মোবাইলে নিজের নগ্ন শরীরটা দেখে তুলি অনেকক্ষণ স্তব্ধ হয়ে বসেছিল। কান্নায় ভিজে উঠেছিল দু চোখ। সবাই কেমন যে অন্য নজরে তাকায় তার দিকে। তুলির নিজেকে বড় অসহায় লাগে। বেশ কয়েকবার সুইসাইড করার চেষ্টা করেছিল। বান্ধবীরা বাচিয়ে এনেছে তাকে। তারপর বাসায় যোগাযোগ করে বাসায় পৌছানোর ব্যবস্থা করে। তুলি যেন বোবা হয়ে গেছে। রুমের জানালায় বসে বাইরে আকাশটার দিকে তাকিয়ে থাকে। আর যাতে সুইসাইড এটেম্পট নিতে না পারে সে জন্য মা-বাবা সবসময় পাহারায় রাখে তাকে। মা-বাবার দিকে তাকিয়ে বড় খারাপ লাগে তুলির। তার একটা ভুলের জন্য তারা কারো কাছে মুখ দেখাতে পারছেন না। বেচে থাকতে আর ইচ্ছা করেনা তুলির। পুরুষ জাতিটার কথা মনে হলেই ঘৃণায় কুচকে উঠে মুখ।
দুপুর ২টা বাজে। তুলি বিষন্ন মুখে বসে আছে রুমে। হাতে একটা গল্পের বই। চোখের জল একটু পর পরই বইয়ের পৃষ্টাগুলো ভিজিয়ে দিচ্ছে। এমন সময় বাইরের দরজায় নকের শব্দ হল। কন্ঠ শুনে মনে হল পলাশ ভাই। মার সাথে কি যেন কথা হল। অনেকদিন পর পলাশ ভাইয়ের কন্ঠ শুনে তুলির মনটা কেমন যেন আনন্দে ভরে উঠল। সাথে সাথেই আবার দপ করে নিভে গেল আনন্দ প্রদীপ। পলাশ ভাইতো আর দশটা রুদ্রের মতই হবেন। আলাদা তো নন। ভাবতে ভাবতেই মার সাথে পলাশ ভাই রুমে এসে ঢুকলেন। পলাশ ভাই মাকে বললেন, “আন্টি আপনি যদি কিছু মনে না করেন তাহলে আমি তুলির সাথে একটু একা কথা বলতে চাই।” মা কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে চলে গেলেন। পলাশ ভাই আস্তে আস্তে তুলির দিকে এগিয়ে যান।
- কেমন আছ তুলি? (তুলি কোন কথা বলেনা) শোন তুলি, তোমার সাথে কে কি করল আমি সেটা নিয়ে একটা কথাও বলবনা। আমি তোমাকে সম্পূর্ণ আলাদা কয়টা জিনিস নিয়ে প্রশ্ন করব, আমার প্রতি যদি তোমার বিন্দুমাত্র শ্রদ্ধা থাকে তাহলে তুমি প্লিজ জবাব দিও। বুঝাতে পারলাম?
তুলি হ্যা সূচক মাথা নাড়ে।
-আচ্ছা আমাদের দেশের বেশীরভাগ নেতাই তো নির্বাচনের আগে মিষ্টি মিষ্টি কথা বলে ভোট চায়। ভোটে জেতার পর তো তারা তাদের কথা আর রাখেনা। রাখে?
- উহু
- এদেরকে না ইচ্ছে করে জুতা খুলে দু গালে দুটা বাড়ি দেই। আমাদের কে বোকা বানিয়ে আমাদের সাথে প্রতারণা করে এরা। এই ইচ্ছাটা কি অপরাধ?
- মোটেও না। আমার তো ইচ্ছা করে খুন করে ফেলতে।
- কি বল? সামান্য একটু চুরি বাটপারি করছে বলে একেবারে খুনই করে ফেলবে? এদের কি জীবনের কোন দাম নেই?
- করব না? চোরের জীবনের আর কি দাম?
- নাহ আমি তোমার সাথে একমত না। আচ্ছা ভাল কথা। ঋত্বিকের ‘জিন্দেগী মিলে না দু বারা’ মুভিটা দেখেছো?
- হুমম। ঋত্বিক অনেক সুন্দর।
- কি? ঋত্বিকের প্রেমে পড়েছো মনে হয়। বিয়ে করবে নাকি ঋত্বিক কে?
