১
চিত্ত পিপাসিত রে
গীতসুধার তরে ॥
তাপিত শুষ্কলতা বর্ষণ যাচে যথা
কাতর অন্তর মোর লুন্ঠিত ধূলি-’পরে
গীতসুধার তরে ॥
আজি বসন্তনিশা, আজি অনন্ত তৃষা,
আজি এ জাগ্রত প্রাণ তৃষিত চকোর-সমান
গীতসুধার তরে ।
চন্দ্র অতন্দ্র নভে জাগিছে সুপ্ত ভবে,
অন্তর বাহির আজি কাঁদে উদাস স্বরে
গীতসুধার তরে ॥
২
আমার মনের মাঝে যে গান বাজে শুনতে কি পাও গো
আমার চোখের ’পরে আভাস দিয়ে যখনি যাও গো ॥
রবির কিরণ নেয় যে টানি ফুলের বুকের শিশিরখানি,
আমার প্রাণের সে গান তুমি তেমনি কি নাও গো ॥
আমার উদাস হৃদয় যখন আসে বাহির-পানে
আপনাকে যে দেয় ধরা সে সকলখানে ।
কচি পাতা প্রথম প্রাতে কী কথা কয় আলোর সাখে,
আমার মনের আপন কথা বলে যে তাও গো ॥
৩
কাহার গলায় পরাবি গানের রতনহার,
তাই কি বীণায় লাগালি যতনে নূতন তার ॥
কানন পরেছে শ্যামল দুকূল, আমের শাখাতে নূতন মুকুল,
নবীনের মায়া করিল আকুল হিয়া তোমার ॥
যে কথা তোমার কোনোদিন আর হয় নি বলা
নাহি জানি কারে তাই বলিবারে করে উতলা !
দখিনপবনে বিহ্বলা ধরা কাকলিকূজনে হয়েছে মুখরা,
আজি নিখিলের বাণীমন্দিরে খুলেছে দ্বার ॥
৪
যে ছায়ারে ধরব বলে করেছিলেম পণ
আজ সে মেনে নিল আমার গানেরই বন্ধন ॥
আকাশে যার পরশ মিলায় শরতমেঘের ক্ষণিক লীলায়
আপন সুরে আজ শুনি তার নূপুরগুঞ্জন ॥
অলস দিনের হাওয়ায়
গন্ধখানি মেলে যেত গোপন আসা-যাওয়ায় ।
আজ শরতের ছায়ানটে মোর রাগিণীর মিলন ঘটে,
সেই মিলনের তালে তালে বাজায় সে কঙ্কণ ॥
৫
গানগুলি মোর শৈবালেরই দল–
ওরা বন্যাধারায় পথ যে হারায়
উদ্দাম চঞ্চল ॥
ওরা কেনই আসে যায় বা চলে, অকারণের হাওয়ায় দোলে–
চিহ্ন কিছুই যায় না রেখে, পায় না কোনো ফল ॥
ওদের সাধন তো নাই, কিছু সাধন তো নাই,
ওদের বাঁধন তো নাই, কোনো বাঁধন তো নাই ।
উদাস ওরা উদাস করে গৃহহারা পথের স্বরে,
ভুলে-যাওয়ার স্রোতের ’পরে করে টলোমল
৬
গান আমার যায় ভেসে যায়–
চাস্ নে ফিরে, দে তারে বিদায় ॥
সে যে দখিনহাওয়ায় মুকুল ঝরা, ধুলার আঁচল হেলায় ভরা,
সে যে শিশির-ফোঁটার মালা গাঁথা বনের আঙিনায় ॥
কাঁদন-হাসির আলোছায়া সারা অলস বেলা–
মেঘের গায়ে রঙের মায়া, খেলার পরে খেলা ।
ভুলে-যাওয়ার বোঝাই ভরি গেল চলে কতই তরী–
উজান বায়ে ফেরে যদি কে রয় সে আশায় ॥
৭
সময় কারো যে নাই, ওরা চলে দলে দলে–
গান হায় ডুবে যায় কোন্ কোলাহলে ॥
পাষাণে রচিছে কত কীর্তি ওরা সবে বিপুল গরবে,
যায় আর বাঁশি-পানে চায় হাসিছলে ॥
বিশ্বের কাজের মাঝে জানি আমি জানি
তুমি শোন মোর গানখানি ।
আঁধার মথন করি যবে লও তুলি গ্রহতারাগুলি
শোন যে নীরবে তব নীলাম্বরতলে ॥
৮
এই কথাটি মনে রেখো, তোমাদের এই হাসিখেলায়
আমি যে গান গেয়েছিলেম জীর্ণ পাতা ঝরার বেলায় ॥
শুকনো ঘাসে শূন্য বনে আপন-মনে
অনাদরে অবহেলায়
আমি যে গান গেয়েছিলেম জীর্ণ পাতা ঝরার বেলায় ॥
দিনের পথিক মনে রেখো, আমি চলেছিলেম রাতে
সন্ধ্যাপ্রদীপ নিয়ে হাতে ।
যখন আমায় ও পার থেকে গেল ডেকে
ভেসেছিলেম ভাঙা ভেলায়
আমি যে গান গেয়েছিলেম জীর্ণ পাতা ঝরার বেলায় ॥
৯
আসা-যাওয়ার পথের ধারে গান গেয়ে মোর কেটেছে দিন ।
যাবার বেলায় দেব কারে বুকের কাছে বাজল যে বীণ ॥
সুরগুলি তার নানা ভাগে রেখে যাব পুষ্পরাগে,
মীড়গুলি তার মেঘের রেখায় স্বর্ণলেখায় করব বিলীন ॥
কিছু বা সে মিলনমালায় যুগলগলায় রইবে গাঁথা,
কিছু বা সে ভিজিয়ে দেবে দুই চাহনির চোখের পাতা ।
কিছু বা কোন্ চৈত্রমাসে বকুল-ঢাকা বনের ঘাসে
মনের কথার টুকরো আমার কুড়িয়ে পাবে কোন্ উদাসীন ॥
১০
গানের ভেলায় বেলা-অবেলায় প্রাণের আশা
ভোলা মনের স্রোতে ভাসা ॥
কোথায় জানি ধায় সে বাণী, দিনের শেষে
কোন্ ঘাটে যে ঠেকে এসে চিরকালের কাঁদা-হাসা ॥
এমনি খেলার ঢেউয়ের দোলে
খেলার পারে যাবি চলে ।
পালের হাওয়ার ভরসা তোমার–করিস নে ভয়
পথের কড়ি না যদি রয়, সঙ্গে আছে বাঁধন-নাশা ॥
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই নভেম্বর, ২০১১ দুপুর ১২:৩১

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




