বিশ্বামিত্র বশিষ্ঠ বিরোধ:
অর্জুন বিস্মিত হয়ে বিশ্বামিত্র ও বশিষ্ঠ মুনির অদ্ভূত কলহের কারণ জানতে চাইলেন।
গন্ধর্ব তখন সে সব পুরানো কথা বললেন- ব্রহ্মার মানসপুত্র বশিষ্ঠ, অরুন্ধতির পতি এবং ইক্ষাকুকুলের পুরোহিত।
অন্যদিকে কান্যকুব্জ দেশে কুশিকের পুত্র হলেন গাধি, তার পুত্র বিশ্বামিত্র ছিলেন সর্ব গুণ সম্পন্ন। বেদ, বিদ্যা, বুদ্ধিতে ভুবন বিখ্যাত।
একদিন তিনি সসৈন্য মৃগয়া করতে মহাবনে প্রবেশ করলেন। মৃগয়ায় শ্রান্ত রাজা ক্ষুদা-পিপাসায় পরিশ্রান্ত হয়ে ঘুরতে ঘুরতে বশিষ্ঠের আশ্রমে উপস্থিত হলেন। মনোহর স্থান দেখে রাজা খুশি হলেন। রাজাকে দেখে মুনি অতিথি সৎকারে মন দিলেন। রাজার সৈনিকদের পরিশ্রান্ত দেখে তিনি তার কামধেনু নন্দিনীকে ডেকে বললেন– দেখ রাজার সৈন্যরা আমার অতিথি। যে যা চায় তাই দিয়ে তাকে তুষ্ট কোরো।
বশিষ্ঠ মুনির আজ্ঞা পেয়ে সুরভী সংসারে যা অদ্ভূত তেমন কর্ম করল। হুঙ্কার দিয়ে নানা দ্রব্য আনলেন চর্ব্য-চষ্য-লেহ্য-পেয় নানা রত্ন ধন। বস্ত্র, অলঙ্কার, মালা, কুসুম, চন্দন, বিচিত্র পালঙ্ক আর বসার আসন। যে যা চাইতে লাগলো, তাই পেলো। সকল সৈন্য আনন্দিত হল।
দরিদ্র মুনির এমন বিস্ময় কর্ম দেখে গাধির পুত্র বিশ্বামিত্র অবাক হলেন। বশিষ্ঠের কাছে গিয়ে বলেন– আমি আপনাকে এক কোটি গরু দান করবো, যাদের খুর সোনায় মন্ডিত করে দেব। তার পরিবর্তে এই ধেনু আমায় দিন। অথবা আপনি যদি চান আমি রাজ্যও দিতে রাজি আছি। হস্তী, অশ্ব, পদাতিক যত সৈন্য সব আপনাকে দেব এই ধেনুর পরিবর্তে।
বশিষ্ঠ বলেন– আমি কামধেনু দান করব না। এটি দেবতা ও অতিথিদের জন্য আমার কাছে আছে।
রাজা বলেন– মুনি, তুমি জাতে ব্রাহ্মণ। ব্রাহ্মণদের এমন জিনিষের প্রয়োজন হয় না। এ কেবল রাজার ঘরেই সাজে। একে বনে নিয়ে তুমি কি করবে। নিজের ইচ্ছেতে ধেনু দান না করলে, যেন আমি বল প্রয়োগ করে ছলে-বলে-কৌশলে একে অধিকার করবো।
বশিষ্ঠ বলেন- তুমি তোমার দেশে শ্রেষ্ঠ, তাও সৈন্য সামন্ত নিয়ে। যা ইচ্ছে তুমি করে দেখ। আমি তপস্বী- আমার আর কি শক্তি!
