তোমার ফিরে না আসা বার্ষিকী উপলক্ষ্যে আমার এ লেখা।
মা,
কোনদিন আমি তোমাকে চিঠি লিখি নাই। তার প্রয়োজনও ছিল না। আমার এ লেখা কি তোমার কাছে পৌঁছাবে? আজ কাল ডাক পিয়নরাতো চিঠি বিলি করে না। আমি জানি না তুমি কোথায় আছ, কেমন আছ। এই চিঠি তুমি পড় বা না পড়, তোমার জন্যই লেখা। প্রযুক্তির কল্যানে সবাই দেখবেন এ চিঠি, দেখুক।
আজ তোমাকে দেখলাম। অনেক দিন পরে। কেমন আছ তুমি? । কত দিন, কত সহস্রদিন তোমাকে দেখি না, মা! কত সহস্র দিন কোন স্পর্শ নেই তোমার। মনে হয় কত হাজার বছর আমি `মা' শব্দটি উচ্চারন করি না। কতদিন তোমার দরাজ কন্ঠ আমি শুনি না। তুমি থাকবে না কখন্ও বুঝিনি। তুমি থাকবে ততদিন যতদিন আমি থাকি- এরকমই যেন কথা ছিল।
আমরা তোমাকে প্রায় ভুলেই গেছি। দেখতে তুমি কেমন ছিলে, মা হিসেবে কেমন ছিলে -পরিবারের সবার প্রতি তোমার দায়িত্ব কেমন ছিল- সব সব কিছু ভুলতে বসেছি। মা- বলে আমাদের জীবনে কেউ ছিল এখন তেমনটা মনে হয় না। কারণ আমরা এখন বেশ ব্যস্ত। তবে পরিবারের সবার প্রতি যে মহান দায়িত্ব তুমি পালন করেছ তা- আমরা প্রত্যেকে হাঁড়ে হাঁড়ে টের পেলাম, চোখের সামনে থেকে মোটা পর্দা সরে যেতে লাগল যখন তুমি বিছানায় পড়লে।
দিনের পরে দিন আসছে। আসছে বছরের পর বছর, ঘুরে আসে ঈদ, পার্বন। তোমাকে ছাড়া আমাদের কোন আনন্দ-ফুর্তি অপূরণ থাকছে না। তবুও মাঝে মাঝে বুকের মধ্যে হা হা কার লাগে, নিজের অজান্তে দীর্ঘ শ্বাষ বেরিয়ে আসে। শপিংয়ে গিয়ে খুব মিস করি। তোমার জন্য যদি কিছু একটা কিনতে পারতাম! এক সময় আমাদের খুব অভাব ছিল। ভাল দামী কাপড় তোমার ভাগ্যে জুটতো না। কত কষ্ট করে তুমি আমাদের লেখা পড়া শিক্ষিয়েছ। আজ আমাদের কারো কোন অভাব নাই -মা। তোমার ছেলে মেয়েরা আজ প্রতিষ্ঠিত। অভাব হলো -তুমি নাই।
আগে মনে হতো তুমি অনেক কঠিন, অনেক চতুর। আমাদের চোখের দিকে তাকিয়ে বলে দিতে কোন বদমায়েশি করেছি। তোমার অগোচরে দারোগা বলতাম তোমাকে। আজ আমিও তোমার জায়গায়, তোমারই রোল প্লে করছি, মা। আমিও `মা' হয়েছি। এখন উপলব্ধিটা পাল্টে গেছে । । আসলে তুমি খুবই সাদা মাটা ছিলে। এতটাই সাদাসিদে ছিলে যে অভিযোগও করতে জানতে না। ভাবতে এটাই তোমার প্রাপ্য। আর আমরাও এ নিয়ে কখনো ভাবিনি। কারন তুমি ছিলে মা। মাদের আলাদা কোন সুখ থাকতে নেই, সব সুখ তার স্বামী, সন্তান আর স্বামীর আত্মীয় স্বজনদের সুখে। আব্বা ব্যস্ত থাকত তার কারবার নিয়ে। ছেলে-মেয়েরা গোল্রায় যাক বা না যাক এ নিয়ে তার কোন ভাবনা ছিল না। আর তুমি দু`হালি ছেলে মেয়েদের লেখা পড়া, তাদের জন্য রান্না করে খাওয়াতে এবং স্বামীর জন্য মধ্য রাত পর্যন্ত না খেয়ে অপেক্ষা করতে। সব দিন দেখেছি তুমি কড়াইতে ভাত খেতে। তখন বুঝতাম না কেন এমন কর। কী প্লেটের অভাব? না- এখন বুঝতে পারি। সবার খাওয়ার পর তরকারী কম থাকত বলে তুমি কড়াইতেই খেতে। এতেই ছিল তোমার সুখ।
