somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

হেয়াল ফন্ডিতে কয়...

১৯ শে এপ্রিল, ২০১১ বিকাল ৪:৫২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

লালনগীতির ভাব ও দর্শন
(প্রথম পর্ব)

লালন শাহ (১৭৭৪-১৮৯০) একজন সাধক কবি। ভেদ বুদ্ধিহীন মানবতার উদার পরিসরে সাম্য ও প্রেমের সুউচ্চ মিনারে বসেই লালন সাধনা করেছেন। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সাধক ও দার্শনিকদের কন্ঠের সাথে কন্ঠ মিলিয়ে সাম্য ও প্রেমের বাণী শুনিয়েছেন। তিনি রুমি, জামি, হাফেজের সমগোত্রীয়। কবীর, দাদু ও রজবের উত্তর সাধক। লালন কবি, দার্শনিক, ধর্মবেত্তা ও প্রেমিক। তার গান লোকসাহিত্য নয় মাত্র, বাঙ্গালির প্রাণের কথা, মনীষার ফসল ও সংস্কৃতির স্বাক্ষর। তিনি বাউলের গুরু। জীবন পথের দিশারী, জীবাত্মার মধ্যেই পরমাত্মার স্থিতি। এদের আদর্শ হচ্ছে know thyself, আত্মাং বিদ্ধি, নিজেকে চেন। হাদিসের কথায়, মান্‌আরাফা নাফসাহু ফাবাদে আরাযা রাব্বাহু — যে নিজেকে চিনেছে সে আল্লাহকে চিনেছে। জীবনের পরম ও চরম সাধনা হল খোদাকে চেনা। বাউলের রূপক অভিব্যক্তিতে সে পরমাত্মা হচ্ছেন — মনের মানুষ, অচিন পাখি, মানুষ রতন, মন্‌মনুরা ও অলখ সাঁই প্রভৃতি। বাউল রচনা সাধারণত রূপকের আবরণে আচ্ছাদিত। সে রূপক দেহধারা, বাহ্যবস্তু ও ব্যবহারিক জীবনের নানা কর্ম ও কর্মপ্রচেষ্টা থেকে গৃহীত।

ভাব ও দর্শন

ভাব বলতে বোঝায় লালন কী বিষয় নিয়ে গান লিখেছেন; দর্শন বলতে বোঝায় জগৎ ও জীবন সম্বন্ধে লালনের দৃষ্টিভঙ্গী, উপলব্ধি কিরূপ ছিল। আমরা প্রথমে লালনগীতির বিষয়বস্তু এবং পরে দর্শনচিন্তা সম্পর্কে আলোচনায় আসব।

বাউল গান আমাদের তত্ত্বসাহিত্যের অন্যতম শাখা। এটি ধর্মমত মরমিবাদ ও আধ্যাত্মিকতার ওপর প্রতিষ্ঠিত। বাউলের লিখিত কোন শাস্ত্র নেই; বাউল গানে তাদের ধর্মীয় সাধনার তত্ত্বনীতির কথা প্রকাশ পেয়েছে। এ গান সাধকের মুখে মুখে রচিত ও শিষ্য-প্রশিষ্যের মুখে মুখে প্রচারিত হয়। লালন নিজে নিরক্ষর ছিলেন, তার আস্তানা ছিল কুষ্টিয়ার ছেঁউড়িয়াতে। তিনি প্রচুর গান রচনা করেন যা অনেক সময় তার শিষ্যরা লিখে রাখতেন। আমাদের বিশ্বাস, আধ্যাত্মভিত্তিক মরমী গান রচনা করে বাউলদের ধর্মীয় আচরণে একটি নতুনধারার প্রবর্তন করেন এবং বাউল সম্প্রদায়ের চিন্তার জগতে বিপ্লব সাধন করেন। গান রচনা করা এবং গান গাওয়া ধর্ম সাধনার অঙ্গ হয়ে দাঁড়ায়। বৈষ্ণবধর্মে কীর্তনের যে স্থান, বাউল মতবাদে বাউল গানের সে স্থান। লালনের আগে বাউল ছিল, বাউল গান ছিল না।


কী আছে লালনগানে?

একজন বাউল গান করেন নিজের আত্মার শুদ্ধির জন্য। মানুষের দেহ আছে। দেহের মধ্যে আত্মা। আত্মা প্রবৃত্তি ও ইন্দ্রিয় দ্বারা কলুষিত হয়। দেহকে জাগতিক লোভ, মোহ, আসক্তি থেকে মুক্ত করতে পারলে আত্মার শুদ্ধি ঘটে।


চিত্তের শুদ্ধির উপায় কী?

