যুধিষ্ঠিরের যৌবরাজ্যে অভিষেকঃ
মুনি বলেন, রাজা অবধান কর, তোমার পিতামহের উপাখ্যান।
রাজা ধৃতরাষ্ট্র বিধান বুঝে যুবরাজ ঘোষণায় অনুমতি দিলেন। কুরুকুলের জৈষ্ঠ হলেন কুন্তীপুত্র যুধিষ্ঠির। ধর্মশীল ধীর এই রাজকুমারকে সকলে ভালবাসতেন। যুধিষ্ঠিরকে যুবরাজরূপে অভিষেক করা হলে সমাজে সকলে প্রীত হলেন। যুধিষ্ঠিরের সৌজন্যে সকলে বশেও থাকল। পৃথিবীর চারদিকে ধর্মপুত্রের যশ ছরিয়ে পড়ল। বৃকোদর(যার উদরে বৃক বা জঠরাগ্নি আছে, বহুভোজী) ভীম বলরামের কাছে অসিযুদ্ধ গদাযুদ্ধ ও রথযুদ্ধ শিখলেন। অর্জুন নানাবিধ অস্ত্রের প্রয়োগে পটুতা লাভ করলেন। সহদেব সর্ব প্রকার নীতিশাস্ত্রে অভিজ্ঞ হলেন। দ্রোণের শিক্ষার ফলে নকুলও অতিরথ(যিনি অসংখ্য শত্রুর সঙ্গে যুদ্ধ করতে পারেন) এবং চিত্রযোধী(বিচিত্র যুদ্ধকারী) নামে খ্যাত হলেন।
ভীম ও অর্জুন দুই ভাই রাজার আজ্ঞায় চারদিকের রাজাদের শাসন করে বেড়ান। বহু রাজাদের সাথে তাদের যুদ্ধ হল এবং এত রাজ্য জয় করলেন যে তাদের নাম বলে শেষ করা যাবে না। উত্তর পশ্চিম পূর্ব জম্মুদ্বীপ প্রভৃতি থেকে দু’জনে বহু রত্ন জিতে আনলেন। পূর্বে কুরুকুলের পক্ষে যা যা অসাধ্য ছিল ভীমার্জুন দুইভাই তাই আয়ত্ত করলেন। নানা রত্নে হস্তিনানগর পূর্ণ হল, পৃথিবীতে দুই সহোদর ভাইদের যশ ছরিয়ে পড়ল। সহদেবও মন্ত্রী হয়ে ভুবনে নাম করলেন। তিনি দেবগুরুর আরাধনা করে সর্বজ্ঞ হলেন। নকুলও দুর্জয় যোদ্ধা, সর্বগুণ সম্পন্ন এবং ধীর। কৌরবকুমারদের মধ্যে সবচেয়ে সুন্দর শরীরের অধিকারী। পান্ডবদের প্রশংসায় পৃথিবীর সকলে মুখরিত হল। কুরুকুলের অন্য রাজপুরুষরা পান্ডবদের কাছে ম্লান হয়ে গেল। দিনে দিনে পান্ডবদে গৌরব শুক্লপক্ষের শশীর মত বাড়তেই থাকল। পান্ডবদের বীরগাঁথা মানুষ দিনরাত গাইতে লাগলো।
এতসব শুনে ধৃতরাষ্ট্র বিষণ্ণ হলেন। পান্ডবদের যশ দিন দিন বাড়তেই থাকল। বিধির লিখন কেউই খন্ডন করত পারে না। তবু অন্ধ রাজা মনে মনে ভয় পেলেন। কারণ তার পুত্রদের কথা কেউ বলেই না। পান্ডবরাই যেন পৃথিবীর মন জয় করেছে। এসব ভেবে ভেবে তার নিদ্রা গেল, আহারের রুচি নেই। তখন তিনি কুরুবংশের অতি বৃদ্ধ এক মন্ত্রী নাম কণিক-যিনি জাতে ব্রাহ্মণ, তাকে ডেকে পাঠালেন।
একান্তে কণিককে ডেকে তিনি বললেন -পরম বিশ্বাস করি বলেই তোমায় ডেকে পাঠালাম। দিনরাত আমার অন্তরে একটু সুখ নেই, তোমার মন্ত্রণা বলেই আমি এই দুঃখ খন্ডন করতে চাই। পান্ডবদের যশের কীর্তি দিনে দিনে যত বাড়ছে আমার চিত্তও ততই আশঙ্কায় অস্থির হয়ে উঠছে। এর কি উপায় আছে তুমি বলো।
কণিক বলে -যদি আমার কথা শুন তা হলে এই দুশ্চিন্তা খন্ডাবে।
