দৃশ্যপট ০১:
নিউ মার্কেট থেকে মালিবাগ যাবার জন্য নীলক্ষেত মোড়ে ফাল্গুন ৮ পরিবহনের দাঁড়ানো একটি বাসে উঠার চেষ্টা করেও টিকিট না থাকায় এবং হেল্পারের অপারগতায় শেষ পর্যন্ত উঠলাম না। কাউন্টারে গিয়ে টিকিট কেটে যথারীতি দীর্ঘ লাইনে দাঁড়ালাম।প্রায় ৩০ মিনিট অপেক্ষার পর ৩য় একটি বাসে কোনোরকম উঠে দাঁড়াতে পারলাম।ঢাকা কলেজ সামান্য ক্রস করার পর পর-ই ১০-১৫ জন ছাত্র অনেকটা জোর করে বাস থামিয়ে হুড়মুড় করে গেটে ঠাসাঠাসি করে দাড়িয়ে গেলো। সাইন্সল্যাব পার হয়ে পরের কাউন্টারে বাস থামতেই বাসের ২ গেটেই ছাত্রদের চিৎকার চেঁচামেচি "বাসে জায়গা নাই...জায়গা নাই...অই মামা গাড়ী ছাড়''...ইত্যাদি আর সাথে ইচ্ছেমত গাড়ীর গায়ে চাপড় মারতে লাগলো। কন্ডাক্টর বা হেল্পার নামে কেউ আছে সেটা বুঝার উপায় থাকলোনা। মনে হলো ছাত্ররাই... একজন মহিলা লাইনের সামনে থেকে গাড়িতে উঠার আপ্রাণ চেষ্টা করছিলেন।তিনি সহ অন্য সবার চেষ্টা ব্যর্থ করে দিয়ে চালকও গাড়ি ছাড়তে বাধ্য হলেন।শাহবাগের মোড়ে কিছু যাত্রী নেমে যেতেই চোখের পলকে কয়েকজন ছাত্র ফাকা সীটে বসে পড়লো, কেউ আবার পাশের সীটে ব্যাগ রাখলো বন্ধুর জন্য সীট দখলে রাখতে।নিজের কথা ভাবার সুযোগ পাইনি গাড়িতে দাঁড়ানো বয়স্ক যাত্রীদের অসহায়ত্ব দেখে।সেই ছাত্রদের চোখে তখন বিশ্ব জয়ের আনন্দ।
কাকরাইল আসার পর হেলপার ভাড়া চাইতেই এক ছাত্র বলে উঠল 'এইখান থেকে এইখানে কিসের ভাড়া? ছাত্রদের আবার ভাড়া লাগেনি মিয়া?' বিব্রত হেল্পার বলল 'হাফ ভাড়া তো দিবেন মামা!"। দয়াপরবশ (?) হয়ে একজন ১০ টাকা দিয়ে বলল "এই আমি দিছি, তোদের দেয়া লাগবোনা। ' বিস্ময় ভরা চোখে হেল্পার বলল 'ভিক্ষা দিলেন নাকি,রাখেন আপনাগো ট্যাকা লাগবোনা...।"
আমার গন্ত্যব্যস্থল আসতেই নেমে পড়লাম।
দৃশ্যপট ০২:
নিউ মার্কেট থেকে উত্তরা যাবার জন্য ভি আই পি (২৭ নাম্বার) গাড়ীতে উঠলাম।ফাকা সীট আমার বয়সী এক ভদ্র লোকের পাশে বসলাম।ফার্মগেট পার হবার পর কন্ডাক্টর ভাড়া তোলা শুরু করতেই যথারীতি ভাড়া নিয়ে যাত্রী-কন্ডাক্টর দর কষাকষি।এবং যাত্রীদের অনেকেই আবার ছাত্র।আমার পাশে বসা ভদ্রলোক ১০ টাকা দিয়ে বললেন 'ছাত্র,এয়ারপোর্ট নামবো।'কন্ডাক্টর এক পর্যায়ে চালককে উদ্দেশ্য করে বলল "ওস্তাদ আমারে নামায় দেন।সবাই যদি ছাত্র অয় তাইলে যাত্রী কেডা,মাগনা গাড়ি চালামু নাকি।'এয়ারপোর্ট পার হবার পর খেয়াল হলো আমার পাশের ভদ্রলোক নামেনি। জসিম উদ্দিন পার হয়ে রাজলক্ষ্মী নেমে যাবার সময় ও সেই ভদ্রলোক বহাল তবিয়তে গাড়িতে বসে রইলেন
