somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

সমাপ্ত-অসমাপ্ত প্রেম----- শেষ পর্ব

২০ শে জুন, ২০১৩ বিকাল ৪:১৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

১ম২য় পর্বের পর
ফ্রেন্ড রিকোয়েষ্ট এক্সেপ্ট করার পরপরই সোয়েব মেয়েটার প্রোফাইল দেখেছে। একবার নয়। কয়েকবার। সম্ভবত, সেখানে যেসব তথ্য আছে, তা ওর মুখস্থ হয়ে গেছে।
যেসব তথ্য আছে, সেগুলো হলোঃ
বর্তমান আবাসস্থল হিসাবে আছে ঢাকা
হোমটাউন হিসাবে যে শহরের নাম দেয়া আছে, গুগল ম্যাপ অনুসারে সোয়েবের শহর থেকে সেটা ৪৪৯ কি.মি. দূরে।
স্কুল-কলেজ হিসাবে সেখানকার এক স্বনামধন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নাম দেয়া আছে।
আর সব শেষে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন এক কলেজের নাম দেয়া। ভর্তি সন হিসাব করে বোঝা যায়, মেয়েটা একাডেমিক লাইফে সোয়েবের থেকে দুই বছরের ছোট।

কি লাভ হলো এসব জেনে?
লাভ হয়েছে এটাই যে, মেয়েটা অনলাইনে আসলে কথা বলার কিছু একটা টপিক তো থাকলো।

প্রথম যেদিন মেয়েটা অনলাইনে আসলো, সেই দিনটা সোয়েবের মনে না থাকার কোন কারন নেই। কেননা, ওটাতো স্বপ্নের শুরু নয়, স্বপ্ন তখন ফুল রিদমে দৌড়াতে শুরু করেছে।

দিনটা ছিলো ১২ই অক্টোবর, শুক্রবার। ছুটির দিনে সোয়েব এখন সকাল থেকেই ফেসবুকে বসে থাকে। দুপুরে একটু বিরতি দিয়ে আবার বিকালে বসে। সকালেই প্রথম দেখা পাওয়া গিয়েছিলো তার।

অনলাইন ফ্রেন্ড এর সংখ্যা পরিবর্তন হলেই সোয়েব সেখানে ক্লিক করে। তেমনিভাবে অভ্যাসবসত ক্লিক করেই যখন দেখলো 'মেঘবালিকা' অনলাইন, পূর্বের মতই তার হার্টবিট কয়েকটা মিস হলো।

প্রথম হাই-হ্যালো এর পরে মেয়েটি জিজ্ঞাসা করেছিলো, "আপনি কি স্টুডেন্ট?"
সোয়েব উত্তর দিয়েছিলো, "হ্যা, আরো অল্প কিছুদিন স্টুডেন্ট থাকতে হবে।তুমি?"
- আমিও । আপনার হোম ডিস্ট্রিক্ট কোথায়?
- তোমার বাড়ি থেকে ৪৪৯ কি মি দূরে
- ? তাহলে আমাকে চিনলেন কি করে?
- তোমার মনে আছে কিনা জানি না। একটা ছেলেকে তুমি ভুল করে কল করেছিলে। তারপর সে তোমাকে ভুল করে মিসকল দিয়েছিলো।
-হোয়াট?????
এরপর কিছুক্ষণ নিরবতা। অপেক্ষা করে করে সোয়েবই শেষে প্রশ্ন করেছিলো, "Stunned হয়ে গেলে নাকি?"
- হ্যা। ফোন নাম্বার ধরে আপনি আমাকে খুঁজে বের করেছেন?
-হুম
-Why?
- ইচ্ছা হলো তাই
- BTW, আপনি আমাকে তুমি করে বলছেন কেনো? অপরিচিত কাউকে তুমি করে বলা তো ঠিক না।
- কি অদ্ভুত কথা! তোমার প্রোফাইলে বার্থডে যেটা দেয়া আছে, সেটা ঠিক থাকলে আমার থেকে তুমি ২ বছরের ছোট। ২ বছরের জুনিয়রকে আপনি করে ডাকা আমার পক্ষে সম্ভব না।

মেসেজটা seen হয়েছে বটে। কিন্তু মেয়েটা তখন আর অনলাইনে নেই।
কি ধরনের কথা বলল মেয়েটা, কোনভাবেই সোয়েবের মাথায় ঢুকছে না। মেয়েটা কি ফেসবুক চ্যাটিঙ্গে আনাড়ি? এখানে তো তুমি-আপনি নিয়ে কেউ তেমন মাথা ঘামায় না।

নাহ, এই মেয়েতো বারবার সোয়েবকে মেজাজ হারাতে বাধ্য করছে।
সোয়েব এই সব সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে নিউজ ফিড scroll করে যাচ্ছিলো। হঠাৎ আবার চ্যাট উইন্ডোতে মেয়েটা একটা মেসেজ পাঠালো:
-আপনিতো খুব অসামাজিক টাইপের লোক
- একথা অনেকেই বলে। কিন্তু কথাটা সত্যি না। বুঝেছ Mis SG?
- SG মানে কি?
-Social Girl
- Listen, I'm always formal and social
- তা তো দেখতেই পাচ্ছি। ফেসবুকেও ফর্মাল হবার চেষ্টা। কিন্তু ম্যাডাম, আমি ফেসবুকে এতো ফরমাল হতে পারব না। তাতে তোমার ভালো না লাগলেও কিছু করার নেই।
-আপনিতো খুব ফাজিল টাইপের লোক
-আমি একটু আনসোশাল সেটা অনেকেই বলে। কিন্তু ফাজিলটা আজকে প্রথম শুনলাম। নতুন তথ্যের জন্যে ধন্যবাদ। আচ্ছা, আমি কি ইভটিজার?

মেয়েটা এবারও Seen লেখা ওঠার পরেই অফলাইনে চলে গেলো।
এবং সোয়েব অনেক্ষন অপেক্ষা করে বুঝতে পারলো যে, মেয়েটা আর অনলাইনে আসবে না।