উপায় দুই প্রকার। যথাঃ জ্ঞান স্বর্গীয় ও আচার স্বর্গীয়।

শুদ্ধ জ্ঞান সাধনা করে ঐশী মহিমা লাভ করা যায়। সুফিরা জ্ঞানাচারী জিকির বা নাম জপকে সারবস্তু করে ধর্মপথে অগ্রসর হন। ধর্ম সাধনা আবার দুই প্রকার – যোগাচার ও বামাচার। শ্বাস-প্রশ্বাস নিরোধ এবং প্রাণায়ামাদি যোগ সাধনার দ্বারা ‘আপ্তনাশ’ ঘটে ও সাধনায় সিদ্ধি আসে। বামাচারী সাধনা হল সকাম সাধনা। নারীর সংসর্গ ও সঙ্গম এরূপ সাধনার অঙ্গীভূত। বাউল সাধনায় জ্ঞান, যোগ ও বামাচার সব কটি ধারার মিশ্রণ আছে। বাউল সাধনা গুরু আশ্রিত, দীক্ষিত; সাধক যাই করুক তা গুরুর নির্দেশ অনুসারে করবে। তিনি সকাম-নিষ্কাম কোন পথে যাবেন তা নির্দেশিত করে দেবেন। এমনকি মিথুনাত্মক প্রেম সাধনা গুরুর সাক্ষাত উপস্থিতিতে নিষ্পন্ন হয়। অবশ্য সকাম প্রেমের পথে লক্ষ্য নিষ্কাম প্রেমের পথে উত্তরণ, যা ঐশী প্রেম – তুরীয় তদগত ও স্থায়ী।

বাউল দেহবাদী ধর্ম, আবার গুরুবাদীও। লালন বলেন,

গুরুর চরণ অমূল্য রতন,
কবে দয়াল চান্দের দয়া হবে।


অথবা

গুরুকে যে জন জানে,
ওরে তার রূপ যায় চেনা।
আছে তার নিশানা।


ভক্তই যতই সাধন ভজন করুক, সে ভাবে কিছুই হল না। তাই সাধন ভজন তাকে উদ্ধার করতে পারবে না। তাকে উদ্ধার করতে পারবে কেবল করুণাময়ের করুণা। তাই লালন নিজেকে সম্পূর্ণ তার কাছে সঁপে দেন।

খাঁচার ভিতর অচিন কমনে আসে যায়,
তারে ধরতে পারলে মন-বেড়ি দিতাম পাখির পায়।।

তবে লালন ধর্মভিত্তিক জাতিতে বিশ্বাসী ছিলেন না। তিনি মনে করতেন জাত ঈশ্বর-সাধনার পথে বিঘ্নস্বরূপ। মানুষ যতদিন ধর্মভিত্তিক জাতিত্ব পরিত্যাগ করতে না পারবে, ততদিন জনম-মানুষকে লাভ করতে পারবে না।

লালন কয়, জাত হাতে পেলে
পুড়তাম আগুন দিয়ে।


লালনের মতে সাঁই বা অধরকালার নিকট সকল মানুষই সমান। হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান কোন পার্থক্য নেই। যে জাতির লোকই হোক না কেন ভক্তি ভরে তাকে ডাকলেই তিনি অধর হয়েও ধরা দেন। তার নিকট জাতের কোন মূল্য নেই। তার কাছে মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব, দেবদেবীর উর্ধ্বে তার স্থান। তিনি মানবতার জয়গান গেয়েছেন।

ভবে মানুষ গুরু নিষ্ঠা যার
সর্ব সাধনা সিদ্ধ হয় তার


যারা হাওয়ার সাধনা করে তারাই মূলত বাউল। তাদের মতে সাধনা চারটি স্তর। স্থূল, পর্বত, সাধক ও সিদ্ধ।

আপনার আপনি চেনা যদি যায়
তবে তাদের চিনতে পারি
সেই পরিচয়।


লালনের ভাবশিষ্যরা বিশ্বাস করে, শারীরিক প্রেম ভালবাসার মধ্যে প্রকৃত শান্তি নেই। প্রকৃত শান্তি স্বর্গীয় ভালবাসায়। গুরুর নিকট দীক্ষা গ্রহণের পর সাধনার বিশেষ স্তরে পৌঁছুলেই কেবল শিষ্যকে খেলাফত প্রদান করা যায়।

