সেদিন ছিল শুক্রবার ১৮ অক্টোবর ২০০২। বাসায় ব্যস্ততা সত্বেও আতিক ভাইদের বাড়ি (বাঁশখালী) যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিলাম। এর আগের রাতে বিপ্লবদা বললেন বাঁশখালী যাওয়ার কথা, যদিও অর্থনৈতিক এভং পারিবারিক কারণে যাবনা- এরকমই স্থির করেছিলাম। আবার এত লোকের আড্ডার লোভও সামলাতে পারছিলাম না। অবশেষে ১২ টায় বহদ্দারহাট মোড়ে পৌঁছুলাম। অবশ্য এর আগেই সম্পূর্ণ দল আমার জন্য সেখানে অপেক্ষা করছিলো।
বাঁশখালীর আঁকাবাঁকা- খানা - খন্দক যুক্ত পথের ভ্রমণ শেষে চেরাগী পাহাড় এর মোড়ে এসে পৌঁছুলাম সন্ধ্যে পৌনে ৬টায়। আগেই প্রোগ্রাম ছিল তেল-গ্যাস-বন্দর রক্ষা কমিটির লং মার্চ উপলক্ষে প্রচার মিছিল করার। ৭ টায় মিছিল সহকারে আমরা চেরাগী পাহাড়ের মোড় থেকে বের হয়ে জামালখান সড়ক ধরে কাজীর দেউড়ি পৌঁছলাম। তখন সন্ধ্যা ৭টা ২০ হবে। শুরু থেকেই আজকের প্রোগ্রাম গুলোতে আমার আগ্রহ খুব বেশী ছিল না। এব মিছিলের এক পর্যায়ে জামাল খানের মোড় থেকেই আমি মিছিল ঘুরিযে দিতে বলেছিলাম।
কাজির দেউরির খোয়জা হোটেলের সামনে আমাদেও মিছিল শেষ হলো- শরণ রিকসার উপর দাঁড়িয়ে বক্তৃতা করছিলো- আমরা ক’জন সামনের দিকে ছিলাম। হঠাৎ দুটো পুলিশের গাড়ি চারিদিক থেকে আমাদের ঘিরে ফেললো। আমরা আটজন পুলিশের হাতে আটকা পড়লাম। অনেকে দৌড়ে পালাতে সক্ষম হলো। আমিও এক পর্যায়ে পুলিশের হাত গলে দৌড় দিলাম। কিন্তু বিধি বাম। কিছু দূর গিয়েই বসে পড়লাম। কারণ আমি অসুস্থ ছিলাম। যাই হোক শেষ পর্যন্ত সেখান থেকে পুলিশ ভ্যানে করে আমাদেও থানায় নিয়ে যাওয়া হলো।
জীবনে প্রথমবার পুলিশ ভ্যানে চড়া। বুকটা দুরু দুরু কাঁপছে। বাসায় কী প্রতিক্রিয়া হয় এই ভেবে বার বার শিউরে উঠছিলাম। বাবা-মার বার বার নিষেধ সত্বেও রাজনীতি ছাড়তে পারছি না। আবার এই রাজনীতির কারণেই জেল এ যাওয়া- এসব ভাবনায় অস্থির হয়ে পড়ছিলাম।
সন্ধ্যে সাড়ে ৭টায় আমদের থানায় নিয়ে আসা হলো। ডিউটি অফিসারের সামনে সবাইকে নাম ঠিকানা বলতে হলো। তারপর থানা লক আপে ঢুকিয়ে দিলো। অমিতাভ দা ছাড়া বাকী সবাই বয়সে আমার চেয়ে ছোট। তবু আম্মার কথা ভেবে আমাকেই সবচেয়ে বেশী ভীত মনে হচ্ছিল। শরনের জেল এবং থানা হাজতে থাকার পূর্ব অভিজ্ঞতা ছিল। আমি, অমিতাভ দা এবং দর্জি শ্রমিক কবিরের পূর্ব অভিজ্ঞতা ছিল না। কবির যে ছিল ঐ পথসভার একজন অগ্রসর শ্রোতা মাত্র। সে তো জেল খানায় ঢুকেই হাউ মাউ করে কান্না কাটি শুরু করে দিয়েছিল।