এই ঘটনার দুই দিন পরের ঘটনা। সোয়েব চ্যাটে লিখলো 'Hi, Social girl'
উত্তর আসলো, 'Hlw unsocial man'
- কি খবর?
- ভালো না।
- কেনো? আনসোশাল লোকেরা বেশি ডিস্টার্ব করছে?
- না, আমার জ্বর
- Oh, sorry
-For wht?
-sickness নিয়ে মশকরা করার জন্যে
- it's ok :D
-আমি ঠিক করেছি তোমার সাথে ভাববাচ্যে কথা বলব। আমার হোম টাউনে কি কখনো আসা হয়েছে?
- এটা চলে।
- চললে ভালো। কিন্তু আমারতো তুমি ই ভালো লাগতো
-না, আপনি আমার সাথে ভাববাচ্যেই কথা বলবেন
-দেখা যাক কতদিন বলি। আজ যাইগা। bye
-যাইগা আবার কি? ভালো ভাবে বলেন।
-উফফ, কি বলবো? আমি গেলুম ???
-চলে।
-ওকে, আমি আজ যাই কেমন? এটা কেমন ছিলো?
-Bye
এভাবেই মেয়েটার সাথে সোয়েবের চ্যাটিং চলতে থাকে। বেশীরভাগ সময় তারা ঝগড়া করেই সময় পার করত। এভাবে মাস খানেক চলার পর, সোয়েব হটাৎ অনেক ব্যস্ত হয়ে ওঠে। তাই সেও কিছুদিন ফেসবুকে খুব বেশী সময় দিতে পারেনি।

ব্যস্ততা একটু কমে যাওয়ার পর কোন এক অলস সন্ধ্যায় রাসেলের সাথে আড্ডা দিচ্ছিলো সোয়েব, নিজের বেডরুমে বসে।
রাসেল জিজ্ঞাসা করলো, "তুই নাকি এখন বারাক ওবামার থেকেও ব্যস্ত?"
- তা বলতে পারিস। উত্তর দিলো সোয়েব
- কি নিয়ে ব্যস্ত?
- ভাবছিলাম ছাত্র জীবনের শেষের দিকে একটু সিরিয়াস স্টুডেন্ট হই
- আমি কি তোর বাসায় সার্কাস দেখতে আসছি? এইসব কি শুনি তোর মুখে? যাকগা, ভাবীর খবর কি?
- কোন ভাবী?
- কেনো, মোহনা ভাবী
- বুড়ো বয়সে আমার হাতে মার খেতে চাস নাকি? ভাবী-টাবী বলবি না খবরদার। কিছুই হয়নি এখনো।
- আচ্ছা বলব না। খবর কি বল। ফোনে কথা হয়?
- না। ফোনে তো আর পরে কথা হয়নি। ফেসবুকেও অনেকদিন অনলাইনে পাই না। আমিও কম বসি এখন।
- একটা গান আছে শুনছিস, 'A life in facebook' ? তোর লাইফ নিয়েও একটা গান আছে। 'গোপনের প্রেম গোপনে গিয়েছে ঝরে, আমরা দু'জনে কখন গিয়েছি সরে'
- ফালতু কথা রাখ। দেখি, আজকে একটা মেসেজ পাঠাবো আবার।
- এইতো নতুন প্রেমিকের মত কথা বলছিস।
সোয়েব যে মেসেজটা পাঠিয়েছিলো, সেটি এরকম, 'hi, কি খবর? গায়েব কেনো?'

উত্তর আসলো ২ দিন পর, 'hi, I'm back. এক্সাম শেষ। আপনাকে ফেসবুকে দেখা যায়না কেনো?'
উত্তর পেয়েতো সোয়েব হতবাক। মেয়ে বলে কি? মেয়েটা নিজে ফেসবুকে আসছে না, আবার বলে সোয়েবের নাকি খোঁজ নেই ফেসবুকে? মস্করা করলো? নাকি মেয়েটাই সোয়েবকে অফলাইন করে রেখে ভুলে গেছে?

দুইটার যেটাই হোক, সোয়েবের কিছুই যায় আসে না।

এরপর থেকে শুরু হয়ে গেলো তাদের চ্যাটিং গল্পের দ্বিতীয় পর্ব।
তবে এবারে মেয়েটার আচরন আগের থেকে কিছুটা পরিবর্তন দেখা যায়। যেটা সোয়েবের চোখ এড়ায়নি। এই যেমন :
১) সোয়েব ক্রমাগত তুমি সম্বোধন করে যাচ্ছে, কিন্তু মোহনা আর আগের মত over react করছে না
২) আগে মোহনাকে খুব কম সময় অনলাইনে পাওয়া যেতো। এখন তাকে বিভিন্ন সময়ে অনেকক্ষণ ধরে অনলাইনে পাওয়া যায়।
ভালোই হয়েছে। চ্যাটিং চলছে তার আপন গতিতে। মোহনা একদিন বললো, "আপনার এক ফ্রেন্ডের ছবি দেখলাম। বেশ স্মার্ট আর হাসিখুশি। সোহান না কি যেনো নাম।
-"ছবি দেখেই বুঝে ফেললে? " উত্তর দিলো সোয়েব। "পছন্দ হয়েছে? হলে দেরী করে লাভ কি?"
- আপনি ঘটকালি করেন
- অবশ্যই করব। কিন্তু ঘটকালি করতে গেলে মেয়ের বায়োডাটা লাগবে। ছেলেরটা আগে থেকেই আছে। এখন মেয়েটার ইন্টারভিউ দরকার।
- :P বলেন কি জানতে চান
- আজ থাক। আজ আমার মন ভালো নেই।
- আশ্চর্য ! ইন্টারভিউতে কয়েকটা প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করবেন, তার সাথে মন ভালো থাকার কি সম্পর্ক?
- সত্যিই মন খারাপ, কারনটা বলতে পারবো না।
- যান, আপনার সাথে appointment canceled
-ভালো। আচ্ছা তোমার সব থেকে প্রিয় উপন্যাস কোনটা?
- সাতকাহন
- দিপাকে এতো ভালো লাগে কেনো তোমার?
- দিপাকে আমার ভালো লাগে না। আপনার সাথে ইন্টারভিউ-ইন্টারভিউ পরে খেলবো। bye
- সেকি? কেবল তো শুরু। তাছাড়া ইন্টারভিউ যখন নিতে শুরুই করেছি আমি না ছাড়লে তুমি যেতে পারবে না।
- goodbye
অফ লাইন !!!

বড্ড গোলমেলে সব আচরন। সাতকাহন প্রিয় উপন্যাস, আবার নাকি দিপাকে ভালো লাগে না। মানে, ব্যপারটা এমন, আমি সরবত খাই, চিনি ছাড়া।

কিন্তু মেয়েটা বেশ স্পষ্টভাষী। দিপার অতি হিসাবী আচরন অনেকেরই ভালো লাগে না। কিন্তু কেউ স্বীকার করতে চায় না। সোয়েব চিন্তা করে দেখলো, এর আগে যে কয়েকটা মেয়ের সাথে ওর সামান্য কথা-বার্তা পরিচয় হয়েছে, তারা সবাই দিপার মত হতে চেয়েছে। কিন্তু বাস্তবে সুখী হতে গেলে তো ছাড় দেয়ার মানসিকতা থাকতে হয়, সেটা বুঝেও না বোঝার ভান করেছে। সেই দিক থেকে দেখলেও এই মেয়েটাকে অনেক বেশী 'প্রাকটিক্যাল' মনে হয়।