ধৃতরাষ্ট্র বলেন তিনি অবশ্যই কণিকের পরামর্শ শুনবেন।
তখন কণিক রাজাকে প্রকৃত রাজনীতি কি তা বোঝাল। শাস্ত্রে এমন বিহিত আছে- কাজ না থাকলেও দন্ড দেবে। সকলকে নিজের বশে রাখবে। নিজের ভুল সব সময় পরম যত্নে লুকাবে। পরের ভুল অবশ্যই সঙ্গে সঙ্গে ধরবে।
রাজা বুঝে শুনে কাজ করবেন-কখনও গোপন করবেন, কখনও সব ব্যক্ত করবেন- যখন যেমন দরকার। শত্রুকে দুর্বল দেখেও দয়া করবেন না। শত্রু শরণ নিলেও রক্ষা করবেন না। শত্রুকে বালক দেখেও সাহায্য করবেন না। ব্যাধি, আগুন, রিপু, জল সবই এক ও সমান। তবে শত্রুকে যখন শক্তিশালী দেখবে তখন তার প্রতি বিনয় দেখাবে। বহু ক্লেশ হলেও অপমান সহ্য করে নেবে। সব সময় তাকে কাঁধে চড়িয়ে রাখবে অর্থাৎ যত্নবান হবে। তবে সময় পেলেই তাকে সেখান থেকে টেনে আছড়ে মাটিতে ফেলবে।
এ প্রসঙ্গে একটি পূর্বের কাহিনী বলি রাজা ভাল করে শুনুন।–
বনেতে সবচেয়ে বিজ্ঞ হল শেয়াল। বনে সিংহ, বাঘ, বেজি, ইদুঁর ও শেয়াল- পাঁচজনে বহুদিন বন্ধু হয়ে বাস করে। একদিন বনে একটি হরিণী চরছিল। সে গর্ভবতী হওয়ায় তার শরীরে অনেক মাংস। শেয়াল দেখে হরিণীর ঈশ্বর তাকে সাহায্য করলেন ফলে সিংহও বহু চেষ্টা করে তাকে ধরতে পারল না। শেয়াল তখন বন্ধুদের ডেকে বলল, আমার কথা মন দিয়ে শোন তা হলেই আমরা হরিণ ধরতে পারব। শক্তিতে যখন একে ধরতে পারছি না তখন ইদুঁরের মাধ্যমেই এর প্রাণ নেব। শ্রান্ত হয়ে হরিণী অবশ্যই কোথাও শোবে। তখন ইদুঁর সেখানে লুকিয়ে ধিরে ধিরে যাবে। দুর থেকে সুরঙ্গ করে সে হরিণের কাছে যাবে। খুব নিঃশব্দে যেতে হবে যাতে হরিণী না যানতে পারে। সুরঙ্গ শেষ হবে হরিণের পায়ের কাছে। ইদুঁর সুরঙ্গ থেকে বেরিয়েই হরিণের পায়ের শির কেটে দেবে। পায়ের শির কাটা গেলে হরিণ অশক্ত হবে। তখন সহজেই সিংহ তাকে বধ করবে। এত শুনে সবাই রাজি হল। শেয়াল যা নির্দেশ দিল সকলেই তা পালন করল। ইদুঁরের দংশনে হরিণের পায়ের শির কাটা গেল। হীনশক্তি দেখে সিংহ তাকে ধরে ফেলল। হরিণ মারা পরতে সকলে আনন্দিত হল। কিন্তু শেয়াল মনে মনে অন্য চিন্তা শুরু করল। মনে মনে সে ভাবল আমার বুদ্ধিতেই হরিণ মরল, কিন্তু সিংহ আর বাঘ মাংস খাবার পর আমি আর কতটুকু পাব। খেতে হলে আমি পুর মাংসই খাব এবং তার জন্য যা করতে হয় তাই করব। এই ভেবে শেয়াল যোড়হাত করে সবার কাছে গিয়ে বলল দেখ দৈবযোগে আজ হরিণ মরল তাই প্রথমে পিতৃলোকে মাংস শ্রাদ্ধ দেওয়া উচিত। স্নান করে সবাই আগে শুদ্ধ হয়ে এস ততক্ষণ আমি হরিণকে লক্ষ রাখছি। বুদ্ধিমান শেয়ালের কথা শুনে সকলে স্নান করতে গেল।