দীর্ঘক্ষণ মন মরা হয়ে থানা হাজতের ১২ শিকের (১৪ নয়, আমি গুনে দেখেছি) ভিতর বসেছিলাম। রাত প্রায় ৯টার দিকে জাহাঙ্গীর ভাই এ্যাড. মনির ভাই আসলেন। থানায় ঢুকানোর পর পরই মনে পড়ল শাহআলম ভাই আর মৃণাল দার কথা। জানলাম প্রেসিডিয়াম মিটিং এর জন্য ওনারা ঢাকায় আছেন। তাই শুরু থেকেই শংকার মধ্যে ছিলাম থানা থেকে মুক্তি পাবার বিষয়ে। এরপর আস্তে আস্তে সবুজ ভাই, বিপ্লব দা এরা এলেন। এবং বুঝতে পারলাম রাতে থানা হাজতেই থাকতে হবে। রাত যেখানেই থাকি সেখানকার টয়লেট নিয়ে আমার একটা দুশ্চিন্তা থাকে। আর এখানকার টয়লেটের চিন্তা করেই আমার ব্লাড প্রেসার এবং সেই সাথে এসিডিটি বেড়ে গেল। ওখানকার টয়লেটের অবস্থা দেখলে এমনকি শুনলেও যেকোন সুস্থ লোকেরও অসুস্থ হয়ে যাবার সম্ভাবনা আছে।
রাতে মিন্টুরা খাবার নিয়ে এলো। সবাই ভাত খেলেও আমি ১টা কলা এবং দু’পিস পাউরুটি দিয়ে কোন মতে ক্ষুধা নিবারণ করলাম। সবুজ ভাইকে দিয়ে দুলাভাইকে সত্য ঘটনা জানাতে বললাম, কিন্তু বাসায় আম্মাকে বলতে বললাম যে, বাঁশখালী হতে রাতে ফিরতে পারিনি।
রাতে ছাড়া পাবার আশা যখন দূরীভূত হল তখন সবাই ঘুমানোর আয়োজন করতে লাগলাম। আয়োজনটা এমন সেন্ডেল জোড়া মাথায় দিয়ে ফ্লোরে শুয়ে পড়া। অনেকে মিনারেল ওয়াটারের খালি বোতল মাথায় দিয়েও ঘুমানোর চেষ্টা করেছে। তবে সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় এত কিছুর পরও বেড-বিছানা ছাড়াও আমার ঘুমের এতটুকু কমতি হয়নি।
থানা হাজতে আমরা ৮ জন রাজবন্দী সহ সর্বমোট ছিলাম ১৯ জন। এর মধ্যে সাইকেল চোর, হেরোইন আসক্ত সহ নানা রকমের লোকজন ছিল। এসবের মধ্যে নিজেকে কিছুতেই মানিয়ে নিতে পারছিলাম না। তবে শরণ, রিপন এরা থাকাতে এরকম দূসময়ও মোটামুটি ভালভাবেই কাটাতে পেরেছি।
ভোর ৬টার দিকে ঘুম ভাঙলো, অবশ্য এর মধ্যে বেশ কয়েকবার জেগে উঠেছি। দেখতে দেখতে সাড়ে ৯টা বাজলো।্ কিন্তু তখন পর্যন্ত কেউ আসলো না। পকেটে আমার ১১শ’ টাকা ছিল। ১০০ টাকা খরচ করে সবার জন্য পরাটা ভাজি আনালাম। এর কিছুক্ষণ পর মনির ভাই এলেন, উনি একটা পূর্বকোণ ও একটা প্রথম আলো দিয়ে গেলেন। এরপর রিপায়ন, মনি এরাও এলো। থানা থেকে আমরা আর ছাড়া পেলাম না। ও, এর মধ্যে শাহআলম ভাই ও মৃণাল দা ও এলেন। দেড়টার দিকে কোর্টে চালান দেবার কাগজ পত্র এলো। একজন পুলিশ নাম পড়ে শোনালো। কিন্তু সবার নাম থাকলেও সাফি-র নাম তাতে পড়া হলো না। আমরা একটু চিন্তিতি হলাম- বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছি বলে। কিন্তু বোঝা গেল ওটা ওদের