পরিতাপের বিষয়:
এখানে বলে নেয়া দরকার উপরের ঘটনা দু'টি ছাত্র সমাজ কিংবা কাউকে আঘাত দেবার জন্য নয় বরং কিছু মানুষের বিবেকহীনতার কারণে আম জনতার দুর্ভোগের উদাহরণ। পাবলিক পরিবহনে চরম যাত্রী দুর্ভোগ, বাস চালক ও পরিবহন মালিকদের দৌড়ত নিয়ে যুক্তি সঙ্গত অনেক কথা, অনেক লেখা হয়।কিন্তু যাত্রীদের অসহযোগিতাও যে সঙ্কট তৈরি করতে পারে তার মাত্র ২টি ঘটনা বাস্তবতা থেকে তুলে ধরা হয়েছে।
হাফ ভাড়া এবং সংকটঃ
আমাদের দেশে বাসে হাফ ভাড়া দেবার বিষয়টি বেশ পুরাতন। বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ শেষ করেছি ৩ বছর হল।কখনো হাফ ভাড়া ব্যাপারটির সমর্থন কিংবা প্রয়োগ করিনি।তার মানে এই নয় যে টাকা পয়সার প্রাচুর্য ছিল।কিন্তু ভাড়া বাচিয়ে খুব বেশি পকেটের পয়সা বাচবে এটা কখনো মনে হয়নি এবং এখনো যারা বাসে হাফ ভাড়া দেন তাদের তাতে কয় টাকা বাচে?কিংবা আদৌ পয়সা বাচানোর জন্য ক'জন হাফ ভাড়া দেন সেটা একটা ভাবার বিষয় বটে।বরং অল্প ক'টা টাকা বাচানোর জন্য জারা ভাড়া কম দিতে চান তারা প্রতিদিন বিড়ি-সিগারেট সহ আরো নানা উপায়ে কত অপচয় করেন তার হিসেব নিজেরাও দিতে পারবেন না।উলটো হাফ ভারা,ভাড়া না দেয়া, নিয়ম নীতির তোয়াক্কা না করে যেখানে সেখানে গাড়ি থামানো, লাইন ভেঙ্গে উচ্ছৃংখল হয়ে গাড়িতে উঠা সহ এরকম বিভিন্ন কারনে অনেক পাবলিক বাস বন্ধ হয়ে গেছে।আর যারা টিকে আছে তারাও বাধ্য হয়ে সাধারন যাত্রীদের হয়রানি করছে।ছাত্র কিংবা ছাত্র নামধারী কিছু মানুশের অনিয়মের সুযোগে সিটিং বাসগুলো কদিন চলার পর-ই হয়ে জায় সুপার লোকাল গাড়ি।
পরিশিষ্টঃ
এখনকার আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে আমার মনে হয় হাফ ভাড়া ব্যাপারটি পুরোপুরি তুলে দেয়া উচিত।যেসব ছাত্র ভাড়া নিয়ে এত কার্পন্য করে হলফ করে বলতে পারি তাদের বাবা-মা পর্যাপ্ত টাকা পয়সা দিয়েই স্কুল-কলেজে পাঠান।তারপরও হাফ ভাড়া দেয়া কিংবা ভাড়া না দেবার প্রবনতা তাদের মধ্যে ব্যাধির মত গেথে গেছে।এ সুযোগ কাজে লাগাচ্ছে ছাত্র নয় এরকম অনেকে। এরকম গনহারে হাফ ভাড়া দেবার প্রবণতা বন্ধ হলে সত্যিকারের যাদের ভাড়া দেবার সামর্থ কম তাদের জন্য হাফ ভাড়া নিতে পরিবহণ মালিকরা নিশ্চয় অপারগ হতেন না।বন্ধ হতোনা পরিবহণ কিংবা নষ্ট হতোনা বি আর টি সি'র সুন্দর বাস ও এর সেবা।