somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

সংশয়বাদীর জবানবন্দিঃ মুক্ত-দৃষ্টিতে মহাভারত

০৬ ই নভেম্বর, ২০১৪ দুপুর ২:০৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

মহাভারতঃ ‘কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ’ নামে কৌরব এবং পান্ডবদের যুদ্ধের বর্ণনায় মহাভারত মহাকাব্যটি রচিত। মহাভারতকে একটি সাহিত্য, মহা-সাহিত্যই বলা চলে। মানব সভ্যতার ইতিহাসে এটিই বৃহত্তম সাহিত্য। সাহিত্যের প্রধান স্তম্ভ লেখকের চিন্তার ব্যাপ্তি-সেটাই মহাভারতে আমরা দেখি। [2] ৭৪,০০০ এর অধিক শ্লোক, কতগুলো দীর্ঘ গদ্য এবং মোট প্রায় ১.৮ মিলিয়ন শব্দের সঙ্গে গ্রন্থিত এই বিশ্বের দীর্ঘতম মহাকাব্য মহাভারত যাঁরা লিখেছেন তাঁদের পান্ডিত্যে প্রসংশার দাবীদার। মহাভারতের গল্প, এটি আর দশটা ক্ষমতার লড়াইয়েরই গল্পের মতই। আমাদের জীবনে যেসব উপলদ্ধি-তার প্রায় সবটাই মহাভারতে আছে।

মহাভারত সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন–“ইহা কোনও ব্যক্তি বিশেষের রচিত ইতিহাস নহে, ইহা একটি জাতির স্বরচিত স্বাভাবিক ইতিহাস। রামায়ণ-মহাভারত আমাদেরই ইতিহাস।
রাজমেখর বসু বলেছেন–“প্রচুর কাব্যরস থাকলেও মহাভারতকে মহাকাব্য বলা হয় না, ইতিহাস নামেই এই গ্রন্থের প্রসিদ্ধি।”

মহাভারতে কাহিনীর শেষ নেই। কে কার ছেলেমেয়ে, কোন ডালাপালা ইত্যাদি মনে রাখাটা পড়ার সময় মুশকিল হয়।
তবে চরিত্রগুলো বুঝতে এই ছবিমহাভারতের চরিত্রায়ন অনেকটা সাহায্য করতে পারে। ছেলেবেলায় স্মৃতিশক্তি ভাল থাকে তাই অনেকেই তখনি পড়ে থাকেন। স্কুল জীবন শেষে অনেকেরই আর রামায়ন-মহাভারত পড়া হয়ে ওঠে না। তবে পড়লে মনে হবে, রচয়িতা এত সুন্দর কাহিনী বিন্যাস, এত কিছু কল্পনা করলো কী করে! এত কিছু চিন্তা করতে করতে অনেকের প্রতি এই মহারথীরা অন্যায় করে ফেলেছেন এটা ভেবেও দেখেন নি। যুথিষ্ঠিরকে মহামানব রুপে প্রতিষ্ঠা করতে যেয়ে দ্রৌপদীর উপর যে অন্যায় করা হয়েছে সেটা ভাবনায় আনেন নি।

তারপরও মনেহয়, আমাদের পূর্বপুরুষদের ভাবনাশক্তি ছিল প্রবল! মহাভারতকথা স্বাভাবিক ও অস্বাভাবিক ব্যাপারের বিচিত্র সংমিশ্রণ, পড়তে পড়তে মনে হতে পারে আমরা এক অদ্ভুত স্বপ্নদৃষ্ট লোকে উপস্থিত হয়েছি। সেখানে মানুষ ও দেবতার মধ্যে অবাধে মেলামেশা চলে। মুণি-ঋষিরা হাজার হাজার বছর ধরে তপস্যা করেন। হিড়িম্বা রাক্ষুসী ভীমকে নিয়ে আকাশে উড়ে চলে গেলেন। ইত্যাদি। ইত্যাদি। এগুলি মজার এবং আজগুবি বলে মনে হতেই পারে! আবার প্রশ্ন জাগতে পারে, মহাভারতের ঘটনাবলি যদি সত্যিই হয়, তারা এসব করলেন কী ভাবে? আর যদি সত্য না হয়, তাহলে এইসব আজগুবি গল্প রচনা করার বুদ্ধিটা মাথায় এলো কেন? কিন্তু কথা হচ্ছে এই সমস্ত আজগুবি গল্পের গুরুত্ব অন্য জায়গায়। এর সাহিত্যমূল্য অসাধারণ। তাছাড়া মহাভারতের মধ্য দিয়ে প্রাচীন ভারতের সামজিক এবং রাজনৈতিক জীবনকে দেখার একটা সুযোগও পাওয়া যায়।