- কি যে বলেন?
বলতে বলতেই হঠাৎ থমকে যায় তুলি। দুচোখে বর্ষা নামে। দু হাতে মুখ ঢেকে শিশুর মত কাদতে শুরু করে।
পলাশ ভাই তুলির হাত জোড় করে সরিয়ে চোখ মুছে দেন। তারপর বলেন
“শোন তুলি, আমি সব জানি। অই ছেলেটার সাথে ও একটা চোরের, পকেটমারের, অসৎ নেতার কোন পার্থক্য নেই। তোমার দোষটা কোথায়? তুমি একটা ছেলেকে বিশ্বাস করেছো, সে তোমার বিশ্বাস ভেঙে ফায়দা লুটেছে। দোষ তো ছেলেটার। আরেকজনের দোষের জন্য তুমি কেন কষ্ট পাবে? তুমি কেন সুইসাইড করবে? মরা তো উচিত ছেলেটার।”
তুলি : কিন্তু পলাশ ভাই, আমার এখন কি হবে? আমি আর কোন দিন পড়াশোনা করতে ইউনিভার্সিটিতে যেতে পারবনা। সবাই আমার দিকে অন্য নজরে তাকায়। আমাকে কেউ কোনদিন সম্মান করবেনা। কেউ কোনদিন ভালবাসবেনা। আমি কিভাবে বাচব? আমার জন্য বাবা মা বাইরে মুখ দেখাতে পারছেনা।
পলাশ : না তুলি। তুমি সম্পূর্ণ ভুল ভাবছ? আমাদের সমাজটা এমনই। কিন্তু এভাবে তো থাকতে দেয়া যাবেনা। মানুষ কেন তোমাকে ঘৃণা করবে? ঘৃণার পাত্র তো ছেলেটা। তোমাকে অজ্ঞান করে মলম পার্টি সব টাকা পয়সা লুট করে নিয়ে গেছে, এটাতে দোষ কার? তোমার না তাদের? এভাবে ভাবলে হবেনা। তুমি আবার ঢাকায় যাবে, পড়াশোনা শুরু করবে। তুমি শুধু ভাব যে তুমি একটা ছোট্ট ভুল করেছো মানুষ চেনার ব্যাপারে। সেটায় তোমার তেমন কোন ক্ষতিই হয়নি। ভুল থেকেই তো মানুষ শেখে। জীবন অনেক সুন্দর তুলি। একটা বাজে ছেলের জন্য এ জীবনটা নষ্ট করোনা তুলি। তুমি তোমার জীবন সাজাও। আর ওই ছেলের উপর একটা প্রতিশোধ নাও। আমি এবার তোমার সাথে ঢাকায় যাব, থানায় মামলা করব। তাতেও যদি কিছু না হয় দুটা হাত তো আছেই। বুঝতে পেরেছ আমার কথা?
তুলি মাথা নাড়ে। পলাশ ভাই চশমাটা খুলতে খুলতে উঠে দাড়ান। দরজার কাছে যেতে গিয়ে হঠাৎ দাড়িয়ে ঘুরে তাকান। তারপর তুলিকে বলেন,
“আর তোমার একটা প্রশ্নের জবাব দেয়া হয়নি। তুমি বললেনা যে তোমাকে কেউ কোন দিন ভালবাসবেনা, এটা ঠিক না। যদি কখনো তোমার মনে হয় যে পৃথিবীর কোথাও কারো জন্যও একফোটা ভালবাসা অবশিষ্ট নেই, তবুও কষ্ট করে হলেও একবার আমার দুয়ারে এসো। দেখবে এত ভালবাসা জমা আছে তোমার জন্য যেটা পুরো জগৎ খুজেও কেউ কোন দিন পাবেনা। এ বিশাল পৃথিবীর কাছে তুমি হয়তোবা কিছুই না, কিন্তু আমার কাছে তুমিই আমার পৃথিবী।”
বেড়িয়ে যান পলাশ ভাই। তুলি দু মিনিট স্তব্ধ হয়ে বসে থাকে। তারপর চোখের জল মুছে উঠে দাড়ায়। কাপড়-চোপড় গোছাতে হবে। কালই ঢাকা যাবে তুলি। পলাশ ভাইয়ের সাথেই। এই লোকটা এত ভাল কেন?
প্রথম পর্ব
দ্বিতীয় পর্ব