আবার সেই অনুভুতি। শেষ দেখতে হবে। আগ্রহ মেটাতে হবে। এভাবে শুধু শুধু কালের গর্ভে হারিয়ে যেতে দেয়া যাবে না।
কিন্তু কিভাবে?
অবশ্যই ফোনে কথা বলে।
কিন্তু তার আগে মেয়েটার কাছ থেকে শুনে নিতে হবে। সে যদি আগ্রহী হয়, তাহলেই সোয়েব আগাতে পারে।

ইদানিং সোয়েব বেশ অন্যমনষ্ক হয়ে গেছে। উদাস উদাস ভাব। সব সময় কিছু চিন্তা করছে। মাঝে মাঝে আবার হেসে ও উঠছে।
রাসেল এরকম একদিন হাসি দেখে বললো, "তুইতো হিন্দী মুভি তেমন দেখিস না।"
সোয়েবের উত্তর, "এটাতো অনেক পুরানো কথা"
- কিন্তু হিন্দী মুভিতে যা বলে, ঠিকই বলে। প্রেমে পড়লে সব কিছু ভালো লাগে, হঠাৎ হঠাৎ কারন ছাড়া হেসে ওঠে আর সেই সাথে সেল ফোনে রিংটোন হিসাবে থাকে 'পেহলা নাশা'
সাথে সাথে সোয়েব পকেট থেকে ফোন বের করে কিছু টেপাটিপি করে আবার পকেটে রেখে দিলো।
- "কি করলি?", জিজ্ঞাসা করলো রাসেল।
- রিংটোন চেঞ্জ করে দিলাম।
- তারমানে এর আগে পেহলা নাশা ছিলো? হাহাহাহাহাহাহাহাহাহা।
- তুই এতো বুঝিস কেনো? মাঝে মাঝে মনে হয়, তোর মাথায় এতো বুদ্ধি দেয়ার কারনে আল্লাহ আমার মাথায় কম দিয়ে দিয়েছে।

যদিও রাসেলের সাথে মেজাজ দেখানোর ভাব ধরে সোয়েব চলে আসলো, তার মন এখন বেজায় খুশি। সে আবার মোবাইল বের করে রিংটোন চেঞ্জ করে আগেরটাই দিয়ে দিলো।

একটা ওয়েলকাম টিউন দরকার। হঠাৎ করে ওয়েলকাম টিউন দিলে আবার কারো খোঁচা খাওয়া লাগতে পারে। কিন্তু তাতে কি? সে মোবাইল হাতে নিয়ে সাত-পাঁচ ভাবছিলো আর হাটছিলো রাস্তা ধরে।

আরে, সামনের মোড়টাতে জটলা কিসের? কিছু একটা নিয়ে তুমুল তর্ক চলছে। অনেক মানুষ সেটা দেখছে। সোয়েব দ্রুত হেটে সেদিকে এগুলো।
তেমন কিছু না। নতুন সাইকেল চালনো শিখছিলো এক ছেলে। অদক্ষতা বশত রাস্তার পাশে বসে থাকা ফেরীওয়ালার গাড়িতে ধাক্কা দিয়ে বসেছে। এখন ফেরীওয়ালা ক্ষতিপূরন দাবী করছে।
এখানে কিছুই করার নেই। তাই সোয়েব আস্তে আস্তে বাসার দিকে এগুতে থাকলো।
বাসায় এসে সে বুঝলো তার বাম পাশের পকেট ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। ধড়াশ করে লাফ মারলো হৃদপিন্ড। হাত পকেটে ঢুকিয়ে শিওর হয়ে নিলো সত্যিই মোবাইল সেটটা গায়েব কিনা।

কোন সন্দেহ নেই! পকেটে বিশাল এক শূন্যতা।
তাড়াতাড়ি মায়ের ফোন থেকে ফোন দিলো।

বন্ধ।

কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছে না সোয়েব। কিভাবে সম্ভব হলো? কখনই বা হলো? জটলায় দাড়ানোর সময় নিশ্চয়ই। কিন্তু...
ফোন নিয়ে গেছে সেটার থেকে বড় সমস্যা, হারিয়ে গেছে মোহনার নাম্বার। এখন ফেসবুক ছাড়া আর কোন কানেকশান নেই সোয়েবের সাথে মোহনার।
পূরানো মোবাইল হারিয়েছে, চূলায় যাক। মোহনার নাম্বারের কি হবে? আর তো পাওয়া যাবে না।
মোহনা কি সোয়েবের নাম্বার সেভ করেছে? মনে হয় না। অন্তত মোহনার যায়গায় আজ সোয়েব থাকলে সেভ করত না।

চোরের মুন্ডুপাত করেই বা কি লাভ? চোর ঠিকই সুযোগের সদ্ব্যবহার করেছে, করতে পারেনি সোয়েব। এতোদিন ধরে সে নাম্বারটা অন্য কোথাও লিখেও রাখেনি। একসময় মুখস্থ হয়ে গিয়েছিলো। কিন্তু এখন তো উল্টা-পাল্টা লাগছে।

এই অনাকাঙ্ক্ষিত পূর্বাভাস বিহীন বজ্রপাতের পর সোয়েবের ফেসবুক আকর্ষণ কয়েকগুন বেড়ে গেলো। সময় থাকলেও ফেসবুকে, না থাকলেও বিভিন্ন উপায়ে, কাজে ফাঁকি দিয়ে ফেসবুকে।

কিন্তু যার জন্যে এতো চুরি, সেই মোহনা কিন্তু ফেসবুক থেকে আবারো গায়েব। প্রথম এক সপ্তাহ সোয়েব কিছু মনেই করেনি। এরকম কতবার গায়েব হলো। দুই সপ্তাহ পার হবার পর একটু চিন্তা হলো, ঘটনা কি? যেখানে দিনে দুই তিন বার অনলাইনে আসতো, সেখানে ২ সপ্তাহ একেবারে খোঁজ নেই ! অবশ্য যে মেয়ের সব কাজই অদ্ভুত, তার কোন কাজে অবাক হওয়া চলে না।

কিন্তু তিন সপ্তাহ চলে যাওয়ার পরে সোয়েব বেশ চিন্তিত হয়ে গেলো। চিন্তা না বলে দুঃচিন্তা বলাই ভালো। সোয়েবের সেই আগ্রহ সবে আরো গভীরে যাওয়ার জন্যে তাগিদ দিতে শুরু করেছে, সোয়েবও সিদ্ধান্ত নিয়েছে, সরাসরি মেয়েটাকে তার আগ্রহের কথা জানানোর, ঠিক তখনই কিনা মেয়েটা গায়েব !!!