শুনে বিশ্বামিত্র সৈন্যদের নির্দেশ দিলেন – কামধেনু সঙ্গে বেঁধে নিয়ে চল।
শুনে সৈন্যরা কামধেনুর গলায় দড়ি বেঁধে পিছনে বাড়ী মেরে মেরে নিয়ে চললো। প্রচন্ড মার খেয়েও কামধেনু নড়ল না। সজলাক্ষে ব্যাকুল ভাবে মুনির মুখের পানে চেয়ে রইলো।
মুনি বলেন – নন্দিনী, আমার কাছে তুমি কি চাও। আমার সামনে তোমার এত কষ্ট সহ্য করতে পারছি না। আমি সামান্য তপস্বী ব্রাহ্মণ, আমি আর কিবা করতে পারি তোমার জন্য। রাজা বল প্রয়োগ করে তোমায় নিয়ে যেতে চায়।
সে সময় রাজার সৈন্যরা কামধেনুর সন্তান ছোট্ট বাছুরটিকে ধরে গলায় দড়ি বেঁধে আগে আগে টেনে নিয়ে চললো। সন্তানকে নিয়ে যাচ্ছে দেখে কামধেনু নন্দিনী ডাক ছেড়ে চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে মুনিকে বলে – ভগবান, বিশ্বামিত্রের সৈন্যদের কশাঘাতে অনাথা আমি ও আমার সন্তান বিলাপ করছি। আপনি তা উপেক্ষা করছেন কেন! আমি কি করবো আজ্ঞা করুন।
মুনি দুঃখিত হয়ে বলেন – ক্ষত্রিয়ের বল তেজ, ব্রাহ্মণের বল ক্ষমা। কল্যাণী, আমি তোমায় ত্যাগ করিনি। নিজের শক্তিবলে যদি থাকতে পার, তবে আমার কাছেই থাক, এর বেশি আর কি বলবো।
মুনির মুখে একথা শোনা মাত্র পয়স্বিনী(দুগ্ধবতী গাভী) কামধেনু ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করল। ঊর্দ্ধমুখে গাভী হাম্বা রবে ডাক ছেরে শরীর বাড়াতে লাগল এবং বিশ্বামিত্রের সৈন্যদের তাড়াতে লাগলো। তার বিভিন্ন অঙ্গ থেকে নানাজাতির সৈন্য লাখে লাখে বের হল। পুচ্ছ থেকে পহ্লব নামে জাতি নানা অস্ত্র হাতে তেড়ে এল। মূত্রে জন্ম হল বহু ব্যাধের। দুই পাশ থেকে জন্ম নিল কিরাত ও যবন। মুখের ফেণা থেকেও অনেক সৈন্যের জন্ম হল। চারি পা হতে নানাজাতির ম্লেচ্ছরা জন্ম নিল। সকলে নানা ধরনের অস্ত্র নিয়ে বিশ্বামিত্রের সৈন্যদের তাড়া করল। দুই দলের সৈন্যদের প্রচন্ড যুদ্ধ হল। বিশ্বামিত্রের একজন সৈন্যের বিরুদ্ধে মুনির পাঁচজন সৈন্য হল। সহ্য করতে না পেরে বিশ্বামিত্রের সৈন্যরা রণে ভঙ্গ দিল। রাজার সামনেই তারা পালাতে লাগল। অনেক সৈন্য রক্তের নদীতে আহত হয়ে পরে রইল। এভাবে মুনির সৈন্য রাজার সৈন্যদের পিছনে পিছনে দৌড়ে তাদের বিতাড়িত করল। মুনির সৈন্য বিশ্বামিত্রকেও বনের বাইরে পাঠিয়ে মুনিকে এসে প্রণাম করল।
