[পূর্বকথা - পার্থের সাথে সুভদ্রার বিবাহ সুসম্পন্ন হল ....কিছুদিন পর কৃষ্ণ ও অর্জুন সপরিবারে যমুনার তীরে বেড়াতে গেলেন....ব্রাহ্মণবেশী অগ্নিদেব এসে তাদের খান্ডব বন দহনের অনুরোধ করলেন....]
নর-নারায়ণ
খান্ডব-বন দহনঃ -
খান্ডব দহন সম্ভব নয় দেখে ক্রোধি অগ্নি পুনরায় ব্রহ্মার কাছে গেলেন। অগ্নি বিরিঞ্চি ব্রহ্মা কাছে গিয়ে বিস্মিত হয়ে জানালেন তাঁর পক্ষে খান্ডব দহন সম্ভব হচ্ছে না।
প্রজাপতি ব্রহ্মা মুহূর্তে চিন্তা করে বলেন –ভয় পাবেন না অগ্নি, মতি স্থির করুন। আর তো কোন উপায় দেখছি না। কিছুদিন এখানে বিশ্রাম করুন। এর উপায় একটা বার করছি। সাবধানে শুনুন।
নর-নারায়ণ পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করবেন। তাদের সাহায্য পেলে আপনি খান্ডব দহন করতে পারবেন।
ব্রহ্মার বচন শুনে অগ্নি বহুদিন রোগ নিয়েও শান্ত, স্থির রইলেন। দ্বাপর যুগের শেষে নর-নারায়ণ অবতার রূপে জন্মগ্রহণ করলেন। তখন অগ্নি পুনরায় ব্রহ্মার কাছে গেলেন। ব্রহ্মার আজ্ঞা পেয়ে দেব হুতাশন অগ্নি দ্রুত নর-নারায়ণ অর্জুন-কৃষ্ণের কাছে হাজির হলেন। অগ্নির সব কথা শুনে পার্থ সম্মত হলেন।
আশ্বাস পেয়ে অগ্নি বলেন –খান্ডববন দগ্ধ করা খুবই কঠিন কাজ। সে বনের রক্ষক দেব পুরন্দর ইন্দ্র। তিনি সদা সতর্ক।
অর্জুন বলেন–আমি তাকে ভয় পাই না। বহু ইন্দ্র আসলেও আজ আমি জয়ী হব। তবে এখানে আমার যোগ্য ধনুর্বাণ সঙ্গে নেই। ইন্দ্রের সাথে যুদ্ধের জন্য অস্ত্রের প্রয়োজন। তাঁর সাথে যোগ্য রথ ও তুরঙ্গ(অশ্ব)ও দরকার। দেবরাজ ইন্দ্রকে যুদ্ধে সকলে সাহায্য করবেন। আমায় সাহায্যের সামান্য অস্ত্রও সঙ্গে নেই।
শ্রীকৃষ্ণের বাহুবল সহ্য করার ক্ষমতাও কারো হবে না। কিন্তু তিনিও এখানে বিহার করতে এসেছেন, তাই সঙ্গে সুদর্শন চক্র আনেন নি। আপনি আমাদের অস্ত্রের ব্যবস্থা করে দিন। আমরা অবশ্যই খান্ডববন দহনে আপনার সাহায্য করব।
তখন হুতাশন অগ্নি অনেক চিন্তা করে ধ্যানে সখা বরুণকে(জলদেবতা) স্মরণ করলেন। অগ্নির ডাকে জলেশ্বর বরুণ উপস্থিত হলেন।
বৈশ্বানর(অগ্নি) বরুণকে বলেন –সখা উপকার করুন। আপনার গৃহে চন্দ্রের দেওয়া যে রথ, অক্ষয় যুগল তূণ, গান্ডীব ধনুক(গন্ডারের মেরুদন্ডে তৈরী) আছে তা যদি দেন তবে আমার দুঃখ ঘোচে।
শুনে বরুণ সব অগ্নিকে এনে দিলেন। এমনকি নিজের পাশও(বরুণদেবের অস্ত্র, দড়ি বিশেষ) দান করলেন।
এভাবে সুরাসুরের পূজিত গান্ডীব মহাধনু, কপিধ্বজ রথ যা চন্দ্র-ভানুর জ্যোতিযুক্ত, যাতে শুক্লবর্ণের চারটি অশ্ব নিয়োজিত হল।
অক্ষয় যুগল তূণ অস্ত্ররূপে শোভা পেল।
