somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

একটি অসমাপ্ত প্রেমের গল্প

১৯ শে সেপ্টেম্বর, ২০২১ ভোর ৬:০৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


ছেলেটার নাম সাজিদ। ছেলেটা এতটাই ভদ্র ছিল, যে, তার ১৬ বছরের জীবনে সে কোনো মেয়ের দিকে চোখ তুলেও তাকায়নি। দুই-চারজন বন্ধু আর একরাশ একাকিত্বকে সঙ্গী করে সে তার স্কুল জীবন শেষ করে এগিয়ে চলল কলেজ জীবনের এক বিস্তীর্ণ দিগন্তের পথে।
দুরুদুরু বুক নিয়ে কলেজে ঢুকেই সে পিছু নিল তার চির আপন সেই বন্ধুদের। তারা এজন্য তাকে নিয়ে অনেক হাসাহাসি করত, “কি বোকা! গাধা একটা! এখনো স্বাবলম্বী হতে পারলি না!” এসব কথা একেবারেই গায়ে মাখতো না সাজিদ। আসলে, সাজিদ ওদের ছাড়া কখনই চলতে পারতো না। এভাবেই হাসাহাসি করতে করতে সাজিদ ক্লাসে গেল তার তিন বন্ধুর সাথে।
ক্লাসটাকে সাজিদ বাইরে থেকে যতটা ছোট ভেবেছিল, ততটা ছোট নয়। ক্লাসে ১২০ জন বসতে পারে, কিন্তু, ছাত্র সংখ্যা ছিল ১৫০ জন। আসলে শুধু ছাত্র নয়, ছিল ছাত্রীও। এটি বুঝতে সাজিদের অপেক্ষা করতে হয়েছিল আরো ১০ মিনিট। কিছুক্ষন পরই সাজিদ দেখতে পেল, দুটি মেয়ে ক্লাসে ঢুকলো, ক্লাসের অন্যান্য ছেলেদের মধ্যে মেয়ে দুটিকে নিয়ে বিভিন্ন কথা হচ্ছিল। এগুলো সাজিদের একেবারেই অসহ্য লাগে। কেন সবাই এসব করে, তা সাজিদের অভিজ্ঞতাহীন মস্তিস্কে ঢোকে না।
ক্লাসের ছাত্র সংখ্যা ১৫০ জন হওয়ায় জায়গা হচ্ছিল না ক্লাসে। তাই সাজিদ আর ওর তিন বন্ধুকেও দাঁড়াতে হলো। আসলে ওদের দাঁড়ানোর কোনো ইচ্ছা ছিল না। বোকা সাজিদটা পরোপকারী হয়ে পাশের একটা ছেলের কথায় নিজের আর ওর বন্ধুদের জায়গা ছেড়ে দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। এ জন্য তাকে তার বন্ধুদের রাগ সহ্য করতে হচ্ছিল। এমন সময় ক্লাসে ঢুকলো একটি মেয়ে। মেয়েটিকে দেখে সাজিদের মধ্যে কেমন একটি অনুভূতি কাজ করতে লাগল। সে কিছুক্ষন থমকে দাঁড়িয়ে থাকলো। মেয়েটি মাথা নিচু করেই গিয়ে বসল সামনের সারির একেবারে বাম পাশের একটি বেঞ্চে। বসেও সে মাথা নিচু করেই বসেছিল। সাজিদকে তার বন্ধুরা রাগারাগি করছিল। কিন্তু, সে দিকে কোনো হুশই ছিল না তার। সাজিদ একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকলো মেয়েটির দিকে, সেদিন ৩ ঘন্টা ক্লাস করে বের হলো সাজিদ। তার মুখ থেকে সেদিন আর কোনো কথাই বের হলো না। কোনো এক অজানা কারণে তার মধ্যে এক আমূল পরিবর্তন দেখা দিল। সেদিন রাতে সাজিদ ঘুমোতে পারলো না। সারারাত তার চোখের তারায় ভাসছিল সে লজ্জাময় মুখটি।