পরের সপ্তাহ আরো কষ্টে কাটলো। সোয়েবের এখন ভয় করতে শুরু করেছে, মেয়েটা কি একেবারে গায়েব হয়ে গেলো? অন্য কোন একাউণ্ট আছে? নাকি কোন ঝামেলা হলো?
প্রতিদিন সময়-অসময় ফেসবুকে বসে থাকছে, কখন মোহনা আসবে অনলাইনে। কিন্তু আসছে না। সোয়েবের এখন বিরক্ত লাগছে, কেনো যে এতোদিন সে বলে এসেছে শিউলী তার প্রিয় ফুল!!! এতোদিন পর যে মেয়েটাকে তার একটু ভালো লেগেছে, সে তো ঠিকই শিউলীর মত হারিয়ে যাচ্ছে, আবার ফিরে আসছে। কিন্তু তার এই আচরন সোয়েবের কাছে গলায় আটকে যাওয়া কাঁটার মত অসস্তিকর এবং ব্যাথাতুর মনে হচ্ছে।

সেই বিশেষ দিনটার কথা কি সারা জীবনে ভুলতে পারবে সোয়েব? দিনটা ছিলো সেই দিন, যেই দিন মেয়েটার গায়েব হবার একমাস ৩ দিন পূরন হলো।

সোয়েবের কাছে মনে হচ্ছে, সে আর সহ্য করতে পারবে না। এভাবে তার প্রথম ভালোলাগা হারিয়ে যাবে, সে মানতেই পারছে না। চিন্তা-ভাবনা করে সে একটাই উপায় খুঁজে পেলো।

সে একটা মেসেজ পাঠাবে। মেয়েটা ফেসবুকে আসলে মেসেজ দেখবেই। হয়ত এতোদিনে সোয়েব দেরী করেই ফেলেছে। তবুও মেসেজ সে পাঠাবেই। দেরীতে হলেও মোহনা জানুক, সোয়েব তাকে অনুভব করতে শুরু করেছে।

মেসেজটা অনেকটা এরকম ছিলো,

'জানি না, তুমি কেনো এতোদিন ফেসবুক থেকে দূরে। কোন সমস্যা, নাকি অন্য কিছু? যাইহোক, তোমার অনুপস্থিতি আমাকে চিন্তিত করে তোলে। তোমার সাথে চ্যাটিঙ্গে তোমার কথা থেকে জেনেছি, তুমি আমাকে ঘরকুনো, বাইরের পৃথিবী সম্পর্কে ধারনাহীন একটা ছেলে মনে করো। কিন্তু তুমি বিশ্বাস করো আর নাই করো, আমি মোটেই ঐরকম নই। ফেসবুকে অনেক ফ্রেন্ড আছে আমার। বান্ধবীও কম নেই। But U make me feel different. যেদিন তোমার ইন্টারভিও নিচ্ছিলাম, তুমি বলেছিলে, দিপাকে তোমার ভালো লাগে না, তোমার সেই কথা আমার মনে কি প্রভাব ফেলেছিলো, কখনো তোমাকে বলার সুযোগ পাইনি। দীর্ঘ একমাস ধরে অপেক্ষায় ছিলাম, তুমি অনলাইনে আসলেই বলব এইসব কথা। জানি, আমার কাজ খুব হাস্যকর হচ্ছে। একটা মেয়ের বিষয়ে কিছু না জেনে, শুধুমাত্র ফেসবুকের পরিচয়ে নিজের মনের সব কথা বলে দিচ্ছি। মানুষ শুনলে হেসে কূল পাবে না।

আমার বাবা সবসময়ই বলে, আমি নাকি কোন কিছুতেই ঝুঁকি নিতে চাই না। হ্যা, কথাটা সত্যি। আর সেজন্যেই হয়ত হারতে শিখিনি কোন কিছুতে। কিন্তু আমার ভয় হচ্ছে, আজ যদি আমি এই ঝুঁকি নিয়ে তোমাকে আমার মনের কথা না জানাই, তাহলে কথা গুলো মূল্যহীন হয়েই থাকবে সারাজীবন '

মেসেজ টাইপ করে সোয়েব কতক্ষণ বসে ছিলো, কখন সেন্ড বাটনে চাপ দিয়েছে, কিছুই মনে করতে পারে না। বোধহয় ঘোরের মধ্যে ছিলো।
সব থেকে আশচর্যের ব্যাপার ছিলো, মোহনা মেসেজের উত্তর দিয়েছিলো সাথে সাথেই। ব্যাপারটা এমন, মোহনা মেসেজ
পাওয়ার জন্যেই বসে ছিলো অফলাইনে।

নাহ, মোহনার উত্তরের মাঝে কোন অস্বাভাবিকতা ছিলো না। আর দশটা মেয়ে এই অবস্থায় যে উত্তর দেয়, সে তার ব্যতিক্রমী কিছু করেনি।

মোহনা উত্তর দিয়েছিলো, 'What is this? Is everything alright?'
সোয়েব উত্তর দিয়েছিলো, 'Don't know. I can assure u, my account is not hacked'
- একাউন্ট হ্যাক হবার কথা আসছে কেনো?
- সব ঠিক আছে কিনা জিজ্ঞাসা করলে তাই। মেসেজটা আমিই পাঠিয়েছি, তাতে কোন সন্দেহ নেই।
- আমি বাড়িতে, আমার জ্বর।
- রেস্ট নাও।
- আপনার মেসেজ পড়লাম, কিছু বুঝলাম না। আমি দিপাকে পছন্দ করি না, তাতে আপনার মনের উপর ক্রিয়া মানে কি?
- সুস্থ হও, তারপরে শুনো
- না, এখনই বলেন। I'm feeling better now
- তাহলে তুমি আগে বলো, দিপাকে তোমার ভালো লাগে না কেনো?
- বেশিই calculative. জীবন এভাবে চলে না। জীবনে compromise করতে হয়
- এই ছোট্ট কথাটাই কেউ স্বীকার করতে চায় না। তুমি স্বীকার করলে প্রথম। তাই, বলেছিলাম, U make me feel different
- আমার absence এ আপনি আমাকে মিস করেছেন শুনে অবাক লাগছে।
- অবাক তো আমিও। চিনি না, জানি না, কোনদিন দেখিও নি। তার জন্যে যে কেনো এতো অনুভুতি!! আমি তোমার ফোন নাম্বারটা হারিয়ে ফেলেছি। তুমি আবার কবে হারিয়ে যাও, ফোন নাম্বার থাকলে খুঁজে পেতে সুবিধা হতো।
- হারাবো না।

অফলাইন। আবার গায়েব হয়ে গেছে মোহনা। কোন উত্তর না দিয়েই। তারপরও সোয়েবের খুব খুশি লাগছে।

জীবনে নামায পড়েছে কয় ওয়াক্ত, তা গুনলে হয়তো হাতের পাঁচ আঙ্গুলের কর ও শেষ হবে না। কিন্তু আজ সৃষ্টিকর্তার প্রতি প্রশংসাতে তার মন ভরে উঠেছে। কিছুক্ষণ আগেও সে জানত না, মোহনা কবে তার মেসেজ পাবে। সেই অস্থিরতা থেকে সে এখন মুক্তি পেয়ে গেছে। মোহনা পেয়ে গেছে সোয়েবের মেসেজ।
সোয়েব বলতে পেরেছে তার কথা। এটা কি কম আনন্দের কথা?

