে রেখেছি।
-তাতে কি "ব্রেক" সাইন দেখায়? গাড়ীর গিয়ার পার্কিং'এ দেন।
আমি তাই করলাম, ব্রেক-সাইন জ্বলছে ডেসবোর্ডে। অফিসার বললো,
-আপনি গাড়ীটাকে ধ্বংস করছেন! গাড়ীর হ্যান্ডব্রেক রিলিজ না করেই গাড়ী চালাচ্ছেন, সেজন্য গাড়ীর স্পীড নেই; উহা রিলিজ করে, চলে যান।
অফিসার চলে গেলো। নিজের উপর ভয়ানক খুশী হয়ে পথে থামলাম, একটু হাঁফ ছাড়ার দরকার। সার্ভিস ষ্টেশনটা মোটামুটি খালি; একটা খাবার দোকানে ঢুকে প্লেটে এক টুকরো সেমনমাছ ও সামান্য শাক নিয়ে পয়সা দিতে ক্যাশে গেলাম। ক্যাশিয়ার ৩ জন, মাঝের ক্যাশিয়ার ও ১ জন তরুণী ক্রেতা কি নিয়ে তর্ক করছে, বাকী ২ জন শুনছে, আমাকে নিয়ে কারো মাথা ব্যথা নেই, আমি লাইনের মাথায় দাঁড়িয়ে আছি; ২ বার হাত দেখালাম, খবর নেই। শেষে বিনা অনুমতিতেই, নিজেই ১ম ক্যাশিয়ারের সামনে গেলাম। মেয়েটা একটু বিরক্ত হলো; খাবারটা ওজন করে ক্যাশের কি-বোর্ড পান্চ করছে, এমন সময় তর্করত তরুণী (ভিয়েতনামী হতে পারে) ক্রেতা আমার দিকে রাগান্বিত চোখে তাকিয়ে বললো,
-অন্ধ নাকি, আমার কুকুরকে পায়ের নীচে মাড়াচ্ছ কেন?
-কোথায় কুকুর?
-নীচের দিকে দেখ!
দেখলাম, খুবই ছোটাকারের একটা কুকুর মেয়েটার পায়ের কাছে দাঁড়ায়ে আমার দিকে ভীত চোখে তাকিয়ে আছে; একটু আগে আমার পায়ে কি একটা যেন সামান্য লেগেছিলো বলে মনে হয়।
-স্যরি, আমি দেখিনি।
-স্যরি মরি কম বলিও, চোখ খুলে হাঁটিও, তাতে সমস্যা কমবে, ঠিক আছে? নাকি তুমি অন্ধ?
মেজাজটা খারাপ হয়ে গেলো, স্যরি বললাম, তারপরও এসব ম্যাঁওপ্যাঁও! তরুণীকে বললাম,
-কুকুর আর মালিকের আকার তো সামানুপাতিক; সেইজন্যই আমার চোখে পড়েনি হয়তো!
-কি বললে, আমার আকার নিয়ে তুমি কথা বলছ? দেখ, তোমাকে আমি কি করি!
কি জঘন্য অবস্হা! স্যরি বলে আমি চুপ হয়ে গেলাম। আমি বিনা আহবানে ক্যাশে আসায় ক্যাশের মেয়েটা আমার উপর খুশী ছিলো না; সে একটু ঘি ঢেলে দিলো:
-তুমি মানুষের আকার নিয়ে কেন কথা বলছ?
-আমি চুপ হয়ে গেছি, দেখছ না?
-চুপ হয়ে গেলে কি অপরাধ মাফ হয়ে যায়?
-ঠিক আছে, আমি চলে যাচ্ছি! আমি দরজার দিকে যেতে মেয়েটা বললো, তোমার খাবারের পয়সা?
-আমি তোমার থেকে খাবার কিনে খাবো না।
-তোমাকে খেতে বলছি না, পয়সা দিতে বলছি।
-আমি যা খাইনা, সেটার জন্য পয়সাও দিইনা।
-মালিককে ডাকবো?
-ডাকো।
মেয়েটা কোন এক মার্ককে ডাক দিলো; ক্যাশের পেছনের পেছনর দরজা হয়ে একটা লোক বেরিয়ে আসলো, আমার বয়সী হবে। মেয়েটা আমার নামে নালিশ করলো; লোকটা বললো,
-মিষ্টার, আপনি খাবার নিচ্ছেন না কেন?
আমি বাংলায় বললাম, "আমার কাছে পয়সা নেই"।
-কি বললেন?
-আমার কাছে পয়সা নেই।
লোকটা মেয়ের দিকে তাকিয়ে বললো,
-এই লোক ইংরেজীই জানে না, সে আবার কিসের খাবার কিনবে? সে হয়তো দরিদ্র, খাবারটা ওকে দিয়ে দাও।
-সে এতক্ষণ ইংরেজী বলছিলো।
-বলুকগে, খাবারটা এদিকে দাও।
লোকটা খাবারটা নিয়ে আমাকে দিয়ে বললো,
-মন খারাপ করবেন না, ইয়ং মেয়েরা আজকাল কাজের থেকে অকাজ বেশী করে।
আমি বাংলায় বললাম, "ধন্যবাদ"।
ভিয়েতনামী (হয়তো) মেয়াটা বললো,
-এই লোক ইংরেজী জানে।
মালিক বললো, "ইংরেজী জানলেও ক্ষুধা লাগে"।
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই জুন, ২০২১ রাত ৯:৩৮