মিস্টার হুতোআসি এলেন জাপান থেকে, আম্রিকা থেকে মিস্টার প্যাম্পোস, ফ্রান্স থেকে মঁসিয়ে বার্তোস, ইতালি থেকে সিনোরিটা মনিকা আর বাংলাদেশ থেকে কাকে পাঠাই... ধর তোমাকেই পাঠিয়ে দিলাম।.তোমরা সব এক সাথে বসেছ আন্তর্জাতিক কোন জটিল বিষয় নিয়ে আলোচনা করার জন্য। সেখানে দেখা গেল তুমি যে ভাষায় কথা বলছ সে ভাষাতেই কথা বলছে হুতোআসি, মনিকা, বার্তোস এমনকি প্যাম্পোস পর্যন্ত! মানে সবাই কথা বলছে এক ভাষায়। এখানে তুমি যদি আমার ওপর তেতে উঠে বলে ফেল, ‘একটু ভাইবা চিন্তা গ্যাস দিয়েন বস..’ সত্যি বলছি তাতে আমি একদম অন্য কিছু মনে করব না। বলতে তো তুমি পারই। কারণ পৃথিবীতে মাশাল্লা এত কিসিমের এত ভাষা, গুণে শেষ করতে গিয়ে কম্পিউটারের হার্ড ড্রাইভও মেমোরির ঝামেলা লেগে যাবে। আর সেখানে এশিয়া আম্রিকা আর ইউরোপকে বসিয়ে দিচ্ছি এক ভাষায় কথা বলার জন্য। ঠিক আছে বাবা এটা এখন সম্ভব না- হল তো? কিন্তু ধর যদি তোমার সাথে বসেই একটা পরামর্শ করি- কি করে সম্ভব করে তোলা যায় ব্যাপারটা!
আহা আবার ক্ষেপে বেগুন হয়ে উঠো না। শোনোই না। উল্টো দিক থেকে ভাবা যাক ব্যাপারটা। মানে পৃথিবীতে এত ভাষা কেন? দেশ অনুযায়ী তো ভাষা পাল্টাচ্ছেই, আবার এক দেশের মধ্যেই কত কিসিমের ভাষা সব আমরা বুঝতে পারি না। আমাদের দেশেই তো আছে প্রায় ত্রিশের ওপর ভাষাভাষী মানুষ। আমি নিশ্চিত তুমি ঐ ত্রিশটা ভাষার নামও বলতে পারবে না, মানে আমিও পারব না... আবার রাগ কোর না যেন। তোমাকে চাকমা, গারো, মারমা আর সাঁওতালদের সাথে বসিয়ে দিলেও সে একই কান্ড; তোমরা সবাই এ ওর মুখের দিকে তাকিয়ে ভাববে, ইস কি অদ্ভূত ভাবে কথা বলে লোকটা! তো বাবা এত ভাষা না হলেই কি চলত না? এটা অবশ্য আজকের সময়ে বসে আমাদের জন্য ভাবা অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু এক সময় এতগুলো ভাষা ছাড়া আসলেই চলত না, মানে চলার উপায় ছিল না। মানুষের এসব ভাষা, সংস্কৃতির ইতিহাস নিয়ে যারা কাজ করেন তাদের বলা হয় নৃবিজ্ঞানী, ইংরেজিতে এনথ্রপলজিস্ট। সে নৃবিজ্ঞানীরাও কিন্তু বিষয়টা নিয়ে ভেবেছেন গভীর করে। তারা অনেক কঠিন কঠিন শব্দ আর অংক টংক ব্যবহার করে অনেক কিছু বলেছেন- আরও কিছু বিদ্যা পেটে না নিয়ে সবটা বোঝা আমাদের হয়তো হবে না কিন্তু ওপরে ওপরে কিছু ধারনা নিতে এলে তো আর কেউ মামলা করতে আসছে না, কি বল?