স্বপ্নটা এখানেই শেষ হতে পারত। কিন্তু হলো না।

সোয়েবের এখন অনেক কাজ। প্রথম কাজ, রাসেলের কাছ থেকে একজনের ফোন নাম্বার নিতে হবে। তারপর সেই মানুষটার সাথে কথা বলে পরবর্তী কর্মপরিকল্পনা ঠিক করতে হবে।
...........................................................

ফোনে বলছে সোয়েব, "আরে হাসান সাহেব, চিনতে পেরেছেন? আমি সোয়েব। রেড ক্রিসেন্ট এ ব্লাড ডোনেট করতে গিয়েছিলাম আমি আর আমার বন্ধু রাসেল।"

অপরপ্রান্ত থেকে উত্তর আসলো, "আরে ভাই, চিনব না কেনো? আপনারা ব্লাড না দিলে যে কি হত!!! মনে করে ফোন করেছেন দেখে ভালো লাগছে"
- ভাই, ফোন করেছি একটা দরকারে। আমার একটা সাহায্য দরকার।
- অবশ্যই। বলেন কি করতে পারি আপনার জন্যে।

এর এক সপ্তাহ পরে, সোয়েব তার মাকে বলছে, "মা, আমি ঘুরতে যাবো"
- "বছরের এই অসময়ে তুই কোথায় ঘুরতে যাবি? দুইদিন আগে একগাদা টাকা দিয়ে নতুন মোবাইল কিনলি, এখন আবার ঘুরতে গেলেতো আরো অনেক টাকার ব্যাপার" , মা বলছিলো উপদেশের সুরে।
- মা, এসব বলে লাভ হবে না। আমি যাবোই
- কোথায়? কার সাথে? কবেই বা যাবি?
- কারো সাথে যাবো না এটা সিওর। কোথায় যাবো সেটাও একটু অনিশ্চিত।
- সব কথায় ফাজলামো করবি না। কোন কিছু ঠিক নেই, এসে বললেই হলো 'মা, আমি ঘুরতে যাবো'?
- ঠিক তো আছেই। তোমার মনে নেই, বলেছিলাম, রেড ক্রিসেন্ট এ একটা ছোট্ট বাচ্চাকে ব্লাড দিয়েছিলাম? বাচ্চাটা বেঁচে যাওয়ার পরে হাসান সাহেব ফোন করে কেঁদে ফেলেছিলো আনন্দে।
- হুম, শুনেছিলাম তোর কাছে।
- আমি আসলে হাসান সাহেবের বাড়িতে যাচ্ছি। চাকরীর সুবাদে এখানে থাকেন, এখন এক সপ্তাহের ছুটিতে বাড়ী যাচ্ছেন উনি।
- একটা অচেনা লোককে এভাবে জ্বালাবি?
- মা, নতুন একটা জায়গায় যচ্ছি। এরকম সুযোগ বারবার আসে না তো ।
- আচ্ছা। কবে যাবি?
-আজ রাতেই রওনা হবো
- সব গোছগাছ করা লাগবে না?
- সব রেডী। শুধু বিকালে মার্কেটে গিয়ে অল্প কিছু কেনাকাটা করতে হবে।


সোয়েব অপরাধবোধে ভুগছে এখন। হাসান সাহেব বলেছিলেন কিছু একটা করার চেষ্টা করবেন। কিন্তু সেই কিছু একটা যে এতো কিছু তা সোয়েব তখন বুঝতে পারেনি। উনি বলছিলেন, "ভাই, কি বিপদে ফেলেছিলেন!! শুধু স্কুল কলেজের নাম, ব্যাচ আর ডাকনাম দিয়ে খুঁজে বের করা কত যে কঠিন!!! তবে আমি আপনাকে হতাশ করিনি। তার খোঁজ পাওয়া গেছে। আপনি আসেন আমাদের ঐখানে, দেখা হওয়ার ব্যবস্থা হয়ত করতে পারবো।"
- "কিভাবে?" সোয়েবতো অবাক। "আপনিতো এখানে"
- অফিসে ছুটির দরখাস্ত অলরেডী দিয়ে দিয়েছি। আমি শুক্রবার ওখানে পৌছাবো।
- আরে, আপনিতো দেখি আমার চাইতে বড় পাগল। আপনি এতো ঝামেলা করে ফেলবেন জানলে আমি আপনাকে জানাতাম না
- জানিয়ে ফেলেছেন, এখন আর ভেবে লাভ কি? চলে আসেন। তার সাথে দেখা না হোক, নতুন শহর দেখা তো হবে
- ভাই, তার ঠিকানা কি পেয়েছেন?
- ঠিকানা না পেলে দেখা করবেন কিভাবে?
- হাহাহাহাহাহা। আমি তাহলে শুক্রবার রাতে রওনা হব
- শুভকামনা রইলো
কেনা কাটা বলতে, একটা টাঁই কিনতে হবে, আর কিনতে হবে একটা এনসাইক্লোপিডিয়া। রঙ্গীন প্রিন্ট।
কেনাকাটা, গোছগাছ এবং পথ-ঘাট সোয়েব পার হয়েছিলো নির্বিঘ্নে। তবে একটা আফসোস ছিলো তার, দিনের বেলা আসলে আশে পাশের দৃশ্য দেখতে পারতো। যেখানে চলেছে সোয়েব, ছোট বেলা থেকেই বাবার মুখে সেই অঞ্চলের মানুষের অনেক গল্প শুনেছে। আজ সে দেখতে চলেছে সেসব। একটা হালকা রোমাঞ্চ অনুভব করেছে সে।


বাবার কাছে শুনে মনে মনে একটা ঝাপসা ছবি সে তৈরী করেছিলো এই অচেনা শহরটার। কিন্তু এসে কিছুই মেলাতে পারেনি। যদিও সে ঠিকমত দেখা সুযোগই পায়নি। পৌছে লম্বা ঘুম দিয়েছিলো। তারপরে দুপুরে হাসান সাহেব ও তার পরিবারের সদস্যদের সাথে আড্ডা দিয়ে কাটিয়েছে। দুপুর বেলা যদিও আড্ডা তেমন জমে না, কিন্তু হাসান সাহেব এবং তার বাবা, দুই জনেই অনেক মজার মানুষ। তারা ঠিকই মানুষকে আড্ডায় ধরে রাখতে পারে।