শ্রীকৃষ্ণকে স্তব করে তাকে কৌমোদকী গদা ও সুন্দর একটি চক্র দান করে অগ্নিদেব বলেন –এই দুই দিব্য অস্ত্র সংসারে অতুলনীয়। আপনার হাতেই এ দুটি সুন্দর শোভা পায়।
এরপর পার্থ ও কৃষ্ণ নিজেদের রথে উঠলেন। গোবিন্দের গরুড়ধ্বজ ওবং পার্থের কপিধ্বজ রথ।
শতেক যোজন বিস্তৃত খান্ডব বন। পার্থ ও কৃষ্ণ বনের দুই প্রান্তে থেকে পাহারা দিতে থাকেন।
অগ্নিদেব নির্ভয় হয়ে বন দহন করেন। সেই আগুন পর্বতের আকার রূপ নেয়। প্রলয়ের মেঘ যেন গর্জন শুরু করল।
নানাবিধ বৃক্ষ চড়চড় করে পুড়তে থাকে। নানাজাতের পশু, পাখি, নাগরা পুড়তে থাকে। প্রাণ ভয়ে কেউ বন থেকে পালাতে গেলে তাদের কেটে আগুনে ফেলা হল। আনন্দ মনে হুতাশন অগ্নি সব ভক্ষণ করতে থাকেন। এভাবে অরণ্যের মধ্যে অনেক যক্ষ, রক্ষ, কিন্নর, দানব, বিদ্যাধর পুড়ে মরল।
প্রাণভয়ে কেউ স্ত্রী-পুত্রকে শেষবারের মত আলিঙ্গন করে আকুল হয়ে রোদন করল। কেউবা দ্রুত জলে ঝাঁপ দিল। কিন্তু জলজন্তুর সাথেই দ্রুত ভস্ম হল অগ্নির তেজে। জলে এভাবে পুড়ে মরল শফরী(পুঁটিমাছ/ ছোটমাছ), কচ্ছপ প্রভৃতি।
বনেতে পুড়ল বনবাসী সবাই। সিংহ, ভাল্লুক, বরাহ(শুকর), মৃগ, মহিষ, শার্দূল(বাঘ), খড়্গী(গন্ডার) এত পুড়ে মরল যে লিখে শেষ করা যায় না। অসংখ্য কুঞ্জর(হাতি) পুড়ল দীর্ঘ দীর্ঘ দন্ড নিয়ে। জম্বুক(শৃগাল/শেয়াল), শশক(খরগোশ), নকুল(নেউল/বেজি) এত মরল যে বলে শেষ হয় না।
নানাজাতের নাগ গর্জন করে আগুনে পরল। পঞ্চদশ ফণা তুলেও কেউ কেউ বাঁচার চেষ্টা করল।
নানাবর্ণের বড় বড় পাখিরাও পুড়ে মরতে লাগল। কেউ পবনতেজে উড়ে পালাতে গেলে অর্জুন তাকে কেটে অগ্নিতে ফেলল।
আকুল হয়ে সব জীব কলরব শুরু করল, যেন অর্ণব(সমুদ্র) উথলে উঠছে। অগ্নি আনন্দে পর্বত আকার রূপ ধারণ করে আকাশে উঠে গেল।
স্বর্গবাসী দেবতারাও সেই আগুনের ভয়ে পালাতে লাগলেন। ভয়ে সবাই ইন্দ্রের শরণ নিলেন।
সকলে দেবরাজকে খান্ডব দহনের কথা জানালেন –আপনার পালিত খান্ডববন হুতাশন অগ্নি দগ্ধ করছেন। অগ্নির সাথে দুজন মানুষও আছে, যারা তাকে সাহায্য করছে।
সব শুনে দেবরাজ ইন্দ্র রেগে গেলেন। তিনি দেব সমাজকে নিয়ে তাদের উচিত শিক্ষা দিতে চললেন।
মহাভারতের কথা অমৃত সমান, কাশীরাম দাস কহেন, শুনেন পুণ্যবান।
নর-নারায়ণ
......................................
উৎসর্গ: সকল ব্লগার বন্ধুকে
......................................
আগের পর্ব:
কথাচ্ছলে মহাভারত - ১১৭ Click This Link
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা জানুয়ারি, ২০১৬ সকাল ১১:১১