ভুল ছিল। সুইট এবং মনি দুপুরের খাবার নিয়ে এলো। কিন্তু ততক্ষণে আমাদেরকে হ্যান্ডকাপ পড়ানো হয়ে গেছে। তাই কেউ আর দুপুরে খেতে পারলাম না। এরপর বারান্দায় দাঁড়ানো অবস্থায় আমাদেও সবার এক এক কওে ছবি ওঠানো হলো। তারপর পুলিশ ভ্যানে করে সোজা কোর্টে। গাড়ি থেকে নামতেই অনেককেই দেখতে পেলাম। তারপর হাজত লক আপের বারান্দায় বসিয়ে রাখা হলো। ওখানে এ্যাড.মুনির, বেঙ্গল-রা এলো। থানায় থাকা অবস্থায় শুনেছিলাম কোর্টে মুভ হবে এবং আমাদেও জামিন হয়ে যাবে। কিন্তু কেন যেন ধীওে ধীওে সেই আশা মন থেকে সওে যাচ্ছিল । তারপর এক পুলিশ বললো টাকা-পয়সা, বেল্ট এসব দিয়ে ফেলতে। আমি ভেতরের পকেটে রাখা এক হাজার টাকা এবং বেল্টটি বিপ্লবকে দিয়ে দিলাম। সেরকম অন্যরাও দিয়ে দিল। মানিব্যাগটা পকেটেই ছিল। তারপর সবাইকে এক এক কওে কোর্ট লক আপে ঢোকানো হলো। ওখানে ঢুকেই দম বন্ধ হবার জোগাড় হলো। একটু খানি রুমের ভিতর শ’পাঁচেক লোক। একটু বসার জায়গা নেই। নীচে ময়লা-আবর্জনা, মল-মূত্রের উৎকট গন্ধ। এসবের মধ্যেই অনেকে ক্ষুধা নিবারণ করছে। কিন্তু আমরা পারছিলাম না। হঠাৎ অমিতাভদা মাথা ঘুরে পওে গেল। উনি হাই প্রেসারের রোগী। এত যন্ত্রণা তার সহ্য হয়নি। সাফি ভাইয়ের কাছে বিটানল ট্যাবলেট ছিল, ওখান থেকেই একটা খাইয়ে দেয়া হলো। এবং অন্যরা তাকে বাতাস করছিলাম। পওে তাকে বাইরের বারান্দায় নিয়ে বসানো হলো। এর মধ্যে খবর(খারাপ খবর) এলো আমাদেও জামিন হয়নি। আবার বুধবার মুভ হবে। সবাই আশাহত হলাম। দীর্ঘ ৫দিন জেলে থাকতে হবে- ভাবতেই শিউরে ওঠছিলাম। বার বার ভাবছিলাম এ কী হয়ে গেল। অনেক সময় গায়ে চিমটি কেটেও দেখছিলাম, ঘটানাটা সত্য নাকি স্বপ্ন।
প্রায় ৪টার দিকে কোর্ট লক আপ থেকে বের করে আবারও হ্য্ন্ডকাপ পড়ানো হলো এবং প্রিজন ভ্যানে ওঠানো হলো। মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে গেল। ভ্যানে ওঠানোর আগে সবার জন্য লুঙ্গি-গামছা এবং খাবার দেয়া হলো। ভ্যানে ওঠার পর নেটের ফাঁক দিয়ে বাইওে দেখছিলাম। আমাদেরকে বিদায় জানানোর জন্য সবাই অপেক্ষা করছিলো। আমার গোমরা মুখ দেখে বিপ্লবদা বললেন একটু হাসতে। কষ্ট কওে একটু হাসলাম। তারপর কোন রাস্তা ধওে প্রিজন ভ্যান আমাদেও নিয়ে যাচ্ছিল বুঝে ওঠতে পারিনি। এক সময় জেল গেটে উপস্থিত হলাম। আবারও একে একে আমাদেও গাড়ি থেকে নামানো হলো। তারপরের অভিজ্ঞতা তিক্ততা আর কৌতুহলে ভরা।