এই মহাভারতের ঘটনাবলীকে ধ্রুব সত্য ভাবার কিছু নেই। হয়তো কিছু চরিত্র ও কাহিনী সত্য, যাকে ডালপাতা ছড়িয়ে পৌরানিক সাহিত্য বানানো হয়েছে।
মহাভারতকে একটি সাহিত্য-মহা সাহিত্য, মানব সভ্যতার ইতিহাসে বৃহত্তম সাহিত্য। কিন্তু সেটা ইতিহাস নির্ভর সাহিত্য কিনা? এটা নিয়ে বিতর্ক আছে।

বর্তমানে মহাভারত এর ভিডিওচিত্র ইউটিউবে পাওয়া যায় ১১০ টা অংশে। এই সিরিয়ালটা ভারতে এবং বাংলাদেশের হিন্দু ধর্মবোদ্ধাদের কাছে সব থেকে বেশী জনপ্রিয়। অনেকেই ধারণা করেন যে, হিন্দুত্ববাদের উত্থানের আড়ালে এই মহাভারত সিরিয়ালের একটা বিশেষ ভূমিকা আছে। কারন এত ব্যাপক ভাবে আদিভারত নিয়ে এর আগে তেমন কিছু প্রকাশিত হয়নি।মহাভারত ধর্মীয় স্বাদে উপস্থাপন করা হলেও তা শুধুমাত্র যৌথ পরিবারের কর্তৃত্ব দখলের লক্ষ্যে রাজনৈতিক দ্বন্দের গল্পের রুপক উপস্থাপন।

কুরক্ষেত্রের যুদ্ধঃ বারীন্দ্রনাথ দাশের বই ‘শ্রীকৃষ্ণ বাসুদেব’ এ বলছেন-“ধারনা ছিলো জরাসন্ধ আর দুর্যোধন একত্র হলে আর্যাবর্ত তাদের করায়ত্ত হবে, কুরু পাঞ্চালের বিশাল অঞ্চলে উৎপাদন হতো প্রয়োজনের অতিরিক্ত খাদ্যশস্য।” মগধ রাজ্যের সাথে সামুদ্রিক বাণিজ্যের সম্পর্ক ছিল পশ্চিমের যবন রাজ্যের। তাই মগধের সাথে মিত্রতা ছিলো ধৃতরাষ্টের কাম্য। এটিও ছিলো আরেকটি কারণ। মূলত যুধিষ্ঠির পাশা খেলায় হারলে কৌরবরা রাজসভায় দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণ করে আর এর প্রতিশোধ নিতে কৌরব এবং পান্ডবদের যুদ্ধ নিশ্চিত হয়ে পড়লে কুরুক্ষেত্র নামক ময়দানে এই যুদ্ধ হয় বলে একে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ বলে।
মহাভারতে বর্ণিত সবগুলো ঘটনার ঐতিহাসিকভাবে কোন প্রমাণ নেই (তবে দু’য়েকটার থাকলে থাকতে পারে)। খ্রীস্টপূর্ব ৬ম-৭ম শতাব্দীর দিকে কুরুরাজ্য থেকে থাকতে পারে, এবং সে রাজ্যে অন্তত কোন একটা যুদ্ধ বা গণ্ডগোল এরকম কিছু হয়েছিল যেটা তৎকালীন ভারতে খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল, এমন একটা বিশ্বাস বৈধ গবেষকদের মধ্যেও আছে।

