ছেলেপক্ষ বলতে গেলে একেবারে পাল্টি ঘর! মেয়ের বাবা বড় ঘুসখোর সরকারি আমলা। ছেলের বাবা বড় ঘুস দাতা শিল্পপতি। মেয়ে প্রাইভেট মেডিক্যাল এর গ্র্যাজুয়েট। ছেলে লন্ডন থেকে এসিসিএ পড়ে এসেছে। বিউটি পার্লারের লালন ললিত যত্নে মেয়ের চামড়া মাখনের মত নরম।সাততলা শপিং মলের উপর স্থাপিত জিমে বুকডন দিয়ে ছেলে বাইছেপ ট্রাইছেপ টেংরা মাছের মত লাফালাফি করে। সবকিছু সোনায় সোহাগার মধ্যে টুম্পার প্রাইভেট স্যার রহমত উদ্দিন টাই যেন কেমন! ছেলে ড়িমন, ড়িমনের বাবা আলহাজ্ব আক্কাছ আলী, মা ছৈয়দা শওকত আরা, মেয়ে টুম্পার বাবা আওরঙ্গ জীব খান, টুম্পার মা কাজী সহেলা সুলতানা, এমন কি টুম্পা- সব মিলিয়ে যদি একটা সুসজ্জ্বিত ডিনার পার্টি হয়, বেটা রহমত উদ্দিন যেন ডিনার পার্টির টেবিলের উপর থু করে ছিটিয়ে দেয়া একদলা ছেপ! শালা রহমত উদ্দিন!!
আজকে টুম্পাকে বরপক্ষ দেখতে এসেছিল। টুম্পাদের বিশাল সুসজ্জিত ড্রয়িং রুমে কি সুন্দর দামী দামী সব কথা হল!
ছেলের বাবাঃ আমার ছেলের বৌ এর ত আর ডাক্তারি করে পয়সা কামানোর দরকার নাই। বুড়া শ্বশুর কে মাঝে মধ্যে টিপেটুপে দেখবে! আমার বলদ ছেলেটাকে তোমার স্টেথসকোপের সাথে বেঁধে দিলাম বৌমা।
মেয়ের বাবাঃ বেয়াই ত বড়লোক মানুষ। বড় লোকের মন তুষ্ট করার সাধ্যি কি এই গরীবের আছে? তবে ছেলেকে বারিধারার ফ্ল্যাট টাই দেব। মীরপুর শেয়ালবাড়ির টা ছোট মেয়ের জন্য তোলা থাক!
ছেলের মাঃ কত কোটিপতির মাইয়া যে আমার পোলার লেইগা যাচছে তার হিসাব নাইকা। কইছে পোলা কি চায় হেইডা খালি কও? ওইযে আলফ্রাড গাড়ি আছেনা? কইছে হেইটা শুদ্ধ দিমু, ফ্ল্যাট ত আছেই, কইছে যেদিন বিয়া করব, হেই দিন ই ছেলেরে কোম্পানীর এমডি বানায়া দিব! ছেলের বাপে খালি শিক্ষা শিক্ষা কইরা মুখে ফেনা তুইল্লা লাইছে। আমারে কইছে ছুলতানের মাও( ছেলের পুরা নাম সোলতান আহমদ ড়িমন) তুমি বুঝতাছ না কেলা? আওরঙ্গজীব বাই বিরাট সরকারি আমলা। মাত্র দশ লাখ টাকা খায়া উনি যদি আমারে ভেজাল সোয়াবিন তেল কারখানা করার জন্য মন্ত্রনালয়ের অনুমতি লয়া না দিত তাইলে তোমার আর এই বুড়াকালে বিশ ভরি সোনার অলঙ্কার আর দেড় লাখ টাকা দামের শাড়ি পইড়া নাক উঁচু কইরা ছেলের জন্য মেয়ে বাছা লাগত না! আওরঙ্গজীব বাই এর মাইয়াডাও, দেখতে মরিচ চারার মত শুকনা হইলেও স্বভাবে একেবারে ঝাঁঝ ছাড়া পুদিনা পাতা।
মেয়ের মাঃ মরিচ চারার মত শুকনা অইব না ত কি অইব? অ কি কিছু খায়? ডিম খায়না, দুধ খায়না, খাসির রান খায় না, খালি খায় আচার! আরে বেটি আচার খায়া কি গায়ে গোশ হইব?
ছেলের বাবাঃ আরে বেয়ান আপনি কুনো চিন্তা করবেন না। এখন শুকনা থাকলেও বছর ঘুরতেই মা আমার নধর খাসি হইয়া যাইব। বিয়ার পানি পড়লে মনে আসে সুখ। সেই সুখের মধ্যে মোটা হবার ভাইটামিন আছে!
আড়াল থেকে এদের কথাবার্তা সব শুনছিল টুম্পা। কথার মাঝখানে ড়িমন ফোন করেছে। ড়িমন বলেছে-
টুমি কি ফেসবুকে ইন অ্যা রিলেশানশীপ স্টেইটাস ডিয়ে ডিয়েছ? এখনো ডাও নি?