পরদিন কলেজে গিয়ে সে গিয়ে বসল ঠিক ২য় বেঞ্চে। যথারীতি মেয়েটি আসলো। সাজিদ ওকে দেখে কিছুক্ষন স্তব্ধ হয়ে ছিল। তারপর ও আবার বাস্তবতায় ফিরে আসে। সেদিন রোল কলের খাতা থেকে স্যারের মুখে মেয়েটির নাম জানতে পারে সাজিদ, ‘রোদেলা বিনতে রাঁচি’। নামটা শোনার পর থেকে সাজিদ আর এক ঘোরের মধ্যে চলে যায়। সাজিদ সেদিনও সারারাত ঘুমোতে পারে না।
এভাবে ১০-১২ দিন কাটে। সাজিদ, যে ছেলে এক মাসে এক দিন স্কুলে যেত না, কলেজ তার জন্য নিত্যদিনের সঙ্গী হয়ে উঠলো। প্রতিদিন ৩০ মিনিট আগে সে কলেজে গিয়ে উপস্থিত হতো। গিয়েই সেই ২য় বেঞ্চে বসা- এই ছিল তার দিনের একমাত্র লক্ষ্য। এভাবেই ১২ দিন পর একদিন ক্লাসে গেল সাজিদ। ২য় বেঞ্চে বসে ক্লাস করছে; গণিত ক্লাস। স্যার একটা গাণিতিক সমস্যা দিয়ে ঝিমুচ্ছেন। অন্যান্য ছাত্র- ছাত্রীরা সবাই যার যার মতো গল্প করছে। সাজিদও গল্পই করত, যদি না রাঁচিকে বিশেষ গুরুত্বের সাথে অংকটি সমাধান করতে না দেখত। সাজিদও অংক করা শুরু করল। সাজিদ অংকে খুব ভাল। সে তাড়াতাড়ি অংক করে বসে আছে- এমন সময় তার কানে এলো একটি মধুর আওয়াজ- “সাজিদ!” সাজিদ সামনে তাকিয়ে দেখতে পেল রাঁচি পিছনে ঘুরে তাকে ডাকছে। সাজিদের নিজের কানকে বিশ্বাস হচ্ছিল না। তবুও সবটুকু কৌতুহল আর আনন্দ সংবরণ করে সাজিদ উত্তর নিল।
রাচিঃ অংকটা কি পেরেছ?
সাজিদ তাকে অংকটি বুঝিয়ে দিল। সাজিদ সেদিন প্রথম কোনো অপরিচিতার সাথে কথা বলে।
পরের দিন সাজিদ ক্লাস শুরুর আগে মেয়েটিকে দেখতে পায় দাঁড়িয়ে থাকতে। সাজিদ অনেকখানি ভয় নিয়ে এগিয়ে যায় ছোট ছোট পা ফেলে। সাজিদ কাছে গিয়ে ডাক দেয়,
সাজিদঃ রোদেলা, তুমি কোন স্কুলে পড়তে? রবিপুর গার্লস স্কুলে?
রোদেলাঃ না। আমি আসলে অন্য জেলা থেকে আসেছি। আমি টেকনাফে থাকতাম। ওখান থেকেই এস.এস.সি পাশ করেছি।
সাজিদঃ ওহ! তুমি টেকনাফ থেকে এখানে এসেছ! পাগোল নাকি?
রোদেলাঃ না…… পারিবারিক সমস্যা ছিল।
সমস্যাটি সাজিদ জানতে পারে কিছুদিন পর। রোদেলার বাবা মারা যায় ক্লাস নাইনে থাকতে। তখন থেকেই অনেক সমস্যার মধ্যে দিয়ে বড় হতে হয়েছে তাকে। এই জেলায় তার কিছু আত্মীয় থাকায় এখানে এসেছে।
এরপর থেকেই ওদের মধ্যে বন্ধুত্ব হয়ে যায়। কিছুদিন পর সাজিদ রোদেলার মোবাইল নাম্বার নেয়। সাজিদই প্রথম রোদেলাকে মেসেজ দেয়। বিভিন্ন জল্পনা-কল্পনার সাগরে ডুবে সারারাত ঘুমোতে পারেনি সাজিদ সেদিন। পরদিন ক্লাসে আসতেই সাজিদ আবিষ্কার করে সাজিদের উপস্থিতিতে রোদেলার ঠোটের কোনায় এক আনন্দময় হাসি। এরপর থেকে ওদের মধ্যকার বন্ধুত্ব অন্য রূপ নেয়। প্রায়ই সাজিদ আর রোদেলা ক্লাস শুরুর আগে কলেজে আসত; কলেজে ঘুরত। গল্পে আড্ডায় ভালই কাটছিল ওদের দিন। সাজিদ রোদেলাকে ভালোবেসে ফেলেছিল সেই প্রথম দিন থেকেই। কিন্তু, সাজিদ এতটাই চাপা স্বভাবের ছিল যে, কখনও সে বলতেই পারেনি তার মনের কথা। অন্যদিকে, রোদেলার সাজিদের প্রতি সম্পর্কটা হয়ত ছিল শুধুই বন্ধুত্বের!