এক নৃবিজ্ঞানীর করা এক গবেষণার কথা শোনা যাক; ভদ্রলোক গবেষণাটা শেষ করেছেন খুব বেশিদিন হচ্ছে না। অক্সফোর্ডের ঐ নৃবিজ্ঞানীর নাম ড্যানিয়েল নেটল। ভাষার সংখ্যা এত কেন হল তা নিয়ে ভাবছিলেন তিনি। ভাবতে গিয়ে খোঁজ নিলেন পৃথিবীর কোন এলাকায় ভাষার সংখ্যা অনেক বেশি। তুমি জান তো কোন অঞ্চলে? আমি কিন্তু জানি এটা- আফ্রিকায়। এটা জেনে তিনি বেরিয়ে পড়লেন আফ্রিকার পশ্চিম দিক ধরে। উদ্দেশ্য, পায়ে হেঁটে আর হাতে ধরে বোঝার চেষ্টা করবেন এলাকাভেদে ভাষার তারতম্যের কারণ। উত্তর পশ্চিমের সেনেগাল থেকে শুরু করে দণি পশ্চিমের ক্যামেরুন পর্যন্ত অঞ্চল চষে ফেলেছেন। এর মধ্যেই তার পরিচয় হয়েছে প্রায় ৭০০ ভাষার সাথে। ক্যামেরুনে যাও। মানুষ আছে ১ কোটি বিশ ল আর ভাষা আছে ২৭৫ টি। এমনকি ছোট্ট টোগো দেশটিতেই আছে ৫০টি ভাষা। পাপুয়া নিউ গিনি নামের দেশটিই ছাড়িয়ে গেছে সবাইকে। সবচেয়ে বেশি ভাষা চালু আছে এ দেশটিতেই। এর কারণ অনুসন্ধান করতে গিযে নেটল পশ্চিম আফ্রিকাকে অনেকগুলো বর্গেেত্র ভাগ করে ফেলেন। এক একটি বর্গেেত্রর আয়তন বেশ কয়েক হাজার বর্গমাইল। তিনি করলেন কি প্রতি বর্গেেত্র মানুষ কোন ভাষায় কথা বলে এ তথ্য সংগ্রহের পাশাপাশি মেপে নিলেন ঐ ক্ষেত্রের বৃষ্টিপাতের হার। তিনি পেলেন এক আজব ফলাফল। যেসব জায়গায় বৃষ্টিপাত বেশি, সে সব জায়গায় ভাষার সংখ্যাও বেশি। এমনকি ক্ষেত্র প্রতি আশিটি ভাষারও সন্ধান পাওয়া গেছে। অন্যদিকে আপোকৃত কম বৃষ্টিপাতের জায়গায় ভাষাবৈচিত্রের সংখ্যাও কম। খরাপ্রবন অঞ্চল নাইজার, সেখানে মাত্র ২০ টি ভাষা চালু আছে। আপোকৃত আর্দ্র নাইজিরিয়াতে আছে ৪৩০টি ভাষা। সেখানে ৫০০ লোক আছে এমন গোষ্ঠীও ব্যবহার করে নিজস্ব ভাষা ‘হোরোম’। নেটল ব্যাখ্যা করেছেন ব্যাপারটা এভাবে- যে অঞ্চলে সারা বছর অপর্যাপ্ত বৃষ্টিপাত হয় সেখানে শস্য উৎপাদনে ঘাটতি হয় কম। ফলে অন্তত জীবনধারনের চাহিদা মেটানোর অন্যতম প্রধান উপকরন খাবারের জন্য চিন্তা নেই। এসব এলাকার লোকেরা খুব ছোট ছোট গোষ্ঠীতে নিজেদের অবদ্ধ রাখেন। প্রয়োজন হয় না অন্য কোথাও যাওয়ার বা অন্য কোন গোষ্ঠীর সাথে যোগাযোগ তৈরির। গড়ে ওঠে আঞ্চলিক ভাষা।
অন্যদিকে খরাপ্রবন এলাকায় সারা বছর জীবনধারনের জন্য প্রয়োজনীয় খাদ্য সম্ভার সংগ্রহের তাগিদ থাকে খুব বেশি। ফলে দরকার হয় দূরবর্তী এবং অন্যান্য জাতি বা গোষ্ঠীর সাথে সম্বন্ধ স্থাপনের। তেমন অবস্থাতে তো আর কেবল নিজেদের আঞ্চলিক ভাষাতে কথা চালিযে যাওয়া সম্ভব নয়। তখন আশ্রয নিতে হয় সাধারণ কোন ভাষার ইংরেজিতে যাকে বলে লিংগুয়া ফ্রাংকা। এই পরষ্পরের মধ্যে যোগাযোগ যত বেশি ঘটে তত কমে আসে ভাষাবৈচিত্র্য।