সবার মধ্যে শ্রেষ্ঠ ও বলিষ্ঠ সিংহ দ্রুত স্নান করে চলে এল। সিংহ এসে দেখে শেয়াল বিরস বদনে বসে আছে। সে শেয়ালকে বিরস বদনের কারণ জিজ্ঞেস করল এবং তাকে দ্রুত স্নান করে আসতে বলল।
শৃগাল সিংহকে বন্ধু সম্বোধন করে বলল, কি বলি বন্ধু ইদুঁরের কথা শুনে আমি বড়ই ব্যথা পেলাম। যখন তুমি স্নানে গেলে তখন সে তোমার নামে যে কুবচন করল তা বলতেও আমার লজ্জা হয়। ইদুঁর বলল সকলে সিংহকে বীর বলে অথচ আমি হরিণ মারলাম আর তাই সিংহ খাবে।
শুনে সিংহ দুঃখিত হল। অভিমান করে বলল –কি ছার ইদুঁর! তার এত সাহস! আমি কিছুতেই ঐ মাংস খাব না। নিজের বীর্য্যে হরিণ এখনই ধরে আমি খাব। যে এমন অন্যায় বাক্য বলতে পারে তার মুখও আমি আর দেখব না। নিজের অর্জিত বস্তু আমি নিজেই ভক্ষণ করব। এত বলে সিংহ ঘন বনে ঢুকে গেল।
এরপর স্নান করে বাঘ সেখানে উপস্থিত হল। আস্তে আস্তে শিয়াল তার কাছে গিয়ে বলল -প্রাণসখা শুন তোমার ভাগ্য ভাল এখনই তোমার সিংহের সাথে দেখা হল না। সে তোমার উপর খুব রেগে আছে, হয়ত তোমার নামে কেউ তাকে কিছু বলে থাকবে। এখনই সে তোমাকে ধরতে গেল। আমাকে বলে গেল যেন একথা আমি তোমায় না জানাই। কিন্তু আমার প্রিয় বন্ধু তোমায় না বলে আমি থাকতে পারলাম না, এবার তুমি কি করবে ভেবে দেখ।
শেয়ালের কথা শুনে বাঘ অবাক হল এবং ভাবল কি জানি কি ভাবে আমি সিংহের কি ক্ষতি করলাম যে সে আমায় ধরতে চায়। কি করবে কোথা যাবে সে ভেবে অস্থির হল। তবে এ স্থান অবশ্যই নিরাপদ নয়, এখনই হয়ত সিংহ ঘুরে চলে আসবে-এই ভেবে বাঘ দ্রুত ঘোর বনে প্রবেশ করে আত্মগোপন করল।
এসময় ইদুঁর সেখানে এল। তাকে দেখে শেয়াল কান্না জুড়ে দিল। কাঁদতে কাঁদতে ইদুঁরকে জড়িয়ে ধরে প্রলাপ করে বলল -বন্ধু নকুলের(বেজি) কি দুর্মতি হল সে নিজের পূর্ব প্রকৃতি এখনও ছাড়তে পারেনি। হঠাৎ তার সাপের সাথে দেখা হল। যুদ্ধে তার কাছে হেরে তাকেও বন্ধু করে নিল। স্নান করে এখানে দু’জনে উপস্থিত হল। বেজি সাপকেও মাংসের ভাগ দিতে হবে বলল। অথচ আমরা পাঁচজন মিলে হরিণ মারলাম। তাই আমি সাপকে ভাগ দিতে না চাইলে সে রেগে গেল এবং তোমাকে ধরে খেতে বলল। এখন বেজি ও সাপ তোমায় খুঁজতে গেছে। আমাকেও বলে গেছে তুমি এলে যেন তোমায় ধরি। এত শুনে ইদুঁরের প্রাণ উড়ে গেল। দ্রুত সে পালিয়ে অন্য স্থানে চলে গেল।
তখন বেজি সেখানে উপস্থিত হল। তাকে দেখে শেয়াল ক্রোধের সঙ্গে বলল -দেখ সিংহ, বাঘ আর ইদুঁরের সাথে আমার যুদ্ধ হল। তারা হেরে পালিয়েছে বনে। তোমার যদি শক্তি থাকে তা হলে আমার সাথে এসে যুদ্ধ কর, নয় প্রাণ নিয়ে পালাও। বেজি শেয়ালের চেয়ে ছোট ও দুর্বল। সহজেই সে ভয়ে পালিয়ে গেল।
এভাবে শেয়াল বুদ্ধি দিয়ে চারজনকে চারভাবে ঠকিয়ে নিজেই পুর মাংস খেল।