জেলারের অফিসে আমাদেরকে মাটিতে সারিবদ্ধভাবে বসানো হলো, তার আগেই সবার হ্যান্ডকাপ খুলে দিয়েছিলো। তারপর সবার নাম ঠিকানা জিজ্ঞেস কওে বেল্ট, টাক-পয়সা সব কিছু জমা রেখে মূল কারাগাওে পাঠিয়ে দিলো। তখন প্রায় সন্ধ্যা। আমাদেও সবাইকে আমদানী সেলের সামনে রাস্তার উপর ৪ জন – ৪ জন কওে সারিবদ্ধ ভাবে বসানো হলো। তবে বসার স্টাইলটা একটু অন্য রকম-হাঁটুর উপর ভর করে। পওে জানলাম এ রকম বসাকে বলে ফাইলে বসা। এখানেও আবার চেক। এর আগের চেকে আমার মানিব্যাগ ফেলে দিয়েছিলো-যার মধ্যে প্রয়োজনীয় অনেক কাগজপত্র ছিলো। যদিও ওর ছবি এবং দু ’টো চিঠি বের কওে নিতে পেরেছিলাম।
চেকিং শেষে যখন আমদানী ওয়ার্ডে নিয়ে যাওয়া হলো তখন অন্ধকার হয়ে গেছে। ওখানে ঢুকে প্রচন্ড ভয় পেয়ে গেলাম। গেইটের বাম পাশে আমাদের বসতে দেয়া হলো। তখনও বুঝতে পারছিলাম না এর পর আমাদেও পরিণতি কী। প্রায় আধ ঘন্টা পর আবার চেক শুরু হলো-এবার পুলিশ চেক নয়-এটা ভিতরকার কয়েদীদেও কাজ। অর্থাৎ টাকা-পয়সা, মূল্যবান জিনিস পত্র থাকলে হাতিয়ে নেয়া। আবারও অপেক্ষা। আনুমানিক রাত নয়টার দিকে সবার ঘুমানোর ব্যবস্থা হচ্ছিল। অনেককেই দেখলাম হল রুমটার দেয়াল ঘেসে সুন্দও বিছানা কওে শুতে। আর বেশীর ভাগকেই শুতে হলো একজনের সাথে একজন গাদাগাদি করে। যেখানে নিঃশ্বাস নেয়াও কষ্টকর। আমাদেও জায়গা হলো টয়লেটের দরজার একটু সামনে। কিছুক্ষণ পরপর যেখানে উৎকট গন্ধ বের হচ্ছিলো। এই পরিবেশে অবস্থান করাটাই যেখানে কল্পনাতীত, সেখানে সত্যি সত্যি আমাদেও ঘুমাতে হচ্ছে। শরীরটা এত বেশী ক্লান্ত ছিল যে এই অবস্থায়ও মোটামুটি ঘুমিয়ে নিয়েছিলাম। রাতে বেশ কয়েকবার ঘুম ভেঙেছে। তখন যে দৃশ্য দেখেছি তা খুবই করুণ। অনেকে চাপাচাপির জন্য ঘুমাতে পারছিলোনা, তাই ওঠে বসে যেতে চাচ্ছিল। কিন্তু ওখানকার পাহারা, জমাদার তারা সেটা হতে দিবে না। বকা-ঝকা, প্রহার কওে আবারও শুয়ে পড়তে বাধ্য করছিলো। এভাবেই কোনমতে ভোর হয়ে এল। ভোর বলতে সকাল ৪টা/সাড়ে ৪টা হবে। সবাইকে জোড় কওে উঠিয়ে দেয়া হলো। তারপর আবার ফাইলে বসা।
ভোরের আকাশে যখন একটু একটু আলো ফুটে ওঠলো তখন আমাদেরকে আমদানী সেলের বাইরের বারান্দায় নিয়ে যাওয়া হলো। তখনও প্রচন্ড বৃষ্টি হচ্ছিলো-যেটা শুরু হয়েছিল রাত থেকেই। ওখানেও আবার ৪জন কওে সারিবদ্ধভাবে বসানো হলো। শুনলাম ওখানে আমাদেও মেডিকেল টেস্ট হবে। একটা আশাঙ্কার মধ্যে ছিলাম-এটা আবার কি? সামনের টেবিল রাখা জেলার সাহেবের জন্য। উনি তখনও এসে পৌঁছাননি। তার একটু আগে ডাক্তার সাহেবের টেবিল। এরই মধ্যে একজন নাম ডেকে ডেকে শিক্ষাগত যোগ্যতা এবং জেলে নতুন