সাজিদের দিনগুলো যদি এভাবেই চলত, খুব ভালো হতো। কিন্তু, জীবন তো আর একভাবে চলে না। সাজিদের সাথেও এর ব্যতিক্রম হলো না। শত আনন্দের প্রজাপতির মাঝে আঁধার কালো হয়ে এলো তার জীবন।
সেদিন বরাবরেই মতোই সাজিদ কলেজে যায়। গিয়েই চোখ পড়ে ক্লাসের পিছনে আম গাছটার তলায় রোদেলা আর সাজিদের বেস্ট ফ্রেন্ড আকিব গল্প করছে। সাজিদ সেদিন কিছুই মনে করল না। কিন্তু, এভাবেই কেটে গেল ১০-১২ দিন। একদিকে রোদেলা আর আকিবের সম্পর্ক দৃঢ় হচ্ছিল; আর অন্যদিকে সাজিদের প্রতি রোদেলার অবহেলা বাড়ছিল।
একদিন আকিবের সাথে কথা বলার ফাঁকে সাজিদ প্রশ্ন করে,
সাজিদঃ দোস্ত, রোদেলা মেয়েটাকে তোর কেমন লাগে?
আকিবঃ ভালো, দোস্ত। অনেক ভালো মেয়ে।
আকিবের মুখ থেকে শোনা কথাগুলোর মাঝে সাজিদ অন্য একধরনের অনুভূতি পায়। আকিব অন্য কথায় চলে যায়।
সেদিন ছিল ১৪ই ফেব্রয়ারী। অনেক দিন ধরে ভেবেছে সাজিদ- নাহ! সে বলেই দেবে রোদেলাকে তার মনের সব কথা। সাজিদ বাজার থেকে ১০টি লাল গোলাপ কিনে নেয়। তারপর ব্যাগের মধ্যে লুকিয়ে কলেজে চলে যায়। ক্লাসের পিছনে ওই আমগাছটার পাশে রোদেলাকে মনে হয় একলা দাঁড়িয়ে আছে। সে গোলাপগুলো বের করে আরেকটু এগুতেই দেখতে পায়, তার বন্ধু আকিব, রোদেলাকে এক মুঠো গোলাপ দিয়ে প্রোপোজ করে এবং রোদেলা তা হাসিমুখে গ্রহণ করে নেয়।
সাজিদ খুব কষ্ট পায়। সে আর ক্লাসে যায় না। বাড়িতে ফিরে যায়। সে তার বাবার ওষুধের বাক্স থেকে দুই পাতা ওষুধ নিয়ে যায়। সে তার ঘরের দরজা বন্ধ করে দেয়। তারপর ১৭টি লেক্সাটেনিল ১০ মিলিগ্রাম ওষুধ ছিড়ে নেয়। তারপর একবারে সবগুলো গিলে নেয়। কয়েক মিনিটের মধ্যেই তার চোখের সামনে সব ঝাপসা হয়ে আসে। সে বিছানায় ঢলে পড়ে। তারপর………
এখানেই গল্পের শেষ হলে ভালো হতো। কিন্তু, না। এখানে গল্পের শেষ নয়। সেদিন রাতেই সাজিদের বাবা-মা সাজিদকে হাসপাতালে নিয়ে যায়। সাজিদের পেট থেকে সব ওয়াশ করে বের করা হয়। কিন্তু, ততক্ষনে অনেক দেরি হয়ে যায়। ওষুধের বিষক্রিয়া তার সারাদেহে ছড়িয়ে যায়। তার দুই হাত-পা সম্পূর্ণ প্যারালাইসড হয়ে যায়। সাথে সে তার বাকশক্তিও হারিয়ে ফেলে। শুধুমাত্র তার ব্রেইন কাজ করে।
সেদিন বিকালে খবর পেয়ে রোদেলা সাজিদকে দেখতে আসে। সাজিদকে দেখে সে চলে যায়। যাওয়ার সময় সাজিদ অনেক চেষ্টা করে রোদেলাকে ডেকে তার মনের কথাটা বলতে। কিন্তু, পারে না। শুধু তার চোখ দিয়ে কফোঁটা জল গড়িয়ে যায়।