মহাভারত রচনাকালঃ ধরে নেয়া হয়, সেই কুরুক্ষেত্রযুদ্ধের কাল খ্রী-পূ ৩০০০ অব্দের কাছাকাছি[1] এবং যুদ্ধের কিছুদিন পরে মহাভারত রচিত। যদিও কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের তেমন কোন ঐতিহাসিক প্রমান নেই। তবে মোটামুটি ভাবে মহাভারতের সংস্কৃত থেকে এর রচনাকাল আন্দাজ করা যেতে পারে-যা হবে প্রায় গৌতম বুদ্ধের জন্মের কয়েকশো বছর আগে। এবং কাব্যের ভাষা থেকে এটাও প্রমানিত হয় যে, প্রায় ৫০০ বছর ধরে গ্রন্থিত হয়েছে এ কাহিনী। অর্জুনের নাতি ‘রাজা জনমেজয়’(Janamejaya) মহাভারত মহাকাব্যকে গ্রন্থিত করার জন্য ঋষি বৈশম্পায়ন’র মাধ্যমে তার শিষ্যকে নিয়োগ করেন। তারপর ঋষি বৈশম্পায়ন (Vaisampayana) থেকে জানামজয়া’র করা ফিরিস্থি আবার অনেক ঋষি’র উপস্থিতিতে ‘উগ্রাস্রাভা সূতি’(Ugrasrava Sauti) নামের একজন পেশাদার বেদকে দিয়ে নথিভুক্ত করা হয়।

সাতনা জেলার মধ্যপ্রদেশে থেকে(৫৩৩-৫৩৪ খ্রিষ্টাব্দে) মহারাজা সার্বানাথ(Sharvanatha) এর সময়ের প্রথম তামার শিলালিপিতে খোদাইকৃত অবস্থায় মহাভারতের ১০০,০০০ শ্লোক সংগ্রহ করা হয় এবং এ থেকে আরোও প্রমাণ মেলে ১৮টি পর্বের (বইয়ের) সম্পাদনা হয় মূলত ৩য় কিংবা ৪র্থ শতাব্দীতে।

মহাভারতের ঐতিহাসিক সত্যতা কতটা আর সাহিত্যিক রচনা কতটা তা যাচাইয়ের আগে মহাভারত রচয়িতা সম্পর্কে একটু জেনে নিই।

মহাভারত রচনাকারীঃ মহাভারত রচনাকারীর নাম ‘কৃষ্ণদ্বৈপায়ন ব্যাস’। এই ব্যাস আসলে একটি পদবী। প্রাচীন রচনাকারগণকে ব্যাস নামে অভিহিত করা হত। কৃষ্ণদ্বৈপায়ন ব্যাস সম্পর্কে জানতে গিয়ে তার পুর্ব পুরুষদের কিছু গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা জানতে পারলাম তা হলোঃ-
[3]কৃষ্ণদ্বৈপায়ন ব্যাস ছিলেন একজন কৃষ্ণাঙ্গ শংকর এবং কৃষ্ণদ্বৈপায়ন ব্যাসের জন্মদাতার নাম ‘পরাশর মুণি’। পরাশর মুনি আবার আর্যবংশভুতো ও আর্যবর্তের খুব গুরুত্বপুর্ন চরিত্র বশিষ্টের নাতি। মহাভারত রচয়িতা কৃষ্ণদ্বৈপায়ন ব্যাসের জন্মদাতা পরাশরের পিতা ‘শক্তি মুনি’ একবার ভ্রমনের সময় এক রাজ্যচ্যুত রাক্ষসের (রাজ্যচ্যুত স্থানীয় কোনো দ্রাবিড় গোত্রপতি) কবলে পরে প্রান হারান। অনার্যদের হাতে পিতার ভয়াবহ মৃত্যু পরাশরের মনে রেখাপাত করে এবং বড় হয়ে স্থানীয় দ্রাবিড় জেলে পল্লীর সর্দারের সত্যবতি নামের এক মেয়েকে একদিন এক নৌকায় একা পেয়ে পিতার হত্যার প্রতিশোধের বশে সঙ্গম করে গর্ভবতী করে ফেলেন। কিন্তু পরাশর সেই ঔরষজাত সন্তানকে নিজের সন্তান বলে আর স্বীকৃতিই দেন নি।

