ছোট্ট-মোট্ট এক শহর। নাম দেবপুর। অনেকদিন আগে সে শহরে ছিল এক ধোপা। তার ছিল হ্যাংলা-পাতলা ও রোগা টাইপের একটা বৃদ্ধ গাধা। ধোপা তার গাধাকে বোলা নামে ডাকতো। সকাল হলেই বোলার পিঠে চাপিয়ে ধোয়া কাপড় দোকানে নিয়ে যেতো, আবার সন্ধ্যা বেলা একইভাবে ময়লা কাপড় বাসায় নিয়ে আসতো। কাপড় আনা-নেওয়া ছাড়া বোলার আর কোনো কাজ ছিল না। তবুও সে রোগা থেকে আরও রোগা হতে লাগলো।
রাত হলে বোলা ইচ্ছামতো ঘোরাঘুরি করতো। ঘুরতে ঘুরতে এক রাতে সে দেখা পেলো ক্ষুধার্ত এক শিয়ালের। শিয়ালটা ধীরে-সুস্থে হাঁটছে আর খাবার খুঁজছে। বোলা এগিয়ে গেলো। কথা বলে জানতে পারলো এই শিয়ালের নাম বিজলী।
বিজলীর সঙ্গে কথা বলে বেশ মজা পেলো বোলা। বিজলীরও ভালো লাগলো। ওরা বন্ধু হয়ে গেলো।
শুধু কি তাই? এরপর প্রায় প্রতি রাতে তারা দেখা করতো, গল্প করতো, আর খাবার খুঁজতো। এভাবে খুঁজতে খুঁজতে এক রাতে পেয়ে গেলো রাজ্যের সবচেয়ে বড় শসা বাগানের খোঁজ। বাগানের শসা দেখেই বোলার জিভে পানি চলে এলো। দু'এক ফোঁটা গড়িয়েও পড়লো।
বোলার জিভে পানি দেখে শিয়ালেরও একই অবস্থা। এরপর দু'জন গুটি গুটি পায়ে বাগানে ঢুকে দেদার খেয়ে চললো শসা। এক সময় পেট ফুলে-ফেঁপে মোটা হয়ে ওঠলো। দু'জন হেলে-দুলে মোটা পেট নিয়ে বাড়ি ফিরলো। পরের রাতে এসে আবার শসা খাওয়া শুরু করলো। এভাবে একদিন, দুদিন, প্রতিদিন। রোগা-পাতলা বোলার স্বাস্থ্যের পরিবর্তন ঘটলো। অনেক মোটাসোটা হয়ে গেলো। দেখতে অন্য আট-দশটা গাধার মতোই স্বাস্থ্যবান মনে হলো তাকে।
এক রাতে শসার জুস দিয়ে ডিনার সেরে বোলা খুব আনন্দে আপ্লুত হয়ে প্রিয় বন্ধু বিজলীকে বললো, 'আকাশের দিকে তাকাও তো। গোলাকার চাঁদকে কেমন