নাকি পুরাতন সেই তথ্য লিপিবদ্ধ করছিলো। আরেকজন ওজন এবং উচ্চতা মেপে ডান হাতে লিখে দিচ্ছিল। তারপর ডাক্তার সনাক্তকারী দু’টো দাগ/চিহ্ন খুঁজে তা বিবরণীতে লিখছিল। এর মধ্যে দেখলাম ড্রেস পরিহিত বেশ কয়েকজন কয়েদী বেছে বেছে অনেকেওে নাম টুকে নিচ্ছিল। পওে জানলাম এরা ওয়ার্ডেও মেট এবং এখানথেকে সিসি কেটে টাকা দিয়ে নতুন আগন্তুকদেও কিনে নিয়ে যায়। বিশভূষা দেখে দও নির্ধারিত হয়। পওে ওয়ার্ডে নিয়ে গিয়ে এর দ্বিগুণ তিনগুণ উদ্ধার করা হয়। জেল খানায় টাকা অবৈধ, আবার এই টাকা ছাড়া ওখানে কিছুই করা যায়না। টাকা দিলে রাজার হালে থাকা যায়। এসব টাকার ভাগ জেল সুপার থেকে শুরু কওে মেট পর্যন্ত সবাই পায়। এরও একটা নিদিষ্ট রেট আছে। প্রতিদিন সকাল ১০টায় জেল সুপার পরিদর্শনে আসেন। জেলারের মাধ্যমে তার ভাগ তার কাছে পৌঁছে যায়।
ডাক্তারী পরীক্ষা শেষে চুল কাটাতে আমাদেও খোলা মাঠের দিকে নিয়ে যাওয়া হলো। সেখানে ১০/১২ জন নাপিত-যারা পেশাদার নয়-একের পর এক খুব দ্রুত গতিতে চুল কাটছিল। চুল কাটা শেষে সকালের নাস্তা- ইয়া বড় বড় আটার রুটি আর ডাল খেতে দেয়া হল। ঐ রুটির সামান্য একটু খেলাম। তারপর আবার আমদানী সেলে গিয়ে বসতে হলো।
বেশ কিছুক্ষণ পর জানালা দিয়ে আমাদেও ৪ জনের নাম ধওে ডাকলো। আমরা দেখা করতে গেলাম। আমি, শরণ, প্রীতম এবং রিপনের নামেই ডাক এসেছিল। আমাদেরকে সাথে কওে নিয়ে যাওয়ার জন্য আমদানী ওয়ার্ডেও রাইটার-বদমেজাজী নুর আলম তৈরী হল। যেতে যেতেই সে বলল জন প্রতি যেন অবশ্যই ১০০০ টাকা কওে তাকে নিয়ে দিই। আমরা ভীষণ ঘাবড়ে গেলাম। সে আমাদেও হুমকি দিল যদি তার কথা মত টাকা না দেই তবে আমাদেও ওপর অত্যাচার করা হবে। অত্যাচারের ধরণটা হল-সে টয়লেটের ভিতর একটা আংটি ফেলে দিবে এবং সেটা আমাদেরকে খুঁজে আনতে হবে।
আমাদেও সাথে দেখা করার জন্য বিপ্লবদা, সবুজ ভাই ও রিপনের বাবা-মা এলেন। তারা আমাদেও জন্য লুঙ্গি, গামছা,কিছু খাবার এবং বিড়ি(যা জেলের টাকা বলে খ্যাত) নিয়ে আসলেন। অনেক চাপাচাপির পর ৪৯০ টাকা নুর আলকে দেয়া হল। সে কিছুতেই মানছিল না। আমি ,শরণ ধরেই নিয়ে ছিলাম ওয়ার্ডে গিয়েই সে আমাদেও সাথে খারাপ আচরণ করবে। আমরা পলিথিন ভরা জিনিস পত্র ওয়ার্ডেও দিকে নিয়ে যাচ্ছিলাম, কিন্তু পথে প্রায় ৪/৫টা চেক অতিক্রম করতে হল। প্রতি চেকেই আমার কিছু না কিছু হারালাম। ওয়ার্ডে ঢুকেই নুর আলম তার ওপরের দিকের লোককে জানাল যে আমরা টাকা দিয়েছি, সাথে সাথেই আমাদেও জন্য আলাদা চাদর বিছিয়ে বসার জায়গা কওে দিল।
