somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

জনাব হুমায়ুন আহমেদ, আমরা আপনার স্বপ্নের সংগে আছি !

০২ রা নভেম্বর, ২০১১ সকাল ৯:০৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

আমাদের প্রিয় কথা সাহিত্যক, নাট্যকার, প্রিয় শিক্ষক জনাব হুমায়ুন আহমেদ আজ ২রা নভেম্বর ২০১১, প্রথম আলোতে “ নো ফ্রি লাঞ্চ” শিরনামে লিখেছেন-।
ছোট লেখাটিতে তিনি অনেক কথা বুঝিয়েছেন। পরিশেষে তিনি নিজ মাতৃভূমিতে একটি সর্বাধুনিক ক্যান্সার হাসপাতাল এর প্রত্যাশা করেছেন।
জনাব হুমায়ুন আহমেদ, আমরা যারা কিঞ্চিত আয়ে দিন গুজরান করি, আর্থিক পাহাড়ের স্বপ্ন দেখিনা, তারা যদি একটি পয়সা নিয়ে এগিয়ে আসি তাহলেও আপনার প্রত্যাশা যা আমাদের ও প্রত্যাশা তা পুরন হয়। দরকার শুধু উদ্যোগের, একজন উদ্যোগি মানুষের।

হুমায়ুন আহমেদ এর লেখাটি -

"নো ফ্রি লাঞ্চ"
হুমায়ূন আহমেদ
‘নো ফ্রি লাঞ্চ’—একটি আমেরিকান বাক্য। এই বাক্যটা বলে তারা এক ধরনের শ্লাঘা অনুভব করে। তারা সবাইকে জানাতে পছন্দ করে যে তারা কাজের বিনিময়ে খাদ্যে বিশ্বাসী।
এই ধরনের বাক্য বাংলা ভাষাতেও আছে—‘ফেলো কড়ি মাখো তেল’। গায়ে তেল মাখতে হলে কড়ি ফেলতে হবে। আরামের বিনিময়মূল্য লাগবে। যা-ই হোক, ফ্রি লাঞ্চে ফিরে যাই। নো ফ্রি লাঞ্চের দেশে চিকিৎসা করতে ব্যাগ ভর্তি ডলার নিয়ে যেতে হবে, এই তথ্য আমি জানি। তবে বিকল্প ব্যবস্থাও আছে। বুকে প্রচণ্ড ব্যথা বলে যেকোনো হাসপাতালের ইমার্জেন্সিতে নিয়ে যেতে হবে। বুকে ব্যথা মানে হার্ট অ্যাটাক। হাসপাতাল হেলথ ইনস্যুরেন্স আছে কি নেই তা না দেখেই রোগী ভর্তি করবে। চিকিৎসা শুরু হবে। চিকিৎসার একপর্যায়ে ধরা পড়বে রোগীর হয়েছে ক্যানসার। হাসপাতাল তখন ক্যানসারের চিকিৎসা শুরু করবে। রোগীকে ধাক্কা দিয়ে হাসপাতালের ফুটপাতে ফেলে দেবে না। চিকিৎসা শেষ হওয়ার পর বলতে হবে, আমি কপর্দকশূন্য। এক মিলিয়ন ডলার বিল আমি দেব, তবে একসঙ্গে দিতে পারব না। ভেঙে ভেঙে দেব। প্রতি মাসে পাঁচ ডলার করে। এই প্রস্তাবে রাজি হওয়া ছাড়া হাসপাতালের তখন আর করার কিছু থাকে না। বাংলাদেশিদের কাছে এই বিকল্প চিকিৎসাব্যবস্থা সংগত কারণেই বেশ জনপ্রিয়।
বাঙালি ব্যবস্থায় আমি চিকিৎসা শুরু করব, এই প্রশ্নই ওঠে না। সমস্যা হচ্ছে, বিপুল অঙ্কের অর্থও তো আমার নেই।
আমার দুটো গাড়ি। দুটোই বিক্রির জন্য পাঠানো হলো। একটা বিক্রি হলো। দখিন হাওয়ার যে ফ্ল্যাটে থাকি, সেটা বিক্রির চেষ্টা করলাম। পারলাম না, ফ্ল্যাটবাড়ি নিয়ে কিছু আইনগত জটিলতা আছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে উত্তরায় পাঁচ কাঠার একটা জমি পেয়েছিলাম। সেই জমি বিক্রির জন্য বিজ্ঞাপন দিলাম। লাভ হলো না। বাকি থাকল নুহাশ পল্লী। অর্থ সংগ্রহের ছোটাছুটির একপর্যায়ে অন্যপ্রকাশের মাজহার বলল, আপনি কেন অস্থির হচ্ছেন? আমি তো আপনার সঙ্গে যাচ্ছি। আপনার চিকিৎসার অর্থ কীভাবে আসবে, কোত্থেকে আসবে তা দেখার দায়িত্ব আমার। আপনার না।
আমি বললাম, টাকা কীভাবে জোগাড় করবে? ভিক্ষাবৃত্তি? চাঁদা তুলবে?
মাজহার বলল, না। আমি আপনাকে কথা দিচ্ছি, কারও কাছ থেকে এক ডলার সাহায্য নেব না। এই মুহূর্তে আমার হাতে ৫০ হাজার আমেরিকান ডলার আছে।
