যশোবন্ত সিংহ এর "জিন্না ভারত দেশভাগ স্বাধীনতা" বই থেকে পাওয়া ইতিহাস এর দুটি সংগা উল্লেখ করছি..........
"....ইতিহাসের জনক হেরোডোটাস গ্রহন করেছিলেন এই দৃষ্টিভঙ্গি যে, ইতিহাস হল নিয়মানুসারে পরীক্ষিত নানা তথ্যের সমাহার। আবার, বিখ্যাত আরব ঐতিহাসিক ইবন খালদুন ' দ্য মুকাদ্দিমা'-তে ইতিহাস কি বা কি হওয়া উচিত, সে বিষয়ে যা বলেছেন-
(ইতিহাস রচনা) বহু উৎস এবং অনেক বিষয়ে জ্ঞান দাবি করে। তার জন্য কল্পনা প্রবন মন এবং সর্বাত্নক চিন্তা চাই, যাতে ঐতিহাসিক সত্যের কাছে পৌছঁতে পারে এবং তার ভুলচুক না হয়। যদি যে ভাবে ইতিহাস বাহিত হয়ে এসেছে তাকেই সে বিশ্বাস করে, পরম্পরা থেকে যেসব নীতি তৈরি হয়েছে তার পরিষ্কার ধারনা যদি তার না থাকে, রাজনীতির মৌলিক তথ্য, সভ্যতার প্রক্বতি, মানবসমাজ গঠনের শর্ত যদি সে না জানে, অধিকন্তু, প্রাচীন বিষয়বস্তুর সাথে সাথে সমকালীন বিষয়ের তুলনামুলক মূল্যায়ন যদি সে না করে, তবে সে হোঁচট খাবে, পিছলে যাবে, সত্যের পথ থেকে বিচ্যুত হবে। ঐতিহাসিকরা, কোরানের টিকাকার রা, জ্ঞানী মানুষেরা প্রায়ই তাঁদের কাহিনি এবং ঘটনার বিবরনে ভুল করেছেন। তাঁরা যা শুনেছেন তাকেই গ্রহন করেছেন, তার মূল্যায়ন করেননি। তাঁরা ঐতিহাসিক ঘটনার অন্তর্নিহিত নীতিগুলোর সাথে ঘটনাগুলি মিলিয়ে নেননি, একই ধরনের বিষয়ের সাথে তাঁরা তুলনা করেননি। তাঁরা দর্শনের নিরিখেও অনুসন্ধান করেননি, বস্তুর প্রক্বতি সম্পর্কে জ্ঞানের সাহায্য নিয়ে কিংবা ইতিহাসের অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে দেখতে চাননি। সেই জন্য তারা সত্যের পথ থেকে সরে গিয়ে ভিত্তিহীন এবং ভ্রান্ত ধারনার মরুভুমিতে পথ হারিয়েছেন। "
ইতিহাস বরাবরই বিতর্কের। ইতিহাস চোখে দেখা যায়না, অন্যের লেখা বা শোনার উপর নির্ভরশীল যা কিনা যিনি বলছেন বা লিখছেন তার দৃষ্টিভঙ্গির ব্যাপার। কারন ইতিহাস মূলত ঘটনা নির্ভর, এসব ঘটনার সাথে জড়িত থাকে সেময়ের সমাজ ও সংষ্কৃতি, রাজনীতি, অর্থনীতি এমন অনেক কিছু। তাই, একটা ঘটনাকে সঠিক ভাবে মূল্যায়ন এবং বর্ননা করতে হলে সে সময়কে, সে সমাজ কে, সে সময়ের মানুষ গুলির চিন্তা ভাবনাকে নিজের ভেতরে ধারন করাটা খুব জরুরী, অন্যথায় প্রকৃত সত্য অন্তরালেই থেকে যাবার সম্ভাবনা বেশি।
ধরুন পিপাসার্ত দুই বন্ধু দু্ই গৃহস্তের বাসায় যেয়ে পানির আবদার করলো। একজন পেল এক গ্লাস পানি আরেকজন অর্ধেক। খুবই সহজ ঘটনা, আরও সহজ উপসংহার, ১ম জনের গৃহস্ত বেশি উদার, মহত। কিন্তু ১ম জন যদি তার জমানো ১ গ্লাস পানি থেকে অর্ধেক দিয়ে থাকে আর ২য় জন ১কলস থেকে, তাহলে কি উপসংহারটা সত্য হল? ছোট কথায় এটাই মূল্যায়ন আর প্রবল অনুসন্ধিতসু এবং নির্মহ মন ছাড়া যা অসম্ভব। ইতিহাসের লেখকরা সবাই কি তা করতে পেরেছেন? না পারলে সেটা নিরুপনের কি কোন উপায় আছে? না থাকলে প্রকৃত ইতিহাস বলে কি কিছু থাকে?
আবার ইতিহাসের বিচার টাও নির্ভর করে দৃষ্টিভঙ্গির উপর। আমার পক্ষে গেলে সত্যি, বিপক্ষে গেলে মিথ্যা। আমি কে? আমি জন্মসুত্রে বাঙ্গালী, মুসলমান, হিন্দু, খ্রীষ্টান, ভারতীয়, পাকিস্তানী, ইংরেজ কিছু একটা।
বাঙ্গালীর কাছে যে লুটেরা, ইংরেজের কাছে সেই বীর; মুসলমানের কাছে যে বীর, অমুসলমানের কাছে সেই ভয়ংকর; বচ্ঞিতের কাছে যে দালাল, ভোগীর কাছে সেই শিরোমনি। তাহলে মানুষের ইতিহাস বলতে আমরা কি বুঝবো? (মনে পড়ছে পাঠ্যবইয়ে প্রতি পাঁচ বছরান্তে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বদলানোর কথা। স্বাধীনতার ঘোষনা কে দিয়েছেন? উত্তর: ১৯৯১-১৯৯৬ পর্যন্ত দিয়েছেন জিয়া, ১৯৯৬-২০০১ পর্যন্ত মুজিব, ২০০১-২০০৬ জিয়া, ২০০৮-২০১৩ মুজিব, যাহ্ পাস)
তাহলে ইতিহাস কে আমি কিভাবে বিচার করবো? এর থেকে সত্য, মিথ্যা যাচাই বা সিদ্ধান্ত গ্রহনের পদ্ধতি কি? এটাও তো অনেকটা বিশ্বাস আনার মতো মনে হচ্ছে। তাহলে তর্কে-বিতর্কে ইতিহাসের রেফারেন্স কতটুকু যুক্তিযুক্ত? উত্তর খোঁজার চেষ্টা করছি।
ভালো থাকবেন সবাই।
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা ডিসেম্বর, ২০১০ সকাল ১০:৩৫