somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

কথাচ্ছলে মহাভারত - ৫৩

০১ লা এপ্রিল, ২০১৪ সকাল ১১:৩১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
কৃপাচার্য্যের জন্ম-বিবরণঃ



পরীক্ষিত পুত্র জন্মেজয় মুনির কাছে সবিস্তারে সকল ঘটনা শুনতে চাইলেন। মুনি বৈশম্পায়ন বলেন পান্ডব চরিত্র শ্রবণে জগত পবিত্র হয়। তাই তিনি তাদের সকল ঘটনা ধিরে ধিরে বর্ণনা করবেন।

কিছুকাল পর গঙ্গাপুত্র ভীষ্ম পৌত্রদের অস্ত্রশিক্ষা দানের জন্য সর্বশাস্ত্র বিশারদ কৃপাচার্য নিযুক্ত হলেন। শরদ্বান ঋষির পুত্র কৃপাচার্য হস্তিনানগরেই বাস করতেন। তিনি পঞ্চোত্তরশত ভাইকে ধনুর্বেদ শিক্ষা দিতে লাগলেন।

জন্মেজয় বলেন ব্রাহ্মণের পুত্র ক্ষত্রিয়ের ধর্ম নিলেন কোন কারণে।

মুনি বলেন- গৌতম ঋষির পুত্র শরদ্বান। শরসহ জন্মেছিলেন বলে তার এই নাম। এই শরদ্বান দ্বিজ কর্ম ত্যাগ করে ধনুর্বেদে রত হন। বেদশাস্ত্র না পড়ে ধনুর্বেদে মন দিলেন। তপোবনের মধ্যে অনুক্ষণ তপস্যা করলেন। তাঁর তপস্যার শক্তি দেখে শতক্রুর অর্থাৎ ইন্দ্র শঙ্কিত হলেন। মুনির তপস্যা ভঙ্গ করার জন্য একটি উপায় খুঁজে পেলেন। দেবকন্যা জানপদীকে মুনির কাছে পাঠালেন। কন্যাকে দেখে শরদ্বান হত ধৈর্য্য হলেন। ধনুঃশর হাত থেকে পরে গেল এবং বীর্য্যও স্খলিত হল। মুনি সচেতন হলেন। সে বন ত্যাগ করে অন্য বনে গেলেন।

ঋষির বীর্য্য মাটিতে পড়ে দুই খন্ড হয়ে গেল। তপস্বী ঋষির বীর্য্য কখনও নষ্ট হয় না। ধিরে ধিরে এক গুটি কন্যা হল, অপরটি পুত্র।

সে সময় রাজা শান্তনু সে বনে মৃগয়া করতে গেছিলেন। অনুচরেরা অনাথ দুটি শিশু দেখে রাজাকে জানালেন। তাদের কথা শুনে রাজা চমৎকৃত হলেন। শিশু দুটি রোদন করছিল। তাদের পাশে তীর ধনুক এবং কৃষ্ণচর্ম দেখে রাজা অনুমান করলেন শিশু দুটি কোন ঋষির। রাজা তাদের নিজের সাথে এনে পালন করতে লাগলেন।

অনেকদিন পর শরদ্বান মুনি সে বনে এসে সব জানলেন। রাজার কাছে এসে তাকে এই ধার্মিক কর্মের জন্য আশির্বাদ জানালেন।

কৃপা করে রাজা তার পুত্র ও কন্যাকে রেখেছেন। তাই তাদের নাম রাখলেন কৃপ ও কৃপী।

শরদ্বান মুনি কৃপকে নানা অস্ত্রবিদ্যা শেখালেন যত্ন করে। পরে দ্রোণাচার্যের কাছে শিক্ষার জন্য পাঠালেন। দ্রোণাচার্য তাকে সর্বশাস্ত্র শিক্ষা দেন। ধনুর্বেদে কৃপ অপ্রতিদন্দী হয়ে ওঠে। অল্পকালে সবাই তাকে আচার্য বলে ডাকতে থাকে। কুরুবংশ, যদুবংশ, অন্ধক, বৃষ্ণিবংশ এবং আর যত রাজা দেশে দেশে আছেন সকলে কৃপাচার্যের কাছে ধনুর্বেদ শিক্ষার জন্য আসতেন। এভাবে কৃপগুরুর নাম ভুবনে ছড়িয়ে পড়ল।