আমি বললাম, দেখাও।
মাজহার বলল, দেখাতে পারব না। ৫০ হাজার ডলার নিউইয়র্কে আপনার জন্য আলাদা করা। চ্যানেল আইয়ের সাগর ভাই আপনার জন্য আলাদা করে রেখেছেন। সাহায্য না, ঋণ। পরে শোধ দেবেন।
আমি খানিকটা ভরসা পেলাম। চ্যানেল আইয়ের সাগরের অনেক বদভ্যাসের (!) একটি হলো শিল্প-সাহিত্যের কেউ বিপদে পড়লে তাকে উদ্ধারের জন্য ঝাঁপিয়ে পড়া। এই কাজ অতীতেও সে অনেকবার করেছে। এখনো করছে। ভবিষ্যতেও করবে কি না জানি না। ইতিমধ্যে তার উচিত শিক্ষা হয়ে যাওয়ার কথা।
আমেরিকায় অর্থ ব্যয়ের একটি নমুনা দেওয়া যেতে পারে। হিসাবটা বাংলাদেশি টাকায় দিই।
স্লোয়ান কেটারিং মেমোরিয়ালের ডাক্তাররা আমার কাগজপত্র দেখবেন। রোগ নিয়ে কথাবার্তা বলবেন। শুধু এই জন্য তিন লাখ টাকা জমা দিতে হলো।
ডাক্তার শরীরে মেডিপোর্ট বসানোর জন্য Radio ল্যাবে পাঠালেন। (মেডিপোর্টের মাধ্যমে কেমোথেরাপি শুরু হবে) মেডিপোর্ট বসানোর খরচ হিসেবে জমা দিতে হলো আট লাখ টাকা।
মেডিপোর্ট বসানোর পরদিন কেমো শুরু হবে। আটটি কেমোর পুরো খরচ একসঙ্গে দিতে হবে। টাকার পরিমাণ এক কোটি টাকা। ভাগে ভাগে দেওয়ার কোনো ব্যবস্থা নেই।
শাওন ও মাজহার দুজনেরই দেখি মুখ শুকনো। নিশ্চয়ই কোনো একটা সমস্যা হয়েছে। যেহেতু তারা আমাকে বলেছে, টাকা-পয়সার বিষয় নিয়ে আমি যেন চিন্তা না করি, আমি তাই চিন্তা করছি না।
কেমোথেরাপি দিতে এসেছি। কেমোথেরাপির ডাক পড়বে, ভেতরে যাব। ডাক পড়ছে না। একা বসে আছি। শাওন আমার সঙ্গে নেই। সে মাজহারের সঙ্গে ছোটাছুটি করছে। শাওন চোখ লাল করে কিছুক্ষণ পরপর আসছে, আবার চলে যাচ্ছে।
একটা পর্যায়ে শাওন ও মাজহার দুজনকে ডেকে বললাম, ‘মার্ফিস ল’ বলে একটি অদ্ভুত আইন আছে। মার্ফিস ল বলে—If any thing can go wrong, it will go wrong. আমি পরিষ্কার বুঝতে পারছি, কোনো একটা সমস্যা হয়েছে। সমস্যাটা বলো। টাকা কম পড়েছে?
মাজহার বলল, হ্যাঁ। চ্যানেল আইয়ের টাকাটা এই মুহূর্তে পাওয়া যাচ্ছে না। হাসপাতালে আমরা অর্ধেক, অর্থাৎ ৫০ লাখ টাকা দিতে চাই, ওরা নেবে না। হাসপাতাল বলছে, পুরো টাকা নিয়ে আসো, তারপর চিকিৎসা শুরু হবে। আমি বললাম, চলো, ফিরে যাই। টাকা জোগাড় করে চিকিৎসার জন্য আসব।
শাওন বলল, তোমার চিকিৎসা আজই শুরু হবে। কীভাবে হবে আমি জানি না, কিন্তু আজই হবে।
শাওন বাচ্চাদের মতো কাঁদতে শুরু করল। আমি বললাম, তুমি সবার সামনে কাঁদছ। বাথরুমে যাও। বাথরুমে দরজা বন্ধ করে কাঁদো।
সে আমার সামনে থেকে উঠে বাথরুমে ঢুকে গেল। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই আমার ডাক পড়ল, কেমোথেরাপি শুরু হবে। টাকা বাকি থাকতেই শুরু হবে।
সমস্যার সমাধান করলেন পূরবী দত্ত। তিনি হাসপাতালকে বোঝাতে সমর্থ হলেন যে হুমায়ূন আহমেদ নামের মানুষটি চিকিৎসা নিয়ে পালিয়ে যাওয়ার মানুষ না। তিনি অবশ্যই প্রতিটি পাই-পয়সা শোধ করবেন।
হাসপাতাল চিকিৎসার পুরো টাকা শুরুতেই কেন নিয়ে নেয় তা ব্যাখ্যা করি। অনেক রোগী একটি কেমোর টাকা জোগাড় করে কেমো নিয়ে হাসপাতালের বিরুদ্ধে মামলা করে দেয়। সে বলে, আমার আর টাকা নেই বলে কেমো নিতে পারছি না। আমার চিকিৎসা অসম্পূর্ণ। আমেরিকান হাসপাতাল চিকিৎসা অসম্পূর্ণ রাখতে পারে না।

