বাস্তব এ গল্পের নায়িকা কাপড় কাঁচতে ভালোবাসে ।
অথচ অধিকাংশের কাছে এটা আতংকের কাজ। বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া নায়িকা রোকেয়া হলের আবাসিক ছাত্রী এবং তার বেলায় এটা কিভাবে প্রিয় কাজের তালিকায় ঢুকে গেলো বলা কঠিন । মন খারাপের বা রাগের সময় তাকে প্রায়ই দেখা যায় চোখ মুখ ফোলা বা কটমট অবস্থায় এক বালতি কাপড় নিয়ে গম্ভীর ভাবে বিশাল ওয়াশরুমের দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকতে এবং ঘন্টা খানেক পরে স্বাভাবিক চেহারায় বের হয়ে আসতে । অবশ্য অত্যাচারিত নিরীহ জামা - কাপড়গুলোর অবস্থা তখন মুমূর্ষু ।
একদিন বালতি ভর্তি কাপড় নিয়ে ওয়াশরুমে ঢোকার আগ মুহূর্তে একটা ফোন আসলো ।
- তুমি কি ব্যস্ত?
- আমি ব্যস্ত না, মহা ব্যস্ত । বক্তব্য সংক্ষেপে উপস্থাপন করো ।
- আমি তো তোমার হলের সামনে । কাজ একটু পরে করা যায় না?
- হলের সামনে মানে?..... আমি এক বালতি কাপড় ভিজিয়ে ফেলেছি । না ধুয়ে বের হওয়া যাবে না ।
নায়কের নিজেকে সামলাতে একটু সময় লাগে ।
- তোমার ব্যস্ততা কাপড় ধোঁয়া?
- হু । কোন সমস্যা? থাকলে বলো তোমাকেও হুইল ওয়াশিং পাউডার দিয়ে হোয়াইট ওয়াশ করে দেই ।
পাগল ক্ষ্যাপালে জীবন নিয়ে টানাটানি পড়ার সম্ভবনা । নায়ক ফোনের ওপাশে রাগে দাঁত কিড়মিড় করলেও স্বাভাবিক গলায় বললো,
- নাহ সমস্যা হবে কেন? এটা তো জাতীয় স্বার্থসংশ্লিষ্ট পর্যায়ের গুরুত্বপূর্ণ কাজ । তা কতক্ষন লাগবে শেষ হতে?
- টিটকারি দিচ্ছো তাই না? দেড় ঘন্টা পর বের হচ্ছি। আমি আসার পর এই বক্তব্য এক্সপাঞ্জ না করলে সংসদে তোমার সদস্যপদ বাতিল।
- দেড় ঘন্টা!! এতোক্ষন আমি একাএকা কী করবো??
- ঘুরাঘুরি করো, হাওয়া খাও। আমার দেড় ঘন্টাই লাগবে। আমাকে টিটকারি দেওয়ার অপরাধে আজকে তোমার কোর্ট মার্শাল। গেট রেডি।
ফোনটা রাখার পর নায়িকা আপন মনে কতক্ষন মিটিমিটি করে হাসলো। আহারে! বেচারা এমনিতেই তাকে যথেষ্ট ভয় পায়। কোর্ট মার্শালের কথায় তো নির্ঘাত পানির পিপাসা পেয়ে যাবে!
কোন কাজ না থাকলে দেড় ঘন্টা সময় কাটানো বিশাল সমস্যার ব্যাপার । নায়ক কি করবে ভেবে পেলো না। ক্যাম্পাসে সে কাউকে চেনে না যে গল্প করে সময় কাটাবে। হলের দারোয়ান এরই মধ্যে গেটের ফাঁক দিয়ে চোখ সরু করে সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে। সময় কাটানোর জন্যে টিএসসিতে কিছুক্ষন বসে থাকা হলো। সময় তো কাটলোই না, বরং আশেপাশের মানুষদের ব্যস্ততা যেন তার ঘড়ির কাঁটাকে করে দিলো নিশ্চল। করার মতো আর কিছু না পেয়ে বেচারা ঘন্টা খানেক কাজী নজরুলের মাজারের পাশের মসজিদে গিয়ে ঘন্টা খানেক ঘুমানোর বৃথা চেষ্টা করে মেজাজ খিটখিটে করে ফেললো।
আর ওদিকে নায়িকার কাজ এক ঘন্টার মধ্যেই শেষ হলেও সে ইচ্ছা করে আধ ঘন্টা পরে বের হলো। নিজের কাছের মানুষটাকে জ্বালানো তার অত্যন্ত প্রিয় কাজ ।
দেখা হওয়ার পর ছেলেটা প্রথমেই চোখ মুখ অন্ধকার করে বললো,
- দেড়টা ঘন্টা অপেক্ষা করালা!