গর্ভজাত সেই সন্তানের স্বীকৃতি না পাওয়ায় সত্যবতি শেষপর্যন্ত যমুনার এক বিচ্ছিন দ্বীপে (প্রায় ৫০০০ বছর আগে উত্তর প্রদেশের জালাউনের কালপি’) যে সন্তান জন্ম দেন তার নাম হয় ‘কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন’। এই ‘কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন’ পরে বেদ চার ভাগ করার জন্য ‘বেদব্যাস’ উপাধী লাভ করেন।
(হিন্দুদের কাছে হর-পার্বতী পুত্র দেবতা ‘গণেশ’ মহাভারতের লিপিকার রুপে কল্পিত হন। কারন ‘বেদব্যাস’ মুখে বলেছেন আর গণেশ সেটা লিপিবদ্ধ করেছেন পৌরাণিক গ্রন্থে এমনটাই বর্নীত আছে, অন্যদিকে নেপালের যে পুরোনো গুহায় তিনি মহাভারত রচনা করেছিলেন তার অস্তিঃত্ব এখনও আছে)
তো, ব্যাসবেদ আর তার উৎপাদনকারী পিতা থেকে সন্তান হিসাবে স্বীকৃতি পান নি। এদিকে পরে বেদব্যাসের মা’কে শান্তনু নামের আর্য [4] রাজা বিয়ে করলে মায়ের সাথেই (ব্যাসবেদ)তিনি সৎ-পিতার বাড়ী যান, পিতৃস্নেহ বঞ্চিত ব্যাসবেদ নিরুপায় হয়ে সৎ-পিতা শান্তনুর ঘরে বেড়ে উঠতে থাকেন। আর এই আর্য রাজা শান্তনুর নাতি-পুতিরাই হচ্ছে কৌরব ও পান্ডব বংশ।

প্রায় আশ্রিত হয়ে আর্যবর্তে অবস্থান করার কারনে স্বাভাবিক ভাবেই ধরে নেয়া যায় বেদব্যাসের নিজের গায়ের কালো রং নিয়া জটিলতা ছিলো এবং স্বীকৃতি না দেয়ার কারনে পিতা শ্বেতাঙ্গ আর্য পরাশরকে ব্যাসবেদ ঘৃনাও করতেন, আবার জন্মদাতা হিসাবে তাকে অস্বীকার করারও সুযোগ তার ছিলো না। এই মানসিক যন্ত্রনা যে তার মনোজগতে প্রচন্ড প্রভাব ফেলে সেটার প্রতিফলন দেখাযায় মহাভারতের প্রধানতম চরিত্র ‘শ্রীকৃষ্ণ’ কে ব্যাসবেদ তার নিজের আদলে তৈরি করার মাধ্যমে। তিনি নিজের ছায়া অবলম্বনে ‘শ্রীকৃষ্ণ’ চরিত্রকে তৈরি করেন।

তো, সেই বেদব্যাস পরে জ্ঞানার্জনে মনোনিবেশ করেন ও মানসিক যন্ত্রনাকে সঙ্গী করে প্রতাপশালী আর্য বংশে দিনযাপন করতে থাকেন। ধীরে ধীরে সৎ-পিতার সন্তানরা বড় হয়, তাদেরও ছেলে-মেয়ে হয়, নাতি-নাত্নী হয় এবং এক পর্যায়ে তাদের মধ্যে পরিবারের কর্তৃত্ব ভাগাভাগি নিয়ে দ্বন্দও হয়তো তিনি অবলোকন করেন! মহাভারত অনুযায়ী কৌরব ও পান্ডবদের বাপ যথাক্রমে পান্ডু ও ধৃতরাস্ট্র, যারা আবার বেদব্যাসের ক্ষেত্রজ সন্তান।

মহাভারতের আজগুবি গল্পের জটঃ মহাভারতের কিছু আজগুবি গল্পের জট এভাবে খুলা যেতে পারে যেমনঃ- সেসময় গৌরবে বহুবচন বলে একটি শব্দ ছিল। সে কারণ যদি বলা হয়–কৃষ্ণ ৭০ হাজার বছর বয়স পর্যন্ত বেঁচেছিলেন, তখন হাজারটি বাদ দিলেই কৃষ্ণের আসল বয়সটি পাওয়া যায়। বস্তুত দেবতা, মানুষ, রাক্ষস, নাগ–এরা সবাই মানুষ। তবে এরা ভিন্ন ভিন্ন গোত্র, জাতি। যেমন ভীমকে যখন দুর্যোধন বিষ খাইয়ে জলে ফেলে দিল–তখন ভীম জলের নিচে পাতালে নাগলোকে চলে গেলেন। সেই নাগকে সাপ না বলে বলা হয়েছে নাগ! আসলে নাগ’রা সমুদ্রতীরবর্তী বসবাসকারী কোন গোষ্ঠি।

