somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

কিছু প্রিয় বইয়ের রিভিউ ০৯ঃ চৌরঙ্গী

১৮ ই ডিসেম্বর, ২০১৫ রাত ১০:০৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



বইয়ের নামঃ চৌরঙ্গী
লেখকঃ শংকর
প্রথম প্রকাশঃ ১৯৬২, কলিকাতা
বাংলাদেশী সংস্করণঃ দি ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড, ২০১০

ছোট বেলা থেকে মায়ের মুখে একটা কথা প্রায়ই শুনি । জীবন কে খুব প্রকটভাবে তিন জায়গায় দেখা যায় – হাসপাতাল, কবরস্থান, জেলখানা । আমার আটপৌরে মা সম্ভবত আরেকটা জায়গার নাম উল্লেখ করতে ভুলে গেছেন বা স্বেচ্ছায়ই বলেন নি – আবাসিক হোটেল । সু-সাহিত্যিক শংকরের অনবদ্য সৃষ্টি “ চৌরঙ্গী “ কলকাতার সবচেয়ে অভিজাত এবং প্রাচীন ঐতিহ্যমণ্ডিত “ হোটেল শাজাহান ”- কে নিয়ে ।

অল্প বয়সেই বাবার মৃত্যুর পর বেঁচে থাকার সংস্থানের আশায় লেখককে পৃথিবীর পথে নেমে পড়তে হয়েছিল । তারপর তো কত কিছুই করেছেন পেটের ক্ষুধা মেটাতে; কখনও প্রাইভেট টিউশনি, কখনও পাটের দালালের কেরানী, কখনও কোর্টের ব্যারিস্টারের বাবুগীরি, নয়তো বা বা ক্লিনারের কাজ । হোটেল শাজাহানে চাকরি পাওয়ার আগে করতেন ফেরিওয়ালার কাজ । অফিসে অফিসে গিয়ে ময়লা কাগজ ফেলার তারের ঝুড়ি বিক্রি ; প্রতি ঝুড়ির দাম এক টাকা , আর তাতে তার কমিশন চার আনা ।

“ .... ঝুড়ি হাতে আপিসে আপিসে ঘুরেছি আর বাবুদের টেবিলের তলায় তাকিয়েছি । অনেকে সন্দিগ্ধভাবে জিজ্ঞেস করেছেন, ‘ ওখানে কি দেখছো? ‘
বলেছি, ‘ আজ্ঞে আপনার ছেঁড়া কাগজ ফেলবার ঝুড়িটা । ‘
সেটা জরাজীর্ণ দেখলে কি আনন্দই যে হয়েছে! বলেছি, ‘ আপনার ঝুড়িটার আর কিছুই নেই । একটা নতুন নিন না, স্যর । ‘
বড়বাবু ঝুড়িটার দিকে দৃষ্টিপাত করে বলেছেন, ‘ কন্ডিশন তো বেশ ভালোই রয়েছে । এখনও হেসে – খেলে বছর খানেক চলে যাবে । ‘
বড়বাবুর মুখের দিকে করুণভাবে তাকিয়ে থেকেছি । কিন্তু আমার মনের কথা তিনি বুঝতে পারেন নি । চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে হয়েছে , ‘ ঝুড়িটার না হয় হেসে – খেলে আরও বছরখানেক চলে যাবে । কিন্তু আমার? আমার যে আর একদিনও চলতে চাইছে না । “

জীবনের প্রতি বিতৃষ্ণা এসে যাওয়ার মতো জীবন সংগ্রামে লেখক যখন ক্লান্ত তখন নেহায়েত কপাল জোরে পেলেন অভিজাত হোটেল শাজাহানের রিসেপশনে চাকরি । তারপর কাউণ্টারের এপাশে দাড়িয়ে দাড়িয়ে দেখলেন নানা দেশের, রঙের মানুষদের; আরও একবার জানলেন কতো অদ্ভুত হয় মানুষের জীবন । চৌরঙ্গী সেসব অসামান্য গল্পেরই বর্ণনা ।