জীবনটা কোনো কাগজে কলমে বন্দি গল্প নয়, যে সব সময় একটা হ্যাপি এন্ডিং থাকবে। জীবনের রেলগাড়ি কোথায় গিয়ে থামবে, তা কেউ কখনো বলতে পারে না। “জীবনে ভবিষ্যৎ বলে কিছু নেই, বর্তমানটাই সব। কিছু করার থাকলে এক্ষুনি করতে হবে, কি বলার থাকলে এক্ষুনি বলতে হবে, ভালোবাসতে হলেও এক্ষুনি বাসতে হবে। ভবিষ্যৎ একটা মরীচিকা।“- টলস্টয়ের এই উক্তিটা আমরা কেবল আত্মস্থই করতে পারি; ধারণ করতে পারি না।
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে সেপ্টেম্বর, ২০২১ ভোর ৬:০৯
১টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমার প্রফেশনাল জীবনের ত্যাক্ত কথন :(

লিখেছেন সোহানী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সকাল ৯:৫৪



আমার প্রফেশনাল জীবন বরাবরেই ভয়াবহ চ্যালেন্জর ছিল। প্রায় প্রতিটা চাকরীতে আমি রীতিমত যুদ্ধ করে গেছি। আমার সেই প্রফেশনাল জীবন নিয়ে বেশ কিছু লিখাও লিখেছিলাম। অনেকদিন পর আবারো এমন কিছু নিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমি হাসান মাহবুবের তাতিন নই।

লিখেছেন ৎৎৎঘূৎৎ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



ছোটবেলা পদার্থবিজ্ঞান বইয়ের ভেতরে করে রাত জেগে তিন গোয়েন্দা পড়তাম। মামনি ভাবতেন ছেলেটা আড়াইটা পর্যন্ত পড়ছে ইদানীং। এতো দিনে পড়ায় মনযোগ এসেছে তাহলে। যেদিন আমি তার থেকে টাকা নিয়ে একটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তিযোদ্ধাদের বিবিধ গ্রুপে বিভক্ত করার বেকুবী প্রয়াস ( মুমিন, কমিন, জমিন )

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৫:৩০



যাঁরা মুক্তিযদ্ধ করেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে লেখা তাঁদের পক্ষে মোটামুটি অসম্ভব কাজ। ১৯৭১ সালের মার্চে, কৃষকের যেই ছেলেটি কলেজ, ইউনিভার্সিতে পড়ছিলো, কিংবা চাষ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো, সেই ছেলেটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সাংঘাতিক উস্কানি মুলক আচরন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৪



কি সাঙ্ঘাতিক উস্কানিমুলক আচরন আমাদের রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর । নাহ আমি তার এই আচরনে ক্ষুব্ধ । ...বাকিটুকু পড়ুন

একটি ছবি ব্লগ ও ছবির মতো সুন্দর চট্টগ্রাম।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৮:৩৮


এটি উন্নত বিশ্বের কোন দেশ বা কোন বিদেশী মেয়ের ছবি নয় - ছবিতে চট্টগ্রামের কাপ্তাই সংলগ্ন রাঙামাটির পাহাড়ি প্রকৃতির একটি ছবি।

ব্লগার চাঁদগাজী আমাকে মাঝে মাঝে বলেন চট্টগ্রাম ও... ...বাকিটুকু পড়ুন

×