কাম্যক বনে ভীমকে দেখে হিড়িম্বা নামে এক রাক্ষুসী মোহিত হয়ে গেল। মায়া করে সুন্দর এক যুবতী হয়ে ভীমের কাছে এলো। আসলে এই রাক্ষসরাও মানুষ, বনবাসী গোষ্ঠি। এরা বনে জঙ্গলে থাকতো তাই সেজেগুজে থাকতো না। কিন্তু ভীমকে হিড়িম্বা তার প্রেমে ফেলার জন্য যখন সে সুন্দর করে সাজল তখনতো তাকে সত্যি সত্যি মানুষের মতই সুন্দরী ছাড়া অন্য কিছু মনে হয় নি ভীমের। এই সেজে আসাটাকেই ব্যাসগণ একটু অলংকরণ করে বলেছেন–মায়া করেছেন। আর আকাশে উড়ে যাওয়া বিষয়টিও অলংকরণ করা। ভীমকে বিয়ে করার পরে তাকে নিয়ে নির্জন জায়গার দিকে নিয়ে গেল যেখানে কোন মনুষ্যবাস নেই। এই পথটি হিড়িম্বাই জানা ছিল–ভীমের না। রচনাকারী এই নির্জন জায়গার দিকে যাওয়াটাকেই আকাশে উড়ে যাওয়া বলে চালিয়ে দিয়েছেন। এই রকমভাবে মহাভারতে বিচার করলে তখন আর একে আজগুবি মনে হবে না আশা করছি।


হিন্দুত্ববাদীদের দেয়া মহাভারতের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যাঃ
মুসলমানরা যেমন কুরানকে একমাত্র সহি জীবন-বিধান বলেন, দাবী করেন কুরানে বিজ্ঞানও আছে। বিজ্ঞান আজকে যা বলছে, ওহি হিসেবে কুরানে তা ১৪০০ বছর আগেই নাযিল হয়েছে। মুসলমানরা যেমন কোরান হাদিস কতটা বিজ্ঞান ভিত্তিক আর সার্বজনীন জিনিস তা প্রমান করার জন্যে ব্যস্ত, খৃষ্টানরা ব্যস্ত তাদের বাইবেলকে সেরকম প্রমান করতে। তেমন অবস্থায় হিন্দুরাই বা পিছিয়ে থাকবে কেন? আর সে প্রচেষ্টা থেকেই মহাভারতের আধুনিক বিশ্লেষন। তাই মহাভারত মিথ নিয়ে কথা বললে অনেক কট্টর হিন্দুরা প্রায়ই বলে থাকেন, কী নেই এই রামায়ন-মহাভারতে? অনেক হিন্দু আবিষ্কার করেছেন, মহাভারতে বর্নিত রথ হলো- মহাকাশযান বা বিমান, ব্রহ্মাস্ত্র হলো একধরনের ক্ষেপনাস্ত্র ইত্যাদি। হর হামেশা ইন্দ্র, বরুন, সূর্য প্রমুখ দেবতারা এসে বিশেষ করে মেয়েদেরকে বরস্বরূপ পূত্র উপহার দিত(ভুলেও কন্যা দিত না, দিলেও তার সংখ্যা খুব নগন্য) যাকে বলা হয় ভিন গ্রহের উন্নত সভ্যতার মানুষ এসে বর্ন সংকরের মাধ্যমে পৃথিবীর মানুষকে উন্নত করে দিয়ে গেছে ইত্যাদি।