পাদটীকা
সর্বাধুনিক, বিশ্বমানের একটি ক্যানসার হাসপাতাল ও গবেষণাকেন্দ্র কি বাংলাদেশে হওয়া সম্ভব না? অতি বিত্তবান মানুষের অভাব তো বাংলাদেশে নেই। তাঁদের মধ্যে কেউ কেন স্লোয়ান বা কেটারিং হবেন না? বিত্তবানদের মনে রাখা উচিত, কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা ব্যাংকে জমা রেখে তাঁদের একদিন শূন্য হাতেই চলে যেতে হবে। বাংলাদেশের কেউ তাঁদের নামও উচ্চারণ করবে না। অন্যদিকে আমেরিকার দুই ইঞ্জিনিয়ার স্লোয়ান ও কেটারিংয়ের নাম তাঁদের মৃত্যুর অনেক পরেও আদর-ভালোবাসা ও শ্রদ্ধার সঙ্গে সমস্ত পৃথিবীতে স্মরণ করা হয়।
আমি কেন জানি আমেরিকায় আসার পর থেকেই স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছি, হতদরিদ্র বাংলাদেশ হবে এশিয়ায় ক্যানসার চিকিৎসার পীঠস্থান।
যদি বেঁচে দেশে ফিরি, আমি এই চেষ্টা শুরু করব। আমি হাত পাতব সাধারণ মানুষের কাছে।
৮টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

জামাত কি দেশটাকে আবার পূর্ব পাকিস্তান বানাতে চায়? পারবে?

লিখেছেন ঋণাত্মক শূণ্য, ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৭:২৮

অন্য যে কোন সময়ে জামাতকে নিয়ে মানুষ যতটা চিন্তিত ছিলো, বর্তমানে তার থেকে অনেক বেশী চিন্তিত বলেই মনে করি।



১৯৭১ এ জামাতের যে অবস্থান, তা নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের অস্তিত্বের বিরুদ্ধে... ...বাকিটুকু পড়ুন

১৯৭১ সালে পাক ভারত যুদ্ধে ভারত বিজয়ী!

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৯


দীর্ঘ ২৫ বছরের নানা লাঞ্ছনা গঞ্জনা বঞ্চনা সহ্য করে যখন পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বীর বাঙালী অস্ত্র হাতে তুলে নিয়ে বীরবিক্রমে যুদ্ধ করে দেশ প্রায় স্বাধীন করে ফেলবে এমন সময় বাংলাদেশী ভারতীয়... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইন্দিরা গান্ধীর চোখে মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশ-ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক: ওরিয়ানা ফলাচির সাক্ষাৎকার

লিখেছেন শ্রাবণধারা, ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১১:৫৫


১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ইতালীয় সাংবাদিক ওরিয়ানা ফলাচি ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সাক্ষাৎকার নেন। এই সাক্ষাৎকারে মুক্তিযুদ্ধ, শরনার্থী সমস্যা, ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক, আমেরিকার সাম্রাজ্যবাদী পররাষ্ট্রনীতি এবং পাকিস্তানে তাদের সামরিক... ...বাকিটুকু পড়ুন

=যাচ্ছি হেঁটে, সঙ্গে যাবি?=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সন্ধ্যা ৭:০৬


যাচ্ছি হেঁটে দূরের বনে
তুই কি আমার সঙ্গি হবি?
পাশাপাশি হেঁটে কি তুই
দুঃখ সুখের কথা ক'বি?

যাচ্ছি একা অন্য কোথাও,
যেখানটাতে সবুজ আলো
এই শহরে পেরেশানি
আর লাগে না আমার ভালো!

যাবি কি তুই সঙ্গে আমার
যেথায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

আগামী নির্বাচন কি জাতিকে সাহায্য করবে, নাকি আরো বিপদের দিকে ঠেলে দিবে?

লিখেছেন জেন একাত্তর, ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৮:১২



আগামী নির্বচন জাতিকে আরো কমপ্লেক্স সমস্যার মাঝে ঠেলে দিবে; জাতির সমস্যাগুলো কঠিন থেকে কঠিনতর হবে। এই নির্বাচনটা মুলত করা হচ্ছে আমেরিকান দুতাবাসের প্রয়োজনে, আমাদের দেশের কি হবে, সেটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

×