বিকাল বেলা হাসান সাহেব আর সোয়েব বের হয়েছিলো, হাসান সাহেবের ভাইয়ের মোটরবাইকে করে। হাসান সাহেব একেবারে মার্কার সহ সোয়েবকে ঠিকানা চিনিয়ে দিচ্ছিলেন। একসময় বললেন, "ভাই, আপনাকে তো ডেকে আনলাম। কিন্তু দেখাটা কিভাবে করাই বুঝতে পারছি না।"
সোয়েব উত্তর দিলো, ঐসব আমার ঠিক করা আছে। শুধু দরকার ঠিকানা।
-হুম, ঠিকানা তো দেখিয়েই দিলাম।
- অনেক ধন্যবাদ। বাকীটা আমার উপরেই ছেড়ে দিন। শুধু গনধোলাই খাওয়ার উপক্রম হলে একটু বাঁচাবেন।
- আমি কি সাথেই থাকব আপনার?
- না থাকলেই বোধহয় ভালো।
- ওকে। তাহলে আপনার প্লান বাস্তবায়ন হচ্ছে কবে?
- এখন সাড়ে চারটা বাঁজে। আজই হওয়া ভালো। দেরী করতে মন চায় না
- কিন্তু আজ আপনি ক্লান্ত।
- চিন্তা করার সময় নেই। চলেন, আপনার বাসায় গিয়ে রেডী হয়ে আবার আসতে হবে।
হাসান সাহেবের বাসায় ফিরে একবারে সেলসম্যান সাজলো সোয়েব। ঠোটের কোনে একটা মৃদু হাসি লেগে আছে। কিছুদিন পরপরই কিছু সেলসম্যান এসে দরজা নক করত। "এই বইটা, একেবারে অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেসের প্রিন্টিং। বাইরে থেকে কিনলে আপনার অনেক খরচ পড়বে। আমরা বিশেষ অফারে দিচ্ছি মাত্র ৯৯৯ টাকায়"
সারাজীবন বড় নির্দয়ভাবে এই লোকগুলোকে তাড়িয়ে দিয়েছে সোয়েব। এরা কেনো জানি শুধু দুপুরের ঘুমের টাইমেই ডিস্টার্ব করে। নিয়তির কি খেলা, আজ সোয়েব সেই এন্সাক্লোপিডিয়া সেলসম্যানের চরিত্রে অভিনয় করতে যাচ্ছে!!! আজ এই লোকগুলোর জন্যে খারাপ লাগছে সোয়েবের।

বিকাল সোয়া পাঁচটায় সোয়েব পৌছালো মোহনার বাসার সামনে। অনেক বড় ঝুঁকি নিয়ে ফেলেছে সে। এখন এই বিকালে মোহনা বাসায় না ও থাকতে পারে। সব থেকে বড় সমস্যা, সে মোহনাকে আগে কখনো দেখেনি। এখন যদি মোহনা দরজা খুলে সামনে দাড়িয়েও থাকে, সে চিনতে পারবে না।

হার্টবিট মিস হওয়া এখন সোয়েবের কাছে নতুন কোন ঘটনা নয়। বাড়িটা আবার ভালোভাবে দেখলো সে। পুরনো ধাঁচের দোতলা বাড়ি। হাসান সাহেব এটাও জানিয়েছে, মোহনারা দোতলায় থাকে।

পা কাঁপছে সোয়েবের। কিন্তু সেলসম্যানেরতো পা কাঁপলে চলবে না। এখন তাকে অন্য কিছু ভাবতে হবে।

হ্যান্সী ক্রনিয়ের কথা ভাবলে কেমন হয়? অসাধারন খেলোয়াড়, সাহসী ক্যাপ্টেন, দূর্ধষ ফিল্ডার, আরো কত কিছু......

খুব বেশী ভাবার সময় পেলো না সে। দোতলার দরজায় পৌছে গেছে।

দরজার সামনে দাঁড়িয়ে একটু অপ্রস্তুত হয়ে গেলো সোয়েব। কি করেছে সে!!! মাথায় বুদ্ধি আসার সাথে সাথেই সেটা বস্তবায়ন করতে শুরু করেছে। এখন তো ভীষণ ভয় লাগছে। এই অজানা- অচেনা শহরে আবার নতুন কোন বিপদে পড়বে নাতো?

দরজা পর্যন্ত এসে ফিরে যাওয়া চলে না। তাই সে ইতঃস্তত করতে করতেই কলিঙ্গবেল টিপে দিলো।

আনুমানিক ৩০ সেকেন্ড পর ভেতর থেকে মেয়েলী কন্ঠে প্রশ্ন ভেষে আসলো, "কে?"
সেলসম্যান সূলভ উত্তর দিলো সোয়েব, "একটা প্রোডাক্ট এনেছিলাম। দরকারী। এনসাইক্লোপিডিয়া। অরিজিনাল প্রিন্ট। খুবই দূর্লভ"

যদিও সোয়েব জানেনা তার অভিনয় কেমন হয়েছে, কিন্তু দরজা খুলে গেলো। সাথে সাথেই সে ব্যাগ থেকে বইটা বের করলো।

"এটা একটা এন্সাইক্লোপিডিয়া। এখানে আপনি সব ধরনের তথ্য পাবেন। যখন যা জানতে ইচ্ছা হবে, তাই পাবেন। অরিজিনাল প্রিন্ট। বাইরে দাম তিন হাজারের উপরে। but আমরা কোম্পানীর পক্ষ থেকে দিচ্ছি আজকের জন্যে মাত্র ৯৯৯ টাকায়। নিজের জন্যে না হলেও এরকম দূর্লভ জিনিষ কাউকে গিফটও করতে পারেন।"

মেয়েটা বইটা হাতে নিলো। এই মেয়েটা মোহনা হতেই পারে না। বয়স আন্দাজ করতে গিয়ে সোয়েবের ধারনা হলো , এ নিশ্চয়ই মোহনার ছোট বোন।

এনসাইক্লোপিডিয়া দেখতে দেখতে বারবার রঙ্গীন ছবিতে আটকে যাচ্ছে মেয়েটার চোখ।

খুব বেশি সময় না, প্রায় এক মিনিট পরেই বইটা ফেরত দিলো সে,। "বইটা অনেক সুন্দর। কিন্তু এখন তো বাসায় কেউ নেই। আপনি পরে কোন একসময় আসতে পারবেন?"
- আপু, আমাদের এই অফারটা শুধু আজকের জন্যে। আপনার আপু, ভাইয়া কেউ থাকলে তাদেরকে জিজ্ঞাসা করতে পারেন। এরকম অফার বারবার আসে না।


আন্দাজে ঢিলটা ছুড়েই দিয়েছে সোয়েব। বাসায় কেউ নেই শুনে তার বুকটা ধড়াস করে উঠেছে আগেই। এতো দূর এসে কি শেষে শূন্য দর্শনে ফিরতে হবে?