চৌরঙ্গী হোটেল ম্যানেজার মার্কোপোলো সাহেবের গল্প যিনি হন্যে হয়ে খুঁজে বেড়ান তার প্রিয়জনকে কেবলই তাকে আরেকবার হারিয়ে ফেলার জন্য, কিন্তু খুঁজে পান না । আছেন সহকর্মী অসাধারণ এক মানুষ সত্যসুন্দর বোস, যার নামও এখন বদলে গেছে মিঃ স্যাটা-য় । তিনি যেন নেপথ্যের কোলাহলই কেবল, সবখানেই আছেন আবার কোন খানেই নেই ।

চৌরঙ্গী গ্রিক ভাস্কর্যের মতো অপরূপ সৌন্দর্যের মানুষ ডঃ সাদারল্যান্ডেরও গল্প । জীবন সমুদ্রে পথ হারিয়ে অন্যদের পথ দেখিয়ে বেড়ানো এক দিক শুন্য নাবিক তিনি ।

এক নম্বর স্যুইটে কোন কোন রাতে কালো চশমা চোখে এসে ওঠেন মধ্যবয়সী মিসেস পাকড়াশি, সমাজসেবী আর গুণী স্ত্রী হিসেবে যার জুড়ি মেলা ভার । তিনি আসার কিছুক্ষণ পর এসে হাজির হয় এক ইংরেজ যুবক – যার নাম রবার্টসন । দুই নাম্বার স্যুইটে স্থায়ীভাবে থাকেন করবী গুহ, যিনি প্রতি রাতে একবার মারা যান আবার বেঁচে ওঠেন সকালে ।

একদিন সুদূর স্পেন থেকে ধনী মাতালদের বিনোদন দিতে উড়ে আসে নর্তকী কনি, দ্যা উইমেন । অর্থের জন্য আলো আঁধারিতে সর্বাঙ্গে বেলুন পড়ে তাকে ঘুরে বেড়াতে হয় সমাজের নামকরা সব মানুষদের সামনে । মদ্যপ মানুষের হাতের খোঁচায় একে একে কমে আসে তার শরীরের বাস আর তা দেখে রাগে উন্মাদ হয়ে ওঠে কনির বামন সঙ্গি ল্যামব্রেটা । তারসাথে কনির সম্পর্ক কি তা কেউ জানে না । ওদিকে বেয়ারা গুড়বেড়িয়া স্বপ্ন দেখে সে বিয়ে করবে শাজাহানের দামি এক কেক দিয়ে । ব্যান্ড দলের সামান্য আয়ের প্রধান গোমেজ স্বপ্ন দেখে মোজার্ট, বিথোফেনদের মতো কেউ হওয়ার । ধুমকেতুর মতো এসে হাজির হন সুজাতাদি , বোসদা কে তিনি নতুন করে বাঁচতে বলেন । মুক্তির ডাক একদিন আসে বন্দিনী করবী গুহুর জীবনেও .. কি হয় তাদের?

আছেন বুড়ো হবস, সরাবজি, রোজি, উইলিয়ম, লিজা সহ আরও অনেকে, প্রত্যেকে তাদের জীবনের নানা গল্প নিয়ে । চৌরঙ্গী উপন্যাস যেন বাস্তবের ব্যস্ত রাজপথ চৌরঙ্গীর মতোই এক জায়গা, যেখানে এসে মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে মানুষের হাসি, কান্না, ভালোবাসা, পাওয়ার আনন্দ আর হারানোর বেদনার গল্প ... মানুষের গল্প । যে গল্পের শেষ নেই ।