পরে ভীষ্ম মহাবীর যখন পৌত্রদের শিক্ষাদানের কথা চিন্তা করলেন তখন দ্রোণের কাছে সমর্পণ করলেন। দ্রোণাচার্য সর্বশাস্ত্রে তাদের জ্ঞানদান করলেন।
...........................

দ্রোণাচার্যের উৎপত্তিঃ



রাজা জন্মেজয় দ্রোণাচার্য সম্পর্কেও সম্পূর্ণরূপে জানতে চাইলেন। তার উৎপত্তি কি ভাবে হল। কি ভাবেইবা তিনি কুরুদেশে গুরু হলেন।

মুনি বলেন, ভরদ্বাজ নামে এক মহামুনি ছিলেন। তিনি একদিন গঙ্গাস্নানে গেলেন। সে সময় অন্তরীক্ষে ঘৃতাচী অপ্সরা যাচ্ছিলেন। অপ্সরা পরমা সুন্দরী, বরণ তার অপূর্ব সুন্দর। হঠাৎ সে সময় দক্ষিণ পবন বইল এবং অপ্সরার বসন উড়ল। মুনি তার অঙ্গ দর্শন করলেন। দেখে তার মনে উদ্বেগ জন্মাল। পঞ্চশরের আঘাত শরের আঘাতের চেয়েও বেশি। কেউ নেই যে কামিনীর মোহে না পরে। মুনির রেত স্খলিত হলে, মুনি চিন্তিত হলেন। সামনে দ্রোণী অর্থাৎ ছোট্ট ডিঙ্গা বা কলসী দেখে তাতে রেত রাখলেন। দ্রোনীর মধ্যে দ্রুত এক পুত্রের জন্ম হল। পুত্র দেখে ভরদ্বাজ মুনি আনন্দিত হলেন। পুত্রকে নিয়ে আপন গৃহে গেলেন।

দ্রোণীতে জন্ম বলে পুত্রের নাম রাখলেন – দ্রোণাচার্য বা দ্রোণী। বেদবিদ্যা ও সর্বশাস্ত্রে তাকে শিক্ষা দিলেন।

পৃষত নামে পাঞ্চালের এক রাজা ছিলেন। তার পুত্র দ্রুপদ। দ্রুপদ ভরদ্বাজ মুনির আশ্রমে যেতেন। তিনি দ্রোণের সমবয়সীও ছিলেন। তারা একসথে থাকতেন, খেলতেন। একসাথে খাওয়া, বসা, শোওয়া- দেখে মনে হত তারা অভিন্ন আত্মা। এক মুহুর্তেও তারা পরস্পরকে ছেড়ে থাকতে পারবেন না। কিছুকাল পর পৃষত রাজা মারা গেলে দ্রুপদকে রাজা হয়ে পাঞ্চালে ফিরতে হল।

এদিকে ভরদ্বাজ মুনিও স্বর্গে গেলেন। তপস্যা করতে দ্রোণ তপোবনে চলে গেলেন। কিছুকাল পর পিতার ইচ্ছানুসারে দ্রোণ কৃপাচার্যের ভগিনী কৃপীকে বিবাহ করেন। পরমা সুন্দরী, ব্রতে অনুব্রতা, যজ্ঞ-হোম-তপে নিষ্ঠাবতী সতী পতিব্রতা কৃপী। তাদের এক পুত্রের জন্ম হয়। জন্মমাত্র পুত্র অশ্বের গর্জন করে উঠল। সে সময় আকাশবাণী হল জন্মমাত্র পুত্র অশ্বধ্বনি করায় এর নাম হবে অশ্বত্থামা। পুত্র দীর্ঘজীবী ও সর্বগুণে পূর্ণ হবে। পুত্রের মুখ দর্শন করে দ্রোণ আনন্দিত হলেন। নানা বিদ্যা তাকে দান করতে লাগলেন।