টুম্পা লাইন কেটে দিয়েছে। তার সবকিছু কেমন যেন বেলাইনের মনে হয়েছে। এমন না যে ছেলে কে তার নিজের জন্য অযোগ্য মনে হয়েছে। বড় লোকের ছেলে এটা অবশ্যই প্লাস পয়েন্ট। গরিব রোমান্টিক ছেলে, বাসাবোতে ছয় হাজার টাকা ভাড়া এক কামরার ফ্ল্যাটে তাকে রাখবে। মাসের তেইশ তারিখে বেতনের টাকা শেষ বলে মশার কয়েল কিনার টাকা না থাকায় মশার কামড় খেতে হবে।– এই ধরনের ফালতু রোমান্টিকতায় টুম্পা বিশ্বাস করেনা। কিন্তু তার পরেও!
বর পক্ষ চলে যাবার পর একা একা বাসার ছাদে উঠে যায় টুম্পা। ছাদের উপর অনেকগুলো টব। টবে মরিচের চারা লাগানো হয়েছে। একটা মরিচ ছিঁড়ে নিয়ে কট করে কামড় দেয় টুম্পা। ঝাল খেলে রাগ কাটে- এটা রহমত স্যার বলেছিল। আজ থেকে সাত বছর আগে টুম্পা যখন ক্যাম্ব্রিয়ান স্কুল এন্ড কলেজে এ লেভেল করছে তখন রহমত স্যার টুম্পাকে পড়াত। বুয়েটের হল থেকে খটাং খটাং করে সাইকেল মেরে তাদের ইস্কাটনের বাসায় চলে আসত রহমত স্যার। রহমত স্যারের সাব্জেক্ট ছিল মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং।রেলেহ সাইকেলটার গায়ে পরম আদরে হাত বুলিয়ে উনি বলতেন- এটা আমার মেকানিক্যাল ফ্রেন্ড। চেনে মাঝে মাঝে একটু গ্রীজ দিলেই বিনা আপত্তিতে আমাকে ঢাকা শহরের ছয় কোনায় ছয়টা টিউশনীর বাসায় নিয়ে যায়। রহমত স্যারের প্রেমে কোনদিন পড়ে নাই টুম্পা! এই ব্যাপারে অবশ্য রহমত স্যার নিজেই সাবধান করে দিয়েছিলেন-
বড় লোকের মেয়েদের গরিব প্রাইভেট টিউটরের প্রেমে পড়া একটা বিরাট রোগ। ছেলে বুয়েটে পড়া বিরাট মেধাবী ফেধাবী হলে ত কথাই নাই। তুমি ভুলেও একাজ করনা। আমি বুয়েটে পড়লেও আমার অনেক গুলো সাব্জেক্টে ফেল করে বেড়াছেড়া অবস্থা। দশবছর পরেও দেখবা আমি বাসায় বাসায় টিউশনি করে পেট চালাচ্ছি। কাজেই খুব সাবধান!
হাল্কা চাঁদের আলোয় বাসার সামনের লন টা অন্ধকার কাল কাল লাগছে। সেই অন্ধকার লনের দিকে তাকিয়ে রহমত স্যারের কথা হঠাৎ খুব করে মনে পড়ে টুম্পার। ইস, যদি কোন যাদুমন্ত্র বলে টুং টুং সাইকেলের বেল বাজিয়ে স্যার এখানে চলে আসত! সাইকেল চালিয়ে ক্লান্ত, ঘামে ভেজা স্যারের মুখ টা যেন স্পষ্ট দেখতে পায় টুম্পা। ঘামের গন্ধ টা যেন নাকে লাগে। ঘোর লাগা চোখে টুম্পা তাদের ইস্কাটনের ছোট্ট ফ্ল্যাটে ফিরে যায়। কারেন্ট না থাকায় চার্জারের আলোয় স্যার তাকে পড়াচ্ছিল। পড়াতে পড়াতে গল্পঃ
টুম্পা। দুজন অসম বুদ্ধিমত্তার মানুষের মধ্যে কখনো বন্ধুত্ত্ব হয়না। স্বভাব ভিন্ন হতে পারে, প্রকৃতি ভিন্ন হতে পারে, সামাজিক অবস্থান ভিন্ন হতে পারে, তাতে কোন সমস্যা নাই। কিন্তু বুদ্ধিবৃত্তিক অবস্থান ভিন্ন এরকম দূজন মানুষের মধ্যে স্বস্থিদায়ক কোন বন্ধুত্ত্ব কখনো সম্ভব না।
টুম্পা বার্মিজ আচার খেতে খেতে লজ্জা রাঙা হয়ে( চার্জারের লাইট লজ্জাভা দেখার জন্য যথেষ্ট ছিল না) জিজ্ঞেস করেছিল- স্যার স্বামী স্ত্রীর বুদ্ধি ও কি কাছাকাছি হওয়া উচিত?