বেলা ১২টার দিকে আবার রুটি-ডাল এলো। এরপর শুধু অজনা ভবিষ্যতের জন্য অপেক্ষা। আনুমানিক ২টা/৩টার দিকে জেল কর্তৃপক্ষেও একজন এবং ওয়ার্ডেও মেটরা এলো। বন্টন এবং সি.সি. অনুযায়ী আসামীদেও বিভিন্ন ওয়ার্ডে নেয়া হলো। আমি এবং সাফি ভাইকে ৯ নং ওয়ার্ডে, রিপন কাউসার এবং শরণকে ৩ নং ওয়ার্ডে, প্রীতমকে ২ নং, অমিতাভ দাকে ১ নং এবং কবিরকে কিশোর ওয়ার্ডে নিয়ে যাওয়া হলো।
আমরা যখন ওয়ার্ডে গেলাম তখন প্রায় পড়ন্ত বিকেল। মেটের পিছু পিছু যাচ্ছি আর অজানা ভয়ে আশংকিত হচ্ছি। আমাদেও মেটের সিটেই বসানো হলো। সিট বলতে রুমের মুখে চাদও বিছিয়ে একটু আলাদা শোবার ব্যবস্থা। বেশ কিছুক্ষণ বসেই কাটালাম। এরপর মেট-যার নাম জাহাঙ্গীর-পুলিশ হত্যা মামলায় ৭ বছরের সাজা প্রাপ্ত আসামী-এলো এবং আমার সাথে থাকার ব্যাপাওে আলাপ শুরু করল। এর আগে আমাদেও এলাকার পরিচিত এক কয়েদী (লম্বা সেলিম)-র সাথে দেখা হল এবং সে জানাল যে এরকম এক সিটের জন্য তিন হাজার টাকা দিতে হয় এবং এক/দেড় হাজার দিতে দিতেই জামিন হয়ে যায়। কিন্তু জাহাঙ্গীর যা বলল তাতে আমার চোখ কপালে ওঠে গেল। সে বলল আমাদেও দু’জনকে মোট বিশ হাজার দিতে হবে এবং তা দুই দেখায়। ”দুই দেখা” বলতে কেউ যখন আমাদেও সাথে দেখা করতে আসবে সে ভাবে দুই বাওে টাকা পরিশোধ করতে হবে। জেলের ফাঁক-ফোকর কিছুই জানা ছিল না, তাই খুবই ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। আগের আইডিয়া অনুযায়ী আমি ৬ হাজার পর্যন্ত বললাম। কিন্তু জাহাঙ্গীর তাতে সন্তুষ্ট নয়। কিছুক্ষণ পওে তার ইশারায় আমাদেরকে নিসট থেকে নামিয়ে দিল এবং দেয়াল ঘেষে করিডোওে বসতে বলল। এরপরের ঘটনা আরো করুণ। পাহাড়া (রাতে যে ওয়ার্ড পাহাড়া দেয়) আমাকে ডেকে কয়েকটা থালা-বাটি-বালতি এনে ওসব ধুয়ে দিতে বলল। খুবই অপমান বোধ করলাম তবুও কাজটা করলাম। এরপর ঝাড়– হাতে দিয়ে পুরো রুমটা পরিষ্কার কওে তিদে বলল। সেটাও করলাম। অনুরুপভাবে সাফি ভাইকেও করতে হলো।
এবার ঘুমানোর পালা। আমাদেরকে যে পদ্ধতিতে ঘুমাতে দিল তার নাম নাকি ইলিশ ফাইল সিস্টেম। ওখানে শোয়ানোর দু’টা পদ্ধতি আছে। একটা ইলিশ আরেকটা কেচি। ইলিশ হল ইলিশ মাছ যে ভাবে রাখে, মানে কাত হয়ে এক জনের সাথে এমন ভাবে শোয়া যাতে একটু ফাঁক না থাকে। আর কেচি হল বিপরীত দিক থেকে দু’জন এমন ভাবে শোবে এক জনের পা থাকবে অন্য জনের বুকের উপর।