কিছুকাল পর দ্রোণ একদিন শুনলেন অস্ত্রজ্ঞগণের শ্রেষ্ঠ ভৃগু নন্দন পরশুরাম সকলকে দান করছেন। তিনি ব্রাহ্মণদের নানা ধন-রত্ন দান করছেন শুনে দ্রোণও তার কাছে যাবেন স্থির করলেন।


পরশুরাম

মহেন্দ্র পর্বতের মাঝে পরশুরামের আলয়, দ্রোণ সেখানে উপস্থিত হলেন।

দ্রোণকে দেখে ভৃগুর নন্দন জিজ্ঞেস করলেন তিনি কোথা থেকে কি প্রয়োজনে এসেছেন।

দ্রোণ বলেন তিনি ভরদ্বাজমুনির পুত্র। লোক মুখে শুনেছেন পরশুরাম দান করছেন, তাই তিনি এসেছেন তার সকল মনস্কামনা পূর্ণ করতে।

পরশুরাম বলেন - আমার কাছে সুবর্ণাদি যা ছিল সবই ব্রাহ্মণদের দিয়েছি, সমগ্র পৃথিবী কশ্যপকে দিয়েছি, এখন কেবল আমার প্রাণ আর অস্ত্রশস্ত্র অবশিষ্ট আছে।
সবকিছু দান করে তিনি এখনই বনে যাবেন স্থির করেছেন, ঠিক সময়েই দ্রোণ এসেছেন। এর মধ্যে কোনটি পেলে দ্রোণ খুশি হবেন তিনি জানতে চাইলেন।

দ্রোণ বলেন – আপনি সমস্ত অস্ত্রশস্ত্র আমাকে দিন এবং তাদের প্রয়োগ ও প্রত্যাহরণের বিধি আমাকে শেখান।

মন্ত্রসহ অস্ত্রশিক্ষা দিয়ে পরশুরাম দ্রোণের প্রার্থনা পূর্ণ করলেন। ধনুর্বেদে নিপুন হলেন দ্রোণাচার্য।

এরপর তিনি দ্রুপদের রাজ্যের উদ্দেশ্যে রওনা হলেন। অত্যন্ত দরিদ্র দ্রোণ কখনও কারো কাছে কিছু সাহায্য চান না। কিন্তু পুত্রের কষ্ট দেখে তার অন্তর কাঁদে। তিনি ভাবলেন বাল্যসখা দ্রুপদ রাজের কাছে গেলেই তার দুঃখ দুর হবে। এই ভেবে দ্রোণ পাঞ্চাল নগরে গেলেন। রাজার সম্মুখেও উপস্থিত হলেন।

মলিন জীর্ণ ধুতি, শীর্ণ কৃষ্ণবর্ণের শরীর- দারিদ্রের প্রতি মূর্তি দ্রোণ।
রাজা দ্রুপদকে বলেন দ্রোণ, তিনি তার বাল্যসখা, তার কাছে সাহায্যের কারণে উপস্থিত হয়েছেন।

সকল বাক্য শুনে দ্রুপদ চোখ রাঙ্গিয়ে তাকে দরিদ্র ভিক্ষুক, অজ্ঞান বাতুল, দুর্মুখ বলে অপমান করলেন সভার মাঝে।
ধনী এবং দরিদ্রের কখনও সখ্যতা হতে পারে না। যেমন দেবতা ও অসুরে সখ্যতা অসম্ভব। তেমনি রাজা এবং ভিক্ষুকেরও সখ্যতা সম্ভব নয়। সমানে সমানেই কেবল সখ্যতা হতে পারে। উত্তম ও অধমের সখ্যতা সুখের নয়।
এসকল নিষ্ঠুর বাক্য বলে দ্রোণকে তিরস্কার করতে থাকেন।
তার বাল্যকালে কোন সখা ছিল বলে তিনি মনে করতে পারলেন না।