রহমত স্যার সিগারেট ধরাতে ধরাতে( টিউশনি নেবার সময় শর্ত দেয়াছিল- পাঁচশ টাকা অকম দেন সমস্যা নাই। কিন্তু পড়ানোর সময় সিগারেট খাওয়া যাবে) বলেছিল- অবশ্যই কাছাকাছি হওয়া উচিত। দুজনের বুদ্ধি বৃত্তিক লেভেল দুরকম হলে যে চালাক সে আজীবন যে বোকা তার সাথে চালাকি করবে। এতে সংসারের ব্যালেন্স শীট নষ্ট হবে। দিনে দিনে একজন হয়ে উঠবে ধুরন্ধর। আরেকজন মহান স্যাক্রিফাইসকারী। প্রকৃতির রুলে স্যাক্রিফাইস বলে কোন শব্দ নাই। স্যাক্রিফাইস শব্দটা হল মনূষ্যসৃষ্ট প্রতারনামূলক একটা শব্দ যেটা প্রকৃতির সংখ্যা রেখার কোথাও অবস্থান করেনা।
- আমার বুদ্ধি কি আপনার বুদ্ধির কাছাকাছি স্যার??
মনে পড়ে এই সাত বছর পরেও কান গরম হয়ে উঠে টুম্পার। এভাবে কি কেউ নিজেকে কখনো প্রকাশ করে? স্যারের সামনে সে ঠিকই প্রমান করে দিল- স্যারের চেয়ে তার বুদ্ধি আসলেই অনেক কম!!
গভীর রাতে বিছানায় শুয়ে কোল বালিশ টাকে বুকে জড়িয়ে ধরে টুম্পা। জানালার স্লাইডিং ডোর টা টেনে দিতেই মাধবী ফুলের ম ম গন্ধে ঘর ভরে যায়! মাধবী ফুলের চারাটা স্যার টুম্পাকে টুম্পার জন্মদিনে গিফট করেছিল। বলছিল- দেখ আমি খুবই কৃপন মানুষ। আজাদ প্রোডাক্ট থেকে তোমার জন্য একটা শো পিস কিনব ভাবছিলাম। সাড়ে তিনশ টাকা দাম চাইল। ভাবলাম- কি হবে এত গুলা টাকা বেহুদা নষ্ট করে। এই টাকা দিয়ে বরং আমার সাইকেলের জন্য লেজার লাইট কিনব। দুই পাশে দুইটা লেজার বীম ওয়ালা এই লাইট নতুন এসেছে। এই মাধবী ফুলের চারাটা ফ্রি তে পেয়েছি। এটাই নিয়ে আসলাম। মাধবী লতা ফ্রি। এটা বড় হয়ে যখন ফুল দেবে, ফুলের গন্ধ ছড়াবে সেটাও ফ্রি!!
মাধবী লতার ম ম গন্ধে টুম্পার বুক হু হু করে উঠে। টুং টুং সাইকেল মেরে স্যার চলে গেছে তার জীবনের গন্তব্যে। ড়ীমনের সাথে আলফার্ড গাড়িতে চড়ে টুম্পার ও হয়ত শুরু হবে জীবনের নতুন গন্তব্য। অথবা নতুন গন্তব্য বলে জীবনে হয়ত কিছু নেই। জীবন বড় সরল রৈখিক। যেকোন একদিকেই শুধু তার চলাচল।
মানুষের স্বাধীনতা বলতে শুধু এই কোল বালিশ টুকু। কোল বালিশ টাকে বুকে জড়িয়ে ধরে এই মুহুর্তে টুম্পা আশ্রয় নিতে পারে টুং টুং সাইকেল ওয়ালা এক খবিশ রসিক যুবকের বুকের তপ্ত নিবিড় উষ্ণতায়। আবার কোল বালিশ টাকে সে ভাবতে পারে তুলতুলে টাকাওয়ালা এক ভদ্রছেলের নিরাপদ সিন্দুকের চাবি! যে চাবি সব সময় নিজের মুঠোয় রাখার মত বুদ্ধি টুম্পার আছে।
কোল বালিশ বুকে জড়িয়ে ধরে সারা পৃথিবীর সাথেই যেন ছলনায় মেতে উঠে টুম্পা। মাধবী ফুলের ম ম গন্ধের সাথে চাঁদের জোছনা মিশে তৈরি করে এক অধরা বাস্তবতা। সেই বাস্তবতায় নিজেকে উদ্যেশ্য করে বলে টুম্পা- আমার বুকে কে আছে সেটা কাউকেই বুঝতে দেব না কোনদিন। জীবনের চলার পথে সাইকেলের টুং টুং বেল বাজবে। কখনো বাজবে আলফার্ড গাড়ির হর্ণ। সবাই জানবে- আমার বুকে আছে শুধু একটা কোলবালিশ!