হিন্দু ধর্মবোদ্ধারা পারমানবিক বোমার থেকে শুরু করে দূরপাল্লার ক্ষেপনাস্ত্র সবকিছুরই অস্ত্বিত্ব পান মহাভারতে। তাদের দাবীটা যেন এরকম, নাগাসাকি-হিরোশিমাতেই পারমানবিক বোমার প্রথম বিস্ফোরণ ঘটেনি, ঘটেছে প্রাচীন ভারতে। আর তা ঘটিয়েছে আমাদেরই পূর্ব পুরুষেরা। পুরো একটা শহরকে ধ্বংসস্তুপে পরিণত করেছে তাঁরা। দূরপাল্লার পারমানবিক ক্ষেপনাস্ত্র ছুড়ে তেজস্ক্রিয়তা ঘটিয়ে তাঁরা মাতৃগর্ভের শিশুকেও হত্যা করেছে মাকে জীবিত রেখেই। আজকে যে যুদ্ধবিমান দিয়ে দেশে দেশে যুদ্ধ হচ্ছে তা সেই সময়েই করে গিয়েছেন দেবতাপুত্র অর্জুন-কর্ণেরা। মহাকাশে ভ্রমণ, সময় সংকোচন করে আলোর চেয়ে বেশি গতিতে চলা এগুলোও সব লেখা আছে পুরাণের পুরোনো হয়ে যাওয়া পাতায় পাতায়। রথে করে দেবতাদের স্বর্গ থেকে নেমে আসাকে ইউএফও তে চেপে ভিনগ্রহের উন্নত মানুষদের কথাই বলা হয়েছে। লক্ষনের শক্তিশেল হচ্ছে স্কাড মিসাইল। বরুন বান? একই রকম কাহিনী না হলে কি করে প্রাচীন মায়ান সভ্যতায়ও পাওয়া যায়? হনুমান দেবের মাধ্যমে বিবর্তনবাদ ইংগিত এসেছে। এসব পরিষ্কার দেখানো হয়েছে! শুধু বিশ্বাসটুকু আনলে দেখতে পাবেন জ্ঞান-বিজ্ঞানের এক বিস্ময়কর অনন্ত আধার আমাদের এই রামায়ন, মহাভারত। শুধু খুঁজে নিতে হবে বিশ্বাসের আলোটুকু জ্বালিয়ে।

মহাভারত সাহিত্যি না ইতিহাস, তার ব্যাখ্যাঃ রামায়ণ-মহাভারতকে সাহিত্য বলতে করোও কোন আপত্তি থাকার কথা নয়, কিন্তু ইতিহাস বলতে গেলে বাস্তবতার নিরীখে প্রামাণিক সত্যতার দাবি অবশ্যই কেউ তুলতে পারেন। নতুন প্রজন্মও কি প্রশ্নাতীতভাবে মেনে নিবে? এই ‘স্পাইডারম্যান’,‘রোবট’ যুগের শিশুকে বুঝানো যাবে কর্ণ পথেই কর্ণ- প্রসবিত হয়েছিলেন? কর্ণের জন্মের পরেও কুন্তির কুমারীত্ব বজায় থাকল! কুমারীত্ব বজায় রাখার জন্য কান দিয়ে কর্ণকে প্রসবিত করানো হল। এসব রুপক বিবর্তন দিয়ে ব্যাখ্যা করার অবকাশ নেই। সাহিত্য হলে মেনে নিতে কারোর নিশ্চয়ই কোন সমস্যা হবেনা বোধকরি। কিন্তু ইতিহাস বললেই তো সেখানে সত্যতা নিরুপনের বিষয়টি ওঠে আসে….

তাছাড়া, মহাভারত-রামায়ন যে শুধুমাত্র বহু কবি’র কল্পনার সামগ্রিক বাস্তবায়ন সেটা হিন্দুরা প্রায়ই ভুলে যায়। কট্টর পন্থি হিন্দুরা বিশ্বাস করে এমনকি দাবী করে এসব মহাকাব্যের প্রতিটি ঘটনা বাস্তব ও ঐতি্হাসিক! যদিও আজ পর্যন্ত এসব কাল্পনিকতার তেমন প্রমান পাওয়া যায়নি। তার পরেও রচনাকারীদের সমসাময়িক রাজা-বাদশাদের কথা প্রসংঙ্গক্রমে চলে আসে- মুলত তাদেরকে তোষামোদ করে কিছু প্রাপ্তির আশায় যে প্রবনতা সব সময় ছিল প্রতিটি সভ্যতায়। আমরা দেখেছি কত কবিকে মহা লম্পট এরশাদকে বন্দনা করে কবিতা লিখতেও। কিংবা দুর্নীতির বরপুত্র তারেক রহমানকে নিয়ে কবিতা লিখতে। ভাগ্যিস এটা মহাকাব্যের যুগ নয়। না-হলে মহালম্পট এরশাদ নিশ্চিত ভাবে প্রেমের দেবতা বা প্রেমের দেবতার বরপ্রাপ্ত বলে বর্ণিত হতো। আর তারেক রহমান হতো সত্য ও আদর্শের প্রতীক। এ ধরনের ঘটনা আমরা গ্রীক পুরানেও বহু পাই।