জেল খানায় শোয়া যে কী কষ্টের তা ওখানে শুতে না হলে কেউ বুঝতে পারবে না। আমার এভাবে শুতে খুবই কষ্ট হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল এখনই বোধ হয় আমার বুকের হাড্ডি ভেঙ্গে যাবে। আমার কষ্ট দেখে পাশের জন বলল, ’আপনি এখানে শুতে পারবেন না একটা দরদাম কওে সিটে উঠে যান।’ তার কথা মত আমি উঠে তাদেও সাথে আবার দরদাম করতে গেলাম। এবার ১২ হাজাওে রফা হল। এরই ফাঁকে পাহাড়া জালাল আমাকে কিছু ফাঁক-ফোকরও শিখিয়ে দিল। যাক রাতটা আর কষ্টে কাটাতে হলো না। এরপর থেকে জামিন হওয়া আবধি আর কষ্ট পেতে হয়নি, একরকম আরামেই ছিলাম বলা যায়।
জেল হাজতে কিছু নিয়ম কানুন মেনে চলতে হতো। যেমন ফজরের আজানের আগে আগেই সবাইকে জাগিয়ে দেয়া, দৈনিক চারবার ফাইলে বসিয়ে সংখ্যা গণণা করা হতো। যারা নামাজ পড়ার তারা পড়ত অন্যরা আবারও ঘুমিয়ে পড়ত। ৬টার দিকে সকালের নাস্তা-ডাল ১টা রুটি। তবে আমরা মেটের ডিভিশনে ছিলাম বলে আমাদেও ভাত খাবারও সুযোগ ছিল। যদিও ওভাত আমাদেও খেতে ইচ্ছে করত না। এরপর বাইওে নিয়ে গিয়ে গোসল দেয়ার নিয়ম আছে। গোসলটা কী রকম একটু বলি-সবাইকে বাইওে সুইমিং পুল/পুকুর যাই বলি তার পাওে নিয়ে গিয়ে লম্বা লাইন কওে দাঁড় করাত । তারপর দু’বালতি পানি একবার লাইনের এদিক থেকে আরেক বালতি পানি অন্য দিক থেকে গরু গোসলের মত ঢেলে দিত। আবার ভিতওে বাথ রুমে করার একটা স্পেশাল সিস্টেমও আছে। যার জন্য কিছু দিতে হয়। আমাদেও কথা ছিল প্রতি সপ্তাহে এক প্যাকেট গোল্ড লিফ সিগারেট দেবার। কিন্তু আগে ভাগেই জামিন হয়ে যাওয়াতে তা আর দিতে হয়নি। গোসলে পওে শুয়ে বসে কাটিয়ে দিতাম। তারপর ১টা /২টার দিকে ভাত খেতাম। ইয়া বড় বড় সিদ্ধ চাল তার উপরএগুলো রান্না করা হতো খুব ভোওে, যার জন্য ভাত গুলো একটু প্যাচপ্যাচে হয়ে যেত। তাই অনেকটা জোড় করেই ভাতগুলো খেতে হতো। বিকেল ৪টার দিকে ১০ মিনিটের জন্য বাইওে বেরুনোর সুযোগ হতো এবং বাইরের খোঁজ খবর নেয়া যেত। সন্ধ্যায় আবার ফাইলে বসা এবং রাতে শেষ বারের মত ফাইল গণণা হত। আমার কাছে এগুলো এক ধরনের মানসিক নির্যাতন বলেই মনে হত। রাতে এশা’র নামাজের পর ঘুম।
রাত মানে বিভৎস্য দৃশ্য। ২ জনের জায়গায় ১০ জন শোয়া। আবার যাদেও টাকা বা ক্ষমতা আছে তারা মোটামুটি আরামেই ঘুমাতে পারে। রাতে অনেককে ঘুমাতে না পেওে কাঁদতে দেখতাম। হাজতী/কয়েদীদেও মধ্যে চোর-ডাকাত তো আছেই কিন্তু কিছু নিরীহ লোককেও শুধু প্রশাসনের গাফিলতি-দূর্নীতির কারণে এরকম দূর্বিসহ জীবন যাপন করতে হয়। জেল খানায় আসলে কী পরিমাণ যে মানবাধিকার লংঘিত হয় তা লিখে বা বলে প্রকাশ করা যাবে না।