কণিক আরো বললে -রাজা ভাল করে শুনুন এভাবেই রাজা রাজ্যবান হন। বলিষ্ঠকে বুদ্ধিতে জিতে মারবে। লোভিকে ধন দিয়ে ছলনা করে মারবে। শত্রুকে কোন ভাবে পেলে অবশ্যই ছাড়বে না। বিশ্বাস জন্মিয়ে বিপক্ষকে মারবে। সব সময় মনে রাখবে শত্রু তোমার জীবনের বৈরী। তাকে যেকোন প্রকারে মারতে হবে। ছলে–বলে–কৌশলে শত্রুকে যমের বাড়ি পাঠাতেই হবে। বেদেও এমন বিচার আছে। সেখানেও বলে বিশ্বাস জন্মিয়ে শত্রুকে মারা যায়। ভার্গব(পরশুরাম)ও বলেন এতে পাপ নেই। শত্রুকে বিশ্বাস করে পালন করলে তার গর্ভেই তোমার বিনাশ হবে। এসব ভাল ভাবে বুঝে রাজা উপায় বার করুন। এখনই ব্যবস্থা না নিলে পরে দুঃখই পাবেন। এত বলে কণিক নিজের গৃহে ফিরে গেল।
অন্ধরাজা ধৃতরাষ্ট্র গভীর চিন্তায় মগ্ন হলেন।
ভারতের পূণ্যকথা শুনলে পবিত্র হবে। কাশীরাম দাস সেই অদ্ভূত কাহিনীই বর্ণনা করেছেন।
....................................
উৎসর্গ: সকল ব্লগার বন্ধুকে
......................................
আগের পর্ব:
কথাচ্ছলে মহাভারত - ৫৮
Click This Link
আলোচিত ব্লগ
চুরি করাটা প্রফেসরদেরই ভালো মানায়
অত্র অঞ্চলে প্রতিটা সিভিতে আপনারা একটা কথা লেখা দেখবেন, যে আবেদনকারী ব্যক্তির বিশেষ গুণ হলো “সততা ও কঠোর পরিশ্রম”। এর মানে তারা বুঝাতে চায় যে তারা টাকা পয়সা চুরি... ...বাকিটুকু পড়ুন
শিব নারায়ণ দাস নামটাতেই কি আমাদের অ্যালার্জি?
অভিমান কতোটা প্রকট হয় দেখেছিলাম শিবনারায়ণ দাসের কাছে গিয়ে।
.
গত বছরের জুন মাসের শুরুর দিকের কথা। এক সকালে হঠাৎ মনে হলো যদি জাতীয় পতাকার নকশাকার শিবনারায়ণ দাসের সঙ্গে দেখা করা সম্ভব... ...বাকিটুকু পড়ুন
ঘুষের ধর্ম নাই
শহীদুল ইসলাম প্রামানিক
মুসলমানে শুকর খায় না
হিন্দু খায় না গাই
সবাই মিলেই সুদ, ঘুষ খায়
সেথায় বিভেদ নাই।
হিন্দু বলে জয় শ্র্রীরাম
মুসলিম আল্লাহ রসুল
হারাম খেয়েই ধর্ম করে
অন্যের ধরে ভুল।
পানি বললে জাত থাকে না
ঘুষ... ...বাকিটুকু পড়ুন
প্রতি মাসে সামু-ব্লগে ভিজিটর কত? মার্চ ২০২৪ Update
মার্চ ২০২৪ সালে আমাদের প্রিয় সামু ব্লগে ভিজিটর সংখ্যা কত ছিল? জানতে হলে চোখ রাখুন-
গত ৬ মাসের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ভিউ ছিল জানুয়ারি মাসে। ওই মাসে সর্বমোট ভিজিট ছিল ১৬... ...বাকিটুকু পড়ুন
ইরান-ইজরায়েল দ্বৈরথঃ পানি কতোদূর গড়াবে??
সারা বিশ্বের খবরাখবর যারা রাখে, তাদের সবাই মোটামুটি জানে যে গত পহেলা এপ্রিল ইজরায়েল ইরানকে ''এপ্রিল ফুল'' দিবসের উপহার দেয়ার নিমিত্তে সিরিয়ায় অবস্থিত ইরানের কনস্যুলেট ভবনে বিমান হামলা চালায়।... ...বাকিটুকু পড়ুন