ভাব শূন্য থাকিলে হৃদয়
বেদ পড়িলে কি ফল হয়


এভাবে অজানাকে জানা, অচেনাকে চেনা, অধরাকে ধরা; ভক্ত প্রেমিক মরমী সাধক বাউলের জীবনব্যাপী লক্ষ্য, রাধাকৃষ্ণের যুগলি রূপ শ্রীচৈতন্য; তিনি রাধা ভাবে শ্রী কৃষ্ণকে ভজনা ও আস্বাদন করেন; এই দেহে পুরুষ ও প্রকৃতির মিলন জাত পরমানন্দের আস্বাদন সম্ভব, বাউলরা তা বিশ্বাস করেন।

আত্মা, পরমাত্মা, গুরু, প্রেম, ভক্তি ও সাধনা এই পাঁচটি তত্ত্ব লালন বা বাউল গীতির মুখ্য ও ভাব জগতরূপে চিহ্নিত করা যায়।

বাংলা গান ভাবপ্রধান, সুরপ্রধান নয়। লালন গীতির ক্ষেত্রেও একথা প্রযোজ্য। তবে সুরহীন গান, গান নয়। বাউল গানের নিজস্ব সুর আছে। যা লোকসঙ্গীতের অন্য অনের গানের মধ্যে হারিয়ে যায় না। ভাব ও সুরের দিক থেকে বাউলগীতি বাংলা গানের ভুবনে একটি স্বতন্ত্র ও স্থায়ী আসন করে নিয়েছে।



তথ্যসূত্র
১. বাংলা সাহিত্যের পুরাবৃত্তঃ ওয়াকিল আহম্মেদ
২. লালন স্মারক গ্রন্থ
৩. লালনের গানঃ এ কে এম আজাদুর রহমান।
৪. বাংলা সাহিত্যের সম্পূর্ণ ইতিবৃত্তঃ ড. অসিত কুমার বন্দোপাধ্যায়

৩টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

কষ্ট থেকে আত্মরক্ষা করতে চাই

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৯



দেহটা মনের সাথে দৌড়ে পারে না
মন উড়ে চলে যায় বহু দূর স্থানে
ক্লান্ত দেহ পড়ে থাকে বিশ্রামে
একরাশ হতাশায় মন দেহে ফিরে।

সময়ের চাকা ঘুরতে থাকে অবিরত
কি অর্জন হলো হিসাব... ...বাকিটুকু পড়ুন

রম্য : মদ্যপান !

লিখেছেন গেছো দাদা, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৫৩

প্রখ্যাত শায়র মীর্জা গালিব একদিন তাঁর বোতল নিয়ে মসজিদে বসে মদ্যপান করছিলেন। বেশ মৌতাতে রয়েছেন তিনি। এদিকে মুসল্লিদের নজরে পড়েছে এই ঘটনা। তখন মুসল্লীরা রে রে করে এসে তাকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

মেঘ ভাসে - বৃষ্টি নামে

লিখেছেন লাইলী আরজুমান খানম লায়লা, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৩১

সেই ছোট বেলার কথা। চৈত্রের দাবানলে আমাদের বিরাট পুকুর প্রায় শুকিয়ে যায় যায় অবস্থা। আশেপাশের জমিজমা শুকিয়ে ফেটে চৌচির। গরমে আমাদের শীতল কুয়া হঠাৎই অশীতল হয়ে উঠলো। আম, জাম, কাঁঠাল,... ...বাকিটুকু পড়ুন

= নিরস জীবনের প্রতিচ্ছবি=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৪১



এখন সময় নেই আর ভালোবাসার
ব্যস্ততার ঘাড়ে পা ঝুলিয়ে নিথর বসেছি,
চাইলেও ফেরত আসা যাবে না এখানে
সময় অল্প, গুছাতে হবে জমে যাওয়া কাজ।

বাতাসে সময় কুঁড়িয়েছি মুঠো ভরে
অবসরের বুকে শুয়ে বসে... ...বাকিটুকু পড়ুন

Instrumentation & Control (INC) সাবজেক্ট বাংলাদেশে নেই

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৫৫




শিক্ষা ব্যবস্থার মান যে বাংলাদেশে এক্কেবারেই খারাপ তা বলার কোনো সুযোগ নেই। সারাদিন শিক্ষার মান নিয়ে চেঁচামেচি করলেও বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরাই বিশ্বের অনেক উন্নত দেশে সার্ভিস দিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×