বলতে গেলে সব কিছই এখানে অমানবিক। বিশেষ কওে টয়লেট এবং ঘুমানোর জায়গা। এমনও লোক আছে যারা ১০/১৫ দিন পর পর একবার টয়লেটে যায়। আমিও দু’দিন পরই টয়লেটে যাই। যেখানে আমি বাসায় থাকা অবস্থায় দিনে দু’বার যেতাম। রাতে টয়লেটে যাবার কোন উপায় থাকে না। প্রথমত পানির অভাব,বিকাল হতে হতেই পানি নেই। আর রাতে যখন ঘুমানোর সময় হয় তখন তো এই টয়লেটের উপরই কম্বল বিছিয়ে অনেককে শুতে হচ্ছে।
রবিবার বিকাল থেকে বৃহস্পতিবার সকাল পর্যন্ত ৯ নং ওয়ার্ডের মেট ডিভিশনে মোটামুটি ভালই কাটিয়েছিলাম। এই দূর্বিসহ জীবনের সাথে মোটামুটি মানিয়েও নিয়েছিলাম। জেলের ভিতর বেশীর ভাগই খারাপ প্রকৃতির লোক। কিন্তু প্রতিটা মানুষের ভিতর যে মনুষ্যত্ব থাকে তা এখানে প্রমাণ পেলাম। ছোট্ট একটা উদাহরণ দেই-ব্যাপারটা সবার অনুভূতিতে তেমন প্রভাব নাও ফেলতে পাওে, কিন্তু আমি জানি আমার জন্য তা কতটা উপকারী ছিল। মঙ্গলবার রাতে হঠাৎ কওে আমার ডায়রিয়া শুরু হয়ে গেল। এখানে টয়লেটের যে অবস্থা তাতে একবার যাওয়াই যেখানে দুঃসাধ্য সেখানে ডায়রিয়া হলে কারো মানসিক অবস্থা কী হতে পারে? মেট জাহাঙ্গীর আমার অবস্থাটা বুঝতে পারলো। সে তাড়াতাড়ি আমার জন্য ওরস্যালাইন এবং দুটো ফ্লাজিল ট্যাবলেট নিয়ে আসলো। তারপর নিজে ওরস্যালাইন বানিয়ে আমাকে খাওয়ালো। সকাল হতে না হতেই আমি সুস্থ হয়ে গেলাম।
তারপর কাউসার বলল তার মেটের কথা। সে ছিল সর্বহারা পার্টির লোক এবং বেশ কয়েকটা খুনের আসামী। সে কাউসারের সাথে খুই ভাল আচরণ করেছে এবং যেখানে টাকার জন্য সবাই পাগলামী করে সেখানে সে চলে আসার সময় কাউসারকে ১০০ টাকা দিল হাত খরচের জন্য।
এমনি করেই থানা এবং জেল মিলিয়ে ৭ রাত কাটিয়ে বাসায় ফিরলাম। প্রথমে আপার ওখানে উঠলাম। গায়ে যে শার্টটা ছিল ওটা খুব ময়লা হয়ে গিয়েছিল। দুলাভাইয়ের কাছ থেকে একটা গেঞ্জি পড়ে বাসায় রওয়ানা দিলাম।
প্রায় ৯ বছর আগের ঘটনা। পুরোনো কাগজ পত্র ঘেটে এই লেখাটা পেলাম। ঐ সময়ের অনুভূতি এতে প্রকাশ পেয়েছে। ভাবলাম এখানে জমা রাখি আর বন্ধুদের সাথেও শেয়ার করি।
৯ বছর পর (২৪ অক্টোবর ২০০২) সেদিনের সেই একই বিষয়(তেল-গাস-বন্দর) নিয়ে আজও রোড মার্চ কর্মসূচী পালিত হচ্ছে। বার বার সেদিনের কথা গুলি খুব বেশি মনে পড়ছে। আমরা কি কোনও দিন দেশপ্রেমিক হবো না? শুধু নিজের পকেট ভরার চিন্তায় থাকবো?
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে মে, ২০১৬ বিকাল ৪:১৪

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