এত নিষ্ঠুর বাক্য শুনে অভিমানে দ্রোণ কাঁপতে থাকেন। দু’চোখ থেকে যেন রক্ত বহে, শ্বাসে তার সর্পের গর্জন।
মুহূর্তকাল স্তব্ধ থেকে দ্রোণ আর রাজাকে দর্শণ না করে, কিছু না বলে সে স্থান ত্যাগ করেন।

ক্রোধে অভিভূত দ্রোণ হস্তিনানগরে শ্যালক কৃপাচার্যের কাছে আশ্রয় নেন। দ্রোণকে দেখে কৃপাচার্য আনন্দিত হলেন। স্ত্রী-পুত্র নিয়ে দ্রোণ সেখানেই থেকে যান। এভাবে গোপনে দ্রোণ বেশ কিছুকাল কাটান।
....................................
উৎসর্গ: সকল ব্লগার বন্ধুকে
......................................
আগের পর্ব:

কথাচ্ছলে মহাভারত - ৫২
Click This Link
১২টি মন্তব্য ১১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

অপরূপের সাথে হলো দেখা

লিখেছেন রোকসানা লেইস, ১৪ ই মে, ২০২৪ রাত ১:৩৫



আট এপ্রিলের পর দশ মে আরো একটা প্রাকৃতিক আইকন বিষয় ঘটে গেলো আমার জীবনে এবছর। এমন দারুণ একটা বিষয়ের সাক্ষী হয়ে যাবো ঘরে বসে থেকে ভেবেছি অনেকবার। কিন্তু স্বপ্ন... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমরা কেন এমন হলাম না!

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৪ ই মে, ২০২৪ সকাল ৯:৪১


জাপানের আইচি প্রদেশের নাগোইয়া শহর থেকে ফিরছি৷ গন্তব্য হোক্কাইদো প্রদেশের সাপ্পোরো৷ সাপ্পোরো থেকেই নাগোইয়া এসেছিলাম৷ দুইটা কারণে নাগোইয়া ভালো লেগেছিল৷ সাপ্পোরোতে তখন বিশ ফুটের বেশি পুরু বরফের ম্তুপ৷ পৃথিবীর... ...বাকিটুকু পড়ুন

অভিমানের দেয়াল

লিখেছেন মোঃ মাইদুল সরকার, ১৪ ই মে, ২০২৪ সকাল ১১:২৪




অভিমানের পাহাড় জমেছে তোমার বুকে, বলোনিতো আগে
হাসিমুখ দিয়ে যতনে লুকিয়ে রেখেছো সব বিষাদ, বুঝিনি তা
একবার যদি জানতাম তোমার অন্তরটাকে ভুল দূর হতো চোখের পলকে
দিলেনা সুযোগ, জ্বলে পুড়ে বুক, জড়িয়ে ধরেছে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমাদের গ্রামে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি

লিখেছেন প্রামানিক, ১৪ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:৩১



২৬শে মার্চের পরে গাইবান্ধা কলেজ মাঠে মুক্তিযুদ্ধের উপর ট্রেনিং শুরু হয়। আমার বড় ভাই তখন ওই কলেজের বিএসসি সেকেন্ড ইয়ারের ছাত্র ছিলেন। কলেজে থাকা অবস্থায় তিনি রোভার স্কাউটে নাম... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিকেল বেলা লাস ভেগাস – ছবি ব্লগ ১

লিখেছেন শোভন শামস, ১৪ ই মে, ২০২৪ দুপুর ২:৪৫


তিনটার সময় হোটেল সার্কাস সার্কাসের রিসিপশনে আসলাম, ১৬ তালায় আমাদের হোটেল রুম। বিকেলে গাড়িতে করে শহর দেখতে রওয়ানা হলাম, এম জি এম হোটেলের পার্কিং এ গাড়ি রেখে হেঁটে শহরটা ঘুরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×