somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

কথাচ্ছলে মহাভারত - ৪৫

০৩ রা জুন, ২০১৩ দুপুর ২:২০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
মৃগরূপী ঋষিকুমারের প্রতি পান্ডুর শরাঘাত ও শতশৃঙ্গ পর্ব্বতে স্থিতি :


পান্ডু

পান্ডু বনে দুই ভার্যা ও কিছু অনুচর নিয়ে বাস করছিলেন।
রাজা মৃগ অন্বেষণে পাহাড়, পর্বত, মহাবনে ঘোরেন। তার আগমনবার্তা শুনে সিংহ, বাঘ, হাতি, গন্ডার, ভল্লুক, শূকর-সকল প্রাণী বনান্তরে চলে যায়। এ সময় একদিন পান্ডু দেখলেন অনেক হরিণীর দলের মাঝে একটি হরিণ অবস্থান করছে।


প্রকৃতপক্ষে কিন্দম নামে এক ঋষিকুমার মৃগের রূপ ধরে মৃগীর সাথে শৃঙ্গার করছিলেন। এদিকে পান্ডু মৃগ দেখে শর নিক্ষেপ করলেন। তীক্ষ্ণ শর ঋষিকে ভেদ করল, তিনি মাটিতে পরে ছট্‌ফট্‌ করতে লাগলেন।


মৃগরূপী ঋষিকুমারের প্রতি পান্ডুর শরাঘাত
পান্ডুর উদ্দ্যেশ্যে তিনি চিৎকার করে বললেন – ধার্মিক হয়ে রাজা তুমি একি ভুল করলে! পরম শত্রুকেও কেউ হিংসা করে রমণের সময় হত্যা করে না।
পান্ডু বলেন- মৃগ হত্যা ধর্মে আছে, এটি ক্ষত্রিয়ের আচার।
ঋষিকুমার বলেন – মৃগবধ ধর্মে আছে, কিন্তু রমণের সময় বিরোধ করা মহাপাপ কর্ম। কুরুবংশে জন্মে, রতিরসে জ্ঞাত হয়েও রাজা পাপাচার করলেন। তার পাপে সংসার পাপে মজবে।

ঋষি তখন নিজ পরিচয় দিলেন। ঋষিকুমার তিনি, তপের কারণে সকল ত্যাগ করে বনে বাস করেন। মৃগ রূপ ধরে তিনি যখন স্ত্রী-রমণ করছেন সে সময় রাজা তাকে হত্যা করলেন। যেহেতু ব্রাহ্মণ বলে রাজা তাকে চিনতে পারেন নি, তাই ব্রাহ্মণ হত্যার পাপ তার লাগবে না, মৃগ হত্যার দায়ও তার নেই, কিন্তু মৈথুন সময় জীব হত্যার পাপ তার লাগল।

তাই ঋষি শাপ দিলেন- তিনি যেমন অশুচি দেহে যমালয় যাচ্ছেন, তেমনি রাজাও মৈথুন-সময় মৃত্যুবরণ করবেন, স্বর্গে যাওয়ার শক্তি তারও থাকবে না। তার বাক্য মিথ্যা হওয়ার নয়- এত বাক্য বলতে বলতে ঋষিকুমার প্রাণ ত্যাগ করলেন।

পান্ডু বিষণ্ণ বদনে শোকে আকুল হলেন। মৃত ঋষিকে প্রদক্ষিণ করলেন এবং ভার্যাদের নিয়ে বন্ধুশোকের মত বিলাপ করলেন।


রাজা নিজের নিন্দা শুরু করলেন। কেন তিনি এত বড় কুলে জন্মালেন, তার পাপে কুল পাপে নিমজ্জিত হল। তার মনে পরল তার পিতাও অনাচার করেছিলেন, কামে মত্ত থাকায় অল্পকালে তার মৃত্যু হয়। তার সন্তান বলে তিনিও দুষ্ট, দুরাচার। ধর্ম ভোলার সাজা হল-মৃগরূপী ঋষি হত্যার পাপে মগ্ন হলেন। তিনি প্রতিজ্ঞা করলেন সংসার-বিষয় ত্যাগ করে তপস্যায় নিজেকে মগ্ন রাখবেন।

আরো জানালেন তিনি একা পৃথিবী ভ্রমণ করবেন এবং সকল ইন্দ্রিয়কে নিয়ন্ত্রণে রাখবেন। কুন্তী ও মাদ্রীকে হস্তিনানগরে ফিরে যেতে বললেন। সেখানে ভীষ্ম জ্যৈষ্ঠতাত, (কোশল রাজকন্যা)কৈশল্যা জননী অম্বালিকা, সত্যবতী আই, অন্ধ নৃপমনি ধৃতরাষ্ট্র, বিদুর প্রমূখ সুহৃদরা আছেন।