"আপনি দাড়ান, আমি আপুর কাছ থেকে শুনে আসি", বলেই মেয়েটা দরজা আবার লাগিয়ে দিয়ে চলে গেলো। তাহলে মোহনা বাড়িতেই আছে। দেখা কি হবে না তাহলে? সে তো আসবে বলে মনে হচ্ছে না।

আবার খুলে গেলো দরজা। মোহনার বোনই দরজা খুলেছে। কোন কথা না বলে সে সরে দাড়ালো এমনভাবে, যেন এতোক্ষণ সে সোয়েবের দৃষ্টি সীমাতে বাঁধা হয়ে ছিলো।
সোয়েব কিছু বলতে যাচ্ছিলো। তখন তার নজরে পড়লো, ঘরের অপরপ্রান্ত থেকে ভিতরের রুমে যাওয়ার দরজার পর্দা আস্তে আস্তে সরে যাচ্ছে।

ধীরে ধীরে একটা হুইল চেয়ারে বসা মেয়ে প্রবেশ করলো সেই রুমে। হুইল চেয়ারে বসে আছে, কিন্তু চোখে আত্মবিশ্বাসের ঝিলিক।
প্রথম দর্শনে তার চুলের দিকে নজর যেতে বাধ্য। মোটকথা, প্রথম দর্শনে সে বনলতা সেনের কথা মনে করিয়ে দেয়।

বনলতা সেন মানেইতো হারিয়ে যাওয়ার ভয়, কিংবা শিউলির মত ঝরে যাওয়ার ভয়। শুধু ভয় আর ভয়।

প্রথম কথা বললো হুইল চেয়ারে বসা মেয়েটাই, "আপনি?"
সোয়েবের গলা কাঁপছে, "আ আ আমি এসেছিলাম একটা প্রোডাক্ট নিয়ে...."
- থাক, আর না। আমি আপনাকে চিনি। আপনি মোহাম্মদ শাহরিয়ার আজিম সোয়েব। কেনো এসেছেন এখানে?

এই পর্যন্ত বলেই মোহনা কাঁদতে শুরু করলো। অন্তত সোয়েবের তাই মনে হলো। মাথা নিচু করে বসে আছে মোহনা, মাঝে মাঝে গোঙ্গানীর মত একটা শব্দ ভেষে আসছে।

সোয়েব আসলে বুঝতে পারছে না তার কি করা উচিত। চলে যাবে? কিছু না বলেই? বলবেই বা কি? কিছু করার না পেয়ে সে হুল চেয়ারটাকেই ভালোভাবে লক্ষ্য করতে লাগলো। দীর্ঘদিন ব্যবহারের চিহ্ন স্পষ্টভাবে ফুটে আছে হুইলগুলোতে।

এই ঘর, ঘরের মাঝে সোয়েবের সামনে একজন অর্ধ পরিচিত আর আরেকজন সমপূর্ন অপরিচিত মেয়ে সব কিছু যেন মোহাবিষ্ট করে রেখেছে সোয়েবকে। কোথায় যেনো একটা অস্বাভাবিকতা আছে, কিন্তু সে ধরতে পারছে না। সে কিছুতেই মানতে পারছে না, তার স্বপ্নের শেষ অংশ এতোটা মলিন হতে পারে। বলার মত কোন কথা নেই, কি করবে তাও বুঝতে পারছে না, যাকে দেখার জন্যে এতোদূরে এতো পাগলামী করে ছুটে এসেছে, সে সামনে বসে আছে, কিন্তু তার দিকে তাকাতে পারছে না।

বরাবরের মত মোহনা ই নিরবতা ভাঙ্গলো।
- কেনো এসেছেন এখানে?
এবার সোয়েব মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে।
"হুইল চেয়ারে বসা মেয়েকে দেখে ভালোবাসা জানালা দিয়ে পালিয়ে গেলো?", আবারো বললো মোহনা।
সোয়েবের মনে হচ্ছে, সে বেঁচে নেই। কি শুনছে সে এসব? কেনইবা শুনছে? যা দেখার তাতো দেখে নিয়েছে সে। সিদ্ধান্তও নিয়ে ফেলেছে।
-"অনেক পাগলামী তো দেখালেন। নিশ্চয়ই এখন সত্যিই নিজেকে পাগল মনে হচ্ছে?"

আর সহ্য করতে পারছে না সোয়েব। পা ভেঙ্গে আসছে। আর কিছুক্ষণ এখানে থাকলে কি হবে তার কোন ঠিক ঠিকানা নেই।
অনেক কষ্টে সে শুধু এটুকু বলতে পারলো, "আমি আসছি, তবে ছোট দুনিয়াতে আমাদের আবারো দেখা হতে পারে"

আর দাড়ালো না সে। সিড়ি দিয়ে নামতে নামতেই টাইটা খুলে ব্যাগে রাখলো। সোজা রিক্সায় চড়ে হাসান সাহেবের বাসায়।

গল্পটা এখানেও শেষ হলো না।
পরদিন রাতের বাসে সোয়েব রওনা হলো তার বাড়ির উদ্দেশ্যে। হাসান সাহেব বলেছিলেন আরো একদিন থাকতে। কিন্তু সোয়েবের মন খারাপ দেখে সে আর জোর করতে পারেনি ।
বাসে বসে কখন ঘুমিয়ে গিয়েছিলো সোয়েব তা বুঝতে পারেনি। দুঃস্বপ্ন তাড়া করে ফিরছে তাকে।

একই দুঃস্বপ্ন, একটি নতুন হুইল চেয়ার, তার পাশে আরেকটি পুরানো হুইল চেয়ার, একটি পরিচিত পারফিউমের গন্ধ, শেষে কোথা থেকে রাসেল এসে সোয়েবের মাথায় টোকা দিয়ে বলছে, "তুই একটা গর্ধভ"।

আসলেই নিজেকে গর্ধভ মনে হচ্ছে সোয়েবের। সে মোহনাকে তখনই বলতে চেয়েছিলো, "মোহনা, তুমি অনেক ভালো অভিনেত্রী। কিন্তু ভালো নাট্য পরিচালক নও।"