খুব অল্প সংখ্যক কিছু লেখকের লেখা আমার পড়ার সৌভাগ্য হয়েছে যারা তাদের লেখায় জটিল কোন ধারণা, তত্ত্ব, লোমহর্ষক ঘটনা, যৌনতা, মাত্রাতিরিক্ত হাস্যরসের কিছুই না এনেও এমন এক পথে হেঁটেছেন যা তাদের রচনাকে অবলীলায় অসাধারণের আসনে বসিয়ে দিয়েছে । তারা তাদের লেখনীর সাবলীলতায় পাঠককে ধরে রাখেতে সফল হয়েছেন একদম শুরুর লাইনটা থেকে সর্বশেষ লাইনটা পর্যন্ত, মন্ত্রমুগ্ধে করে । পড়তে পড়তে কখন যে অপরিচিত চরিত্ররা পাঠকের স্বজন হয়ে ওঠেন বোঝাই যায় না । সেসব চরিত্ররা তাদের গল্প দিয়ে পাঠক - পাঠিকাদের কখনও হাসান, কখনও নীরবতায় বিহ্বল করে দেন, কখনও বা নতুন করে নিজের জীবন নিয়ে অজান্তেই ভাবান আরেকবার ।

বাংলা সাহিত্যের অসাধারণ এ ক্লাসিক দশকের পর দশক ধরে দুই বাংলার পড়ুয়াদের মুগ্ধ করে আসছে । আশা করি বইটা আপনারও ভালো লাগবে ।

হ্যাপি রিডিং :)
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই ডিসেম্বর, ২০১৫ রাত ১১:৫৬
১২টি মন্তব্য ১২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ক- এর নুডুলস

লিখেছেন করুণাধারা, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ৮:৫২



অনেকেই জানেন, তবু ক এর গল্পটা দিয়ে শুরু করলাম, কারণ আমার আজকের পোস্ট পুরোটাই ক বিষয়ক।


একজন পরীক্ষক এসএসসি পরীক্ষার অংক খাতা দেখতে গিয়ে একটা মোটাসোটা খাতা পেলেন । খুলে দেখলেন,... ...বাকিটুকু পড়ুন

কারবারটা যেমন তেমন : ব্যাপারটা হইলো কি ???

লিখেছেন স্বপ্নের শঙ্খচিল, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:০২

কারবারটা যেমন তেমন : ব্যাপারটা হইলো কি ???



আপনারা যারা আখাউড়ার কাছাকাছি বসবাস করে থাকেন
তবে এই কথাটা শুনেও থাকতে পারেন ।
আজকে তেমন একটি বাস্তব ঘটনা বলব !
আমরা সবাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

স্প্রিং মোল্লার কোরআন পাঠ : সূরা নং - ২ : আল-বাকারা : আয়াত নং - ১

লিখেছেন মরুভূমির জলদস্যু, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ১০:১৬

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম
আল্লাহর নামের সাথে যিনি একমাত্র দাতা একমাত্র দয়ালু

২-১ : আলিফ-লাম-মীম


আল-বাকারা (গাভী) সূরাটি কোরআনের দ্বিতীয় এবং বৃহত্তম সূরা। সূরাটি শুরু হয়েছে আলিফ, লাম, মীম হরফ তিনটি দিয়ে।
... ...বাকিটুকু পড়ুন

কুরসি নাশিন

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৯ শে মে, ২০২৪ সকাল ১১:১৫


সুলতানি বা মোগল আমলে এদেশে মানুষকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছিল৷ আশরাফ ও আতরাফ৷ একমাত্র আশরাফরাই সুলতান বা মোগলদের সাথে উঠতে বসতে পারতেন৷ এই আশরাফ নির্ধারণ করা হতো উপাধি... ...বাকিটুকু পড়ুন

বসন্ত বিলাসিতা! ফুল বিলাসিতা! ঘ্রাণ বিলাসিতা!

লিখেছেন নাজনীন১, ১৯ শে মে, ২০২৪ বিকাল ৪:০৯


যদিও আমাদের দেশে বসন্ত এর বর্ণ হলুদ! হলুদ গাঁদা দেখেই পহেলা ফাল্গুন পালন করা হয়।

কিন্তু প্রকৃতিতে বসন্ত আসে আরো পরে! রাধাচূড়া, কৃষ্ণচূড়া এদের হাত ধরে রক্তিম বসন্ত এই বাংলার!

ঠান্ডার দেশগুলো... ...বাকিটুকু পড়ুন

×