এই মজার ফলাফলটা আমাদের জন্য কিন্তু একটা দারুন শিা। নেটল তো কেবল বৃষ্টি দিয়ে বোঝালেন। আমরা নিশ্চয়ই বোকার মত কেবল এটাই বুঝে নিব না যে, বৃষ্টিটাই বুঝি ভাষা তৈরি করে দিল। যেমন পাপুয়া নিউগিনিতে এত ভাষা থাকার পেছনে আরেকটা কারণ হল- এ দেশে এত বেশি পাহাড় পর্বতে ঘেরা যে ছোট ছোট অঞ্চল অধিবাসী আর গোষ্টী পরস্পরের সাথে যোগাযোগ করতে পারে না। ফলে আঞ্চলিক বা গোষ্ঠীগত একাধিক ভাষা সৃষ্টি হয়েছে। মূল ব্যাপারটা হল গিয়ে এমন এক সমাজ যখন থাকবে জাতিগুলো নিজেদের মত করে থাকতে পারে, নিজেদেরটা করে খেতে পারে- সে জন্য তাকে অন্য কোথাও যেতে হয় না, আমদানি-রফতানি করতে হয় না, আদান-প্রদান করতে হয় না তখন নিজেদের ভাষা নিয়ে বেশ চুপটি করে দিন পার করে দিতে পারে। কিন্তু যদি তোমার মত কাউকে আজ আম্রিকা, কাল ইতালি, পরশু ফ্রান্স বা তরশু সেনেগাল যেতে হয়- তাহলে তো গোল লেগে যায়। কেউ কারো ভাষা নিয়ে এক জায়গায় বসে থাকতে পারে না। একে ওরটা শিখে নিতে হয়, তারপরে নিজ দেশে ফিরে গিয়ে সেটা বলতে বলতে একসময় কিছু কিছু বিদেশী শব্দ নিজ ভাষায় ঢুকিযে নেয়। বাংলা ঢুকে যায় ইংরেজিতে, ফ্রেঞ্চ চলে যায় ইতালিতে ইত্যাদি।
এটা না হয় বোঝা গেল। তা হলে সারা দুনিয়ায় এক ভাষা হবে কিভাবে? হাজার আদান প্রদান হলেও ইংরেজ কি তার নিজেরটা ছেড়ে জার্মান বলবে বা তুমিই কি এত আদরের বাংলাটা ছেড়ে সেনেগালি ভাষায় আমাকে গালাগাল দেয়া শুরু করবে? ভাষাটা তো আর শুধু কথা বলার মাধ্যমমাত্র নয়, এর সাথে যুক্ত হয়ে আছে হাজার হাজার বছরের অনেক আবেগ আর ঐতিহ্য। একেকটা ভৌগলিক সীমানায় একেক ভাষা তার আসন নিয়ে আছে। ভৌগলিক সীমানা মানে দেশ। কোন দেশ অর্থনৈতিকভাবে অনেক শক্তিশালী, কোন দেশ দূর্বল। প্রতিটি দেশের নিজস্ব ভাষার মত করেই আছে নিজস্ব অর্থনীতি, ইতিহাস, আচরণ, নীতি। কোন দেশ অস্ত্রের জোরে যেমন আরেকটা দেশ দখল করলে আমরা অন্যায় বলব তেমনি শক্তিশালী কোন জাতি আরেকটা জাতিকে যদি জোর করে নিজের ভাষায় কথা বলাতে চায় সেটাকেও অন্যায় বলব। যেমনটা বলেছিলাম ১৯৫২ তে আমাদের এই দেশেই।
শুরুতে তোমাকে চটিয়ে দিয়ে যে গল্পটা বলেছিলাম তাতে আবার একবার ফিরে যাই। যদি অমন হয় হুতোআসি এল যে জাপান থেকে সেটা আর কোন দেশ নয়, যেমনটা নয় আম্রিকা-ফ্রান্স বা ইতালি। এরা সবাই পৃথিবী নামক দেশের একটা স্বায়ত্বশাসিত জেলা। পৃথিবী দেশটা এক অর্থনৈতিক নীতি দিয়ে পরিচালিত হচ্ছে। জাপানের ভাষাও আছে, অনেকটা আমাদের দেশে নোয়াখালির ভাষা থাকার মত, আঞ্চলিক রূপে। কোথাও যেতে কোন বাধা নেই, কোন পাসপোর্ট ভিসার ঝামেলা নেই। এই পৃথিবী দেশটার কি তাহলে সব নাগরিকের ব্যবহার করার একটা ভাষা দরকার হবে না? আবার তুমি তেতে উঠলে তো? জানতে চাইলে, তাহলে সব ভাষা জোড়া লাগবে কি করে শুনি? থাক বাবা। তাহলে বলি শোন, এই স্বপ্নটা হয়তো একদিন বাস্তবই হবে। কিন্তু সে বাস্তবতা এত দুরে আর আমাদের কল্পনার এতটা দূরসীমায় যে, কিভাবে কি হবে সেটা খুঁটিযে খুঁটিয়ে বলা সম্ভব না। তবে তুমি অভয় দিলে কল্পনার পিঠে চড়েই পরের কোন লেখায় হয়তো এ নিয়ে কিছু গুল ঝাড়া যাবে।

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