সন্দেহাতীত ভাবে রামায়ন-মহাভারত যেহেতু সাহিত্য, অতএব এগুলোর মধ্যে বিজ্ঞান নিয়ে ব্যাখ্যা বা আলোচনা করে ধর্মকে বিজ্ঞানের কাঁধে ভর করে চালতে দেয়ার মানে হয় না। আর ব্যাখ্যা যাই হোক এইকথা স্বীকার করতে আপত্তি নেই যে মহাভারত একটি মহাকাব্যগ্রন্থ – শক্তিশালী লেখকদের গ্রন্থনায় একটি অতুলনীয় রূপকথার কাহিনী। এর খন্ড খন্ড কাহিনী নিয়ে প্রচুর যাত্রা পালাও হয়েছে। রবিঠাকুর কর্ণ-কুন্তী সংবাদ আর চিত্রাংগদা লিখেছেন সাহিত্যের ভিত্তি কল্পনায়-সেই কল্পনার জগতেই মহাভারত চিরজাগরুক।

[বি:দ্র: "সংশয়বাদীর জবানবন্দিঃ মুক্তমনা থেকে মহাভারত, রাশভারী এবং রসিকতা।" শিরোনামে মুক্তমনা ব্লগে লেখাটি (০২-১১-২০১৪) প্রকাশিত হয়েছে ]
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই নভেম্বর, ২০১৪ দুপুর ২:০৯
১টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। আমের খাট্টা

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৫৪



তাতানো গরমে কাল দুপুরে কাচা আমের খাট্টা দেখে ব্যাপারটা স্বর্গীয় মনে হল । আহা কি স্বাদ তার । অন্যান্য জিনিসের মত কাচা আমের দাম বাড়াতে ভুল করেনি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ডাক্তার ডেথঃ হ্যারল্ড শিপম্যান

লিখেছেন অপু তানভীর, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:০৪



উপরওয়ালার পরে আমরা আমাদের জীবনের ডাক্তারদের উপর ভরশা করি । যারা অবিশ্বাসী তারা তো এক নম্বরেই ডাক্তারের ভরশা করে । এটা ছাড়া অবশ্য আমাদের আর কোন উপায়ই থাকে না... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমার ইতং বিতং কিচ্ছার একটা দিন!!!

লিখেছেন ভুয়া মফিজ, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৩:০৩



এলার্ম এর যন্ত্রণায় প্রতিদিন সকালে ঘুম ভাঙ্গে আমার। পুরাপুরি সজাগ হওয়ার আগেই আমার প্রথম কাজ হয় মোবাইলের এলার্ম বন্ধ করা, আর স্ক্রীণে এক ঝলক ব্লগের চেহারা দেখা। পরে কিছু মনে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিসিএস শুধু দেশের রাজধানী মুখস্ত করার পরীক্ষা নয়।

লিখেছেন ...নিপুণ কথন..., ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৩:১৪

"আমার বিসিএস এক্সামের সিট পরেছিলো ঢাকা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট এ, প্রিপারেশন তো ভালোনা, পড়াশুনাও করিনাই, ৭০০ টাকা খরচ করে এপ্লাই করেছি এই ভেবে এক্সাম দিতে যাওয়া। আমার সামনের সিটেই এক মেয়ে,... ...বাকিটুকু পড়ুন

কে কাকে বিশ্বাস করবে?

লিখেছেন অনিকেত বৈরাগী তূর্য্য , ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:৩৯


করোনার সময় এক লোক ৯৯৯ এ ফোন করে সাহায্য চেয়েছিল। খবরটা স্থানীয় চেয়ারম্যানের কানে গেলে ওনি লোকটাকে ধরে এনে পিটিয়েছিলেন। কারণ, ৯৯৯ এ ফোন দেওয়ায় তার সম্মানহানি হয়েছে।

সমাজে এমন... ...বাকিটুকু পড়ুন

×