বলতে পারেনি সে।

যার জন্যে এতো পাগলামী, সেই মোহনা প্রথম দেখাতে চিনে ফেলায় মনে মনে খুশি হয়েছিলো সোয়েব। তার পাগলামী করা স্বার্থক হয়েছে। কিন্তু মোহনার কথাগুলো তাকে অনেক কষ্ট দিচ্ছিলো। প্রথমে যখন সে বুঝতে পারলো এই হুইল চেয়ারটা অনেক দিনের ব্যবহৃত, সেও প্রথম দর্শনে ভেবেছিলো ওটা মোহনার সর্বক্ষনের সাথী। ভুল ভাঙ্গে হুইলচেয়ার খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে গিয়ে। হুইল চেয়ারের হুইলের মাঝে সে দেখতে পেয়েছিলো সদ্য ছিড়ে ঝুলতে থাকা মাকড়সার জাল। যতদূর সে দেখতে পেয়েছে, সেই ঘরটার সব দিকে ছিলো মেয়েলি হাতে পরিচর্যার স্পষ্ট ছাপ। ঐ রকম পরিপাটি ঘরে, হুইল চেয়ারে জাল একদমই বেমানান। তবে সেটা তো হতেই পারে। হুইল চেয়ারতো আর কারো আনন্দের সাথী নয় যে তাকে পরিপাটি করে রাখতে হবে। কিন্তু হুইল চেয়ারের হুইলের দাঁতগুলো ও যেনো বেশি পরিস্কার ছিলো। সর্বক্ষণ ব্যবহৃত হলে তো এরকম থাকার কথা নয়। সমীকরণের সমাধান পেতে সোয়েবের লেগেছিলো কয়েক মুহুর্ত। তাই সে তটস্থ হয়ে গিয়েছিলো।

সমাধান একটাই, এই হুইল চেয়ার আগে কোন একসময় নিয়মিত ব্যবহৃত হত, কিন্তু বহুদিন পড়ে ছিলো অযত্নে। আজ কোন এক অদ্ভুত কারনে সেই হুইলচেয়ারকে নিয়ে আসা হয়েছে লাইম লাইটে।হঠাৎ। তাই মাকড়সার জালটাকেও সরানোর সময় হয়নি।

কিন্তু কেনো? কোন দরকার ছিলো কি? সোয়েবের মনে শুধু এই প্রশ্নই ঘুরছিলো তখন। তাই সে কোন কথা বলতে পারেনি। সে শুধু এটাই ভাবছে, "এমন কেনো হলো? আমিতো ব্যপারটাকে অনেক সহজ করতে চেয়েছিলাম, তাই সব ছেড়ে দিয়েছিলাম তার হাতে। কিন্তু সে এতো সহজ চিন্তা করতে পারেনি।"

ছোট একটা কথা বলেই সে শেষ করে দিতে পারত সব কিছু। তা না করে ছলনার আশ্রয় নিয়েছে। নাকি এটা সোয়েবের পাগলামীর শেষ সীমা পরীক্ষা করার চেষ্টা? সোয়েব কি এখনো যথেষ্ট পাগলামী করেনি? তাহলে কি ভুল করেছে সোয়েব? ফেসবুকে চ্যাটিঙ্গে মোহনাকে যতখানি স্পষ্টভাষী মনে করেছিলো, সে বাস্তবে ততটা নয়?

সোয়েব চিন্তা করেছে, প্রথম সে মোহনাকে জানিয়েছে তার মনের কথা। মোহনা আজ যা ই বলুক, কথাগুলো বলার আগের সময় আর ফিরে আসবে না। আর তাই অচেনা, অজানা, অদ্ভুত এই মেয়ের জন্যে অপেক্ষা সে করতেই পারে। তবে সে আর নিজে থেকে মোহনার কাছে ফিরে যাবে না। মোহনা যদি কোনদিন ফিরে আসে, তাহলে অবশ্যই সেদিন সকল পাগলামীর অবসান হবে।

কিন্তু মোহনা কি জানতে পেরেছিলো সোয়েবের এই শেষ কথাগুলো?

সে কথা আমরা জানতে পারিনি।

কারন, এরপর থেকে সোয়েবের ডায়েরীর পাতাগুলো সাদা হয়েই পড়ে আছে।
পড়ে আছে একটা কবিতা, যেটা রাসেল লিখেছিলো সোয়েবকে উৎসর্গ করে,

জীবনানন্দের মত, পঁচিশ বছর পরে
যদি মন চায় পিছু ফিরে দেখতে
সেদিনও পাবে আমার হাসি খুঁজে
বলব আমি, এই দেরীতো নয় আমার ভুলে
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে জুন, ২০১৩ রাত ৮:৪৯
২টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

তোমাকে লিখলাম প্রিয়

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ০২ রা মে, ২০২৪ বিকাল ৫:০১


ছবি : নেট

আবার ফিরে আসি তোমাতে
আমার প্রকৃতি তুমি,
যার ভাঁজে আমার বসবাস,
প্রতিটি খাঁজে আমার নিশ্বাস,
আমার কবিতা তুমি,
যাকে বারবার পড়ি,
বারবার লিখি,
বারবার সাজাই নতুন ছন্দে,
অমিল গদ্যে, হাজার... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছাঁদ কুঠরির কাব্যঃ মিসড কল

লিখেছেন রানার ব্লগ, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ৯:৫৫



নতুন নতুন শহরে এলে মনে হয় প্রতি টি ছেলেরি এক টা প্রেম করতে ইচ্ছে হয় । এর পেছনের কারন যা আমার মনে হয় তা হলো, বাড়িতে মা, বোনের আদরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

হিটস্ট্রোক - লক্ষণ ও তাৎক্ষণিক করণীয়

লিখেছেন ঢাকার লোক, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:০৭

সাধারণত গরমে পরিশ্রম করার ফলে হিটস্ট্রোক হতে পারে। এতে দেহের তাপমাত্রা অতি দ্রুত বেড়ে ১০৪ ডিগ্রী ফারেনহাইট বা তারও বেশি হয়ে যেতে পারে।

হিটস্ট্রোক জরুরি চিকিৎসা প্রয়োজন। চিকিৎসা... ...বাকিটুকু পড়ুন

আল্লাহকে অবিশ্বাস করার সংগত কোন কারণ নাই

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:৪৩



সব কিছু এমনি এমনি হতে পারলে আল্লাহ এমনি এমনি হতে সমস্যা নাই। বীগ ব্যাং এ সব কিছু হতে পারলে আল্লাহও হতে পারেন। সব কিছুর প্রথম ঈশ্বর কণা হতে পারলে আল্লাহও... ...বাকিটুকু পড়ুন

যুক্তরাষ্ট্রে ইসরাইল বিরোধী প্রতিবাদ বিক্ষোভ

লিখেছেন হাসান কালবৈশাখী, ০৩ রা মে, ২০২৪ সকাল ৮:০২

গাজায় হামাস উচ্ছেদ অতি সন্নিকটে হওয়ায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নিউইয়র্ক ও লসএঞ্জেলসে কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পরেছিল। আস্তে আস্তে নিউ ইয়র্ক ও অন্যান্ন ইউনিভার্সিটিতে বিক্ষোভকারীরা রীতিমত তাঁবু টানিয়ে সেখানে অবস্থান নিয়েছিল।


... ...বাকিটুকু পড়ুন

×