কিন্তু কুন্তী ও মাদ্রী হস্তিনানগরে ফিরতে রাজি হলেন না। তারা কাঁদতে কাঁদতে করুন বচনে অসম্মতি জানালেন এবং সকল স্বর্ণালঙ্কার ত্যাগ করে পতিকেই অনুসরণ করবেন জানালেন। তারাও প্রতিজ্ঞা করলেন ফলাহার গ্রহণ করবেন, পতির পথানুসারে তপস্যা করবেন এবং ইন্দ্রিয়কে দমন করবেন-ধর্মেও আছে সন্ন্যাসীরা পত্নীদের সঙ্গে বাস করতে পারেন। পান্ডু যদি তাদের ত্যাগ করেন তবে তারা এক্ষুনি রাজার সামনে আগুনে ঝাঁপ দিয়ে প্রাণ ত্যাগ করবেন। তাদের ব্যাকুল চিত্তের এই আবেদন শুনে রাজা চিন্তিত হলেন, জানালেন অরণ্যে অশেষ ক্লেশ পেতে হবে, গাছের বাকল বসন হবে, সব আভরণ ত্যাগ করে শিরে জটা ধারণ করতে হবে। লোভ, মোহ, কাম, ক্রোধ, অহঙ্কার ত্যাগ করতে হবে।

রাজার আজ্ঞা শুনে দুই রাণী সকল নির্দেশ সঙ্গে সঙ্গে পালন করলেন। দেখে পান্ডুর হৃদয় ব্যাকুল হল। তিনি নিজেও সব কিছু ত্যাগ করে দান করে দিলেন। অনুচরেদের হস্তিনানগরে ফিরে যেতে বললেন এবং এখানকার সকল ঘটনা গুরুজনদের জানিয়ে মায়েদের ক্রন্দন প্রবোধতে নির্দেশ দিলেন। অনুচরেরা হাহাকার করতে করতে নগরে ফিরল। শোকে সমগ্র নগর স্তব্ধ হল। ধৃতরাষ্ট্র ভাতৃ-দুঃখে ভূমিতে লুটিয়ে পরলেন।

পান্ডু প্রথমে চৈত্ররথ নামে এক বনে উপস্থিত হন, কিন্তু সেখানে গন্ধর্ব ও অপ্সরারা বিহার করছিলেন। তাই তারা বহু নদ, নদী, দেশ পার হয়ে যান নৈমিষ কাননে। হিমালয় আরোহণ করে তারা তিনজন শ্রী গন্ধমাদন পৌঁছলেন। সেখানে ইন্দ্রদ্যুম্ন সরোবরে পূণ্যস্নান করে শতশৃঙ্গ পর্বতে আরোহণ করলেন। এখানে অনেক ঋষি-তপস্বীরা অবস্থান করতেন, পান্ডু এস্থান দর্শন করে সন্তুষ্ট হলেন এবং সেখানে তপস্যা শুরু করলেন। তিনজন সেখানে ঘোর তপস্যা করলেন। ফলমূল আহার করতেন, ধিরে ধিরে তিনজন অস্থিচর্মসার হলেন। ঋষিরা দেখে অবাক হলেন। তাদের তপ সিদ্ধ হল। সেখান থেকে তারা ঋষিদের প্রণাম করে অতি উচ্চ পর্বতে আরোহণ শুরু করলেন স্বর্গের উদ্দেশ্যে। স্বর্গ-যাত্রাপথে তারা দেবতাদের স্থান দর্শন করলেন। নানা রত্নের বিচিত্র যান দেখলেন। গঙ্গার মাঝে প্রবল তরঙ্গের মধ্যে দেবকন্যাদের ক্রীড়ারঙ্গ করতে দেখলেন। এভাবে নানা অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে যখন তারা যাত্রা করছেন তখন কিছু ঋষি তাদের ডাকলেন এবং তারা কারা, কেন, কোথায় যাচ্ছেন প্রশ্ন করলেন।



পান্ডু তখন নিজ পরিচয় জানালেন। ঋষিরা জানালেন সংসারে মানুষ চার ঋণ নিয়ে অবস্থান করে। সেই চার ঋণ মুক্ত না হলে স্বর্গে যেতে পারে না। যজ্ঞ করলে দেবঋণ মুক্ত হবে, ব্রতাচারে মুনিদের তুষবে। পিতৃঋণ মুক্ত হবে পিতৃপিন্ড দিয়ে। মনুষ্য-ঋণ মুক্ত হবে অতিথি সেবা করে।