মেয়েটাও হাসিহাসি মুখে গলায় কপট রাগ ফুটিয়ে জবাব দেয় সাথেসাথেই ।
- তো? আমি যে তোমাকে এক জীবন অপেক্ষা করিয়ে রাখি নি তারজন্যে ধন্যবাদ দাও । আর চোখ মুখ শুকনো কেন? সারাদিন কিছু খাও নাই নাকি পেট ব্যথা?
এই আক্রমনের পাল্টা আক্রমনে কি বলা যায় ছেলেটা কিছুক্ষন ভাবলো । মাথায় কিছু আসলো না, কিন্তু কেন যেন মুখে হাসি চলে আসলো । হাসতে হাসতে সে পূর্ণ দৃষ্টিতে পাশে দাড়ানো মানবীর চোখে চোখ রাখে । নিশ্চয়ই তার তখন মনে হয় পৃথিবীতে বেঁচে থাকাটা খুব একটা খারাপ না।
.......... গল্পটা মেয়েটার মুখ থেকেই শুনছিলাম । এ পর্যন্ত বলে সে চুপ হয়ে গেলো । আমি ব্যগ্র হয়ে জানতে চাইলাম,
- তারপর?
জবাবটা দেয়ার আগে মানুষটা জীবনে দেখার অভিজ্ঞতা আছে এমন মানুষদের হাসি হাসে। এক চিলতে হাসি, মনে যার রেশ রয়ে যায় বহুক্ষণ।
- তার আর পর নেই ।
আমার মন বিষণ্ন হয় । পৃথিবীর সব সুন্দরতম সম্পর্ক, গল্পগুলো কেন পূর্ণতা পাওয়ার আগেই সমাপ্ত হয়ে যায় - সে প্রশ্নের জবাব বহু খুঁজে আজও পাই নি ।
বাচ্চা এক ফুলওয়ালী এসে রিনরিনে গলায় তার হাতে ধরা ফুলের তোড়াটা বাড়িয়ে দিয়ে বললো কিনবো কিনা । গোলাপ বা রজনীগন্ধা না, কনক চাঁপা । ফুল কেনার ইচ্ছা ছিলো না বলে তাকে ফিরিয়ে দিলাম । সে একটু মন খারাপ করে সামনে চলে গেলো এবং তখনই বাতাসে ফুলগুলোর চমৎকার ঘ্রাণ পেলাম । পিছু ফিরে দেখি ফুলওয়ালী ততক্ষণে বেশ দূরে চলে গেছে । আশেপাশের গাড়ির শব্দে আমার ডাক আর তার কানে পৌছবে না । বেশ আফসোস হলো ।
পৃথিবীতে সময় মতো সম্পর্ক, অনুভূতি, আবেগ - এসবের যথাযথ মূল্য বুঝতে না জানা বা চাওয়া উদাসীন মানুষদের দেখলেই চিনতে পারার মতো কোন ব্যবস্থা থাকা উচিত ছিলো । কারণ এরা হারানোর পর আফসোস করে আর গল্পের নায়িকার মতো অনুভূতিপ্রবণ মানুষগুলোর মধ্যেও অন্যায়ভাবে শূণ্যতা তৈরি করে যায় । প্রথমটা তাদের প্রাপ্য, কিন্তু দ্বিতীয়টা ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ ।
গন্তব্যে বিদায় নিয়ে বাড়ির দিকে হেঁটে রওনা হলাম। হঠাৎ কি মনে করে একটু পিছু ফিরে তাকিয়ে দেখি মানুষটা আকাশের দিকে মুখ করে চুপচাপ সম্মোহিতর মতো দাড়িয়ে আছে । সন্ধ্যার আকাশে অন্ধকার ঘনাচ্ছে, একটু পরই একটা দুটো করে তারারা উঁকি দিতে শুরু করবে । মানুষটা বেশ কিছুক্ষণ আকাশ দেখলো, তারপর ধীর পায়ে হাঁটতে শুরু করলো ।
ইদানীং পিছু না ফিরে সে একা একা পথ চলতে অভ্যস্ত হয়ে গেছে ।