আজ খুব বুঝতে পারছি, `মা' কে? মা যে সংসারের ঘানি টানে, সব চেয়ে ভাল রাঁধে যে, বাড়ে যে, কাপড় চোপড় ধুয়ে রাখে যে। মা মানে হাড় মাংস কালি করে সকাল থেকে রাত অবধি খাটে যে, যার হাঁসতে নেই, যাকে কঁাদলে মানায়। মা কষ্ট পেলে আমাদের কিছু যেত আসত না। মা জ্বরে ভুগলেও না, গ্যাস্টিকের ব্যাথায় রাত ভর চেচাঁ মেচি করলেও না- ভাবতাম খামোখা আহ্বলাদ। না খেয়ে শুকিয়ে কাঁটা হয়ে গেলেও না, পরনে শাড়ি ছিড়ে ত্যানা হলেও না। মাকে মা বলে মনে হত, মানুষ বলে না।
তুমি মা বলে তোমার নিজস্ব কোন স্বাধীনতা ,স্বকীয়তা থাকবে না? সত্যিই তুমি বোকা ছিলে মা। বড় হয়ে কিছুটা বুঝতে শিখলাম যখন তখন মাঝে মাঝে তোমাকে এমনই মনে হত। এখন আমার জীবনের প্রতিক্ষেত্রে তোমার সাথে তুলনা করে যা পাই তা হলো তুমি কতটাই অবহেলিত ছিলে। আমার মায়ের জীবনের একার গল্পই যথেষ্ট আমাদের সমাজের নারীদের অবস্থান জানতে।
`সংসার সুখের হয় রমনীর গুনে'-এই কথার উপর অন্ধ বিশ্বাস আর উপলব্ধি নিয়ে তুমি সংসারের ঘানি টেনেই গিয়েছ। জীবন অনেক বদলে গেছে মা। আগে এ কথা অনেক বেশি বলা হতো। এখন কিছুটা কমেছে। কারন এখন সবাই বুঝতে শিখেছে কারোর একার গুণ দিয়ে সংসার সুখী করা যায় না। কারন সংসার হল হাতের তালির মতো একটি দ্বিমুখী প্রতিক্রিয়া। সংসার সুখের করতে স্বামী-স্ত্রী উভয়েরই সমান অংশগ্রহন দরকার পড়ে।
আর এখন এমন কথায় সবার আগে হাসবে মেয়েরা। আর বিবাহিত পুরুষরা বায়বীয় সুখ খোঁজার চেষ্টা করবেন আকাশের দিকে তাকিয়ে। কারণ তারা জানে এটা শুধু কথারই কথা। এখনকার স্ত্রীরা হল ডিজিটাল বউ। তোমার মত কেউ স্বামীর জন্য না খেয়ে রাত জেগে বসে থাকে না। অন্য কোন বউদের কথা বলতে পারব না। আমার পক্ষে এমন পতিভক্তি যে করা সম্ভব নয়- তা আমি নিশি্চত করে বলতে পারি। কারন আমি তোমার মত অত নিঃস্বার্থ নই, আমি তো তোমার মত অত বড় মানুষ নই।
আমার স্বামী তোমার খুব পছন্দের ছেলে। জান মা ও আস্ত একটা ভেজা বেড়াল। এমনই ভেজা যে ভাজা মাছটাও উল্টিয়ে খায় না-যদি আমি অনুমতি না দেই। সব সময় এমন স্বামীইতো চেয়েছি। যাতে সোজা আঙ্গুলে ঘী উঠে । আঙ্গুল বাঁকা করতে না হয়। কারন তোমার মত ওমন পতি ভক্তি আমার পক্ষে সম্ভব নয়।
মা, আমার যত টুকু ভাল, তা তোমার কারনে, যতটুকু মন্দ তা আমার নিজের কারনে।
ভাল থেক, খুব বেশী ভাল।
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে জানুয়ারি, ২০১৫ দুপুর ১২:২৪