পান্ডু বলেন তিনি তিনস্থানে ঋণমুক্ত, কিন্তু নিজ কুকর্মের জন্য পিতৃ-ঋণ মুক্ত হতে পারলেন না। তাই এ শরীর তিনি ত্যাগ করবেন।

ঋষিরা বলেন -রাজা পন্ডিত সুজন, ধার্মিক ও সর্বশাস্ত্রে বিচক্ষণ, বুদ্ধিমান। পুত্রহীন মানুষ কখনও স্বর্গে স্থান পান না। দ্বারপালরা দ্বাররক্ষা করছেন, পুত্রহীন জনকে তারা প্রবেশের অনুমতি দেবেন না। সুতরাং রাজা বৃথাই সেখানে যাচ্ছেন।
ঋষিবাক্য রাজা অবধান করুন। মর্তে জন্মালে মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী। মহাপূণ্যের ফলে মানুষ পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করে। সেই মানব পৃথিবীতে বহুদান করে, বহু জপ–তপ করে সংসারে অবস্থান করে। তবু সন্তানহীন হলে কেউ স্বর্গে যেতে পারে না-বেদের বিচারে এই নীতি শাস্ত্রে আছে। স্বর্গে যত দেবসিদ্ধ ঋষি আছেন সকলে মর্তে সন্তান জন্মগ্রহণের পরই স্বর্গবাসী হয়েছেন।

এত শুনে চিন্তিত পান্ডু তাদের পরামর্শ চাইলেন। ঋষিরা রাজাকে সে স্থানে অবস্থান করতে বললেন এবং আরো জানালেন তারা দিব্যচক্ষে দেখতে পাচ্ছেন দেবতার বরে পান্ডুর মহা বীর্য্যবন্ত পুত্র হবে।



ঋষির আজ্ঞায় পান্ডু শতশৃঙ্গ পর্বতে সস্ত্রীক বসবাস করলেন। .....................................
উৎসর্গ: সকল ব্লগার বন্ধুকে
......................................
আগের পর্ব:

কথাচ্ছলে মহাভারত - ৪৪
Click This Link

সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা জুন, ২০১৩ দুপুর ২:২৩
৬টি মন্তব্য ৫টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

বাংলাদেশের লোকসংস্কৃতিঃ ব্যাঙের বিয়েতে নামবে বৃষ্টি ...

লিখেছেন অপু তানভীর, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:০০



অনেক দিন আগে একটা গল্প পড়েছিলাম। গল্পটা ছিল অনেক এই রকম যে চারিদিকে প্রচন্ড গরম। বৃষ্টির নাম নিশানা নেই। ফসলের মাঠ পানি নেই খাল বিল শুকিয়ে যাচ্ছে। এমন... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাংলাদেশি ভাবনা ও একটা সত্য ঘটনা

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১০:১৭


আমার জীবনের একাংশ জুড়ে আছে; আমি চলচ্চিত্রাভিনেতা। বাংলাদেশেই প্রায় ৩০০-র মত ছবিতে অভিনয় করেছি। আমি খুব বেছে বেছে ভাল গল্পের ভাল ছবিতে কাজ করার চেষ্টা করতাম। বাংলাদেশের প্রায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাকি চাহিয়া লজ্জা দিবেন না ********************

লিখেছেন মোহাম্মদ সাজ্জাদ হোসেন, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১০:৩৫

যখন প্রথম পড়তে শিখেছি তখন যেখানেই কোন লেখা পেতাম পড়ার চেষ্টা করতাম। সেই সময় দোকানে কোন কিছু কিনতে গেলে সেই দোকানের লেখাগুলো মনোযোগ দিয়ে পড়তাম। সচরাচর দোকানে যে তিনটি বাক্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

=এই গরমে সবুজে রাখুন চোখ=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:২১

০১।



চোখ তোমার জ্বলে যায় রোদের আগুনে?
তুমি চোখ রাখো সবুজে এবেলা
আমায় নিয়ে ঘুরে আসো সবুজ অরণ্যে, সবুজ মাঠে;
না বলো না আজ, ফিরিয়ো না মুখ উল্টো।
====================================
এই গরমে একটু সবুজ ছবি দেয়ার চেষ্টা... ...বাকিটুকু পড়ুন

কুড়ি শব্দের গল্প

লিখেছেন করুণাধারা, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:১৭



জলে ভাসা পদ্ম আমি
কোরা বাংলায় ঘোষণা দিলাম, "বিদায় সামু" !
কিন্তু সামু সিগারেটের নেশার মতো, ছাড়া যায় না! আমি কি সত্যি যাবো? নো... নেভার!

সানমুন
চিলেকোঠার জানালায় পূর্ণিমার চাঁদ। ঘুমন্ত... ...বাকিটুকু পড়ুন

×