বিশ্বামিত্র সব দেখে শুনে বড়ই অপমানিত বোধ করলেন। এমন অদ্ভূত ঘটনা দেখে তিনি মনে মনে আত্মগ্লানিতে দগ্ধ হয়ে বলেন – ক্ষত্রিয় বলকে ধিক্! ব্রহ্মতেজই বল। সব দেখে বুঝেছি তপস্যাই পরম বল। সামান্য বিবাদে একটি ব্রাহ্মণ তপস্বীকে পরাজিত করতে পারলাম না, এ জন্মের আর কোন প্রয়োজন দেখি না। তপস্যা করে আমিও ব্রাহ্মণ হব, না হলে প্রাণত্যাগ করব। এসব ভেবে তিনি সব সৈন্যদের দেশে পাঠিয়ে গহন বনে তপস্যা করতে গেলেন।
বিশ্বামিত্রের সেই তপস্যা ছিল সাঙ্ঘাতিক। তার তপে ত্রিভুবন তপ্ত হয়ে উঠল। গ্রীষ্মকালে রাজা চারদিকে হোমাগ্নি জ্বেলে তার মাঝে ঊর্দ্ধপদে তপস্যা করেন। নাকে, মুখে রক্ত বহে ভয়ঙ্কর দেখালো। ধিরে ধিরে রাজা অস্থি-চর্মসার হয়ে ওঠেন। আহার কেবল পবন(বাতাস)। বর্ষাকালে উন্মুক্ত স্থানে যোগাসনে বসেন। ঘোর বৃষ্টিবাদলের মাঝে তিনি অচেতন হয়ে তপস্যায় রত। শীতকালে হীনবস্ত্র নিরাশ্রয়ে থাকেন। এই ভাবে সহস্র বছর তিনি তপস্যা করলেন। তাঁর তপে ব্রহ্মা তুষ্ট হয়ে বর দিতে এলেন।
ব্রহ্মা বলেন- বর প্রার্থনা কর, গাধির নন্দন, বিশ্বামিত্র!
বিশ্বামিত্র যোড় হাতে বলেন- আমায় ব্রাহ্মণ করে দিন।
বিরিঞ্চি(ব্রহ্মা) বলেন – ক্ষত্রিয়কুলে তোমার জন্ম। তুমি কি ভাবে ব্রাহ্মণ হবে! এতো দুস্কর কর্ম! অন্য যে কোন বর প্রার্থনা কর।
বিশ্বামিত্র ক্ষুদ্ধ হয়ে বলেন – অন্য আর কিছুর প্রয়োজন নেই।
ব্রহ্মা বলেন – পরের জন্মে তুমি ব্রাহ্মণই হবে। এখন যা চাও প্রার্থনা করে নাও।
বিশ্বামিত্র বলেন- আমি অন্য কিছু চাই না। ব্রাহ্মণত্ব দান করুন না হয় প্রাণ নিন।
এত কথা শুনে বিধাতা(ব্রহ্মা) সে স্থান ত্যাগ করলেন।
গাধি পুত্র বিশ্বামিত্র পুনরায় তপস্যা শুরু করলেন। ঊর্দ্ধবাহু, ঊর্দ্ধমুখ করে এক পায়ের আঙ্গুলে দাঁড়িয়ে থাকেন। তপ করতে করতে তিনি শুষ্ক কাঠের মত হয়ে গেলেন। কেবল হাড়ের খাঁচায় প্রাণটা রয়ে গেল। তাঁর এই প্রচন্ড তপস্যার তেজে তিনলোক তপ্ত হতে লাগলো। ইন্দ্রাদি সকল দেবতারা ভয় পেলেন। এত সহ্য করতে না পেরে ব্রহ্মা আবার এসে বিশ্বামিত্রকে মিনতি করলেন বর চাওয়ার জন্য।
বিশ্বামিত্র বলেন –আমি আগেই বলেছি আমি কি চাই। বর দিতে চাইলে আমাকে ব্রাহ্মণ কর।
এবার ব্রহ্মা এড়িয়ে যেতে পারলেন না। তিনি নিজের উত্তরীয় বিশ্বামিত্রের গলায় পরিয়ে দিলেন। এভাবে ব্রহ্মা বর প্রদান করে ব্রহ্মলোকে ফিরে গেলেন।
....................................
উৎসর্গ: সকল ব্লগার বন্ধুকে
......................................
আগের পর্ব:
কথাচ্ছলে মহাভারত - ৬৮
Click This Link
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা ডিসেম্বর, ২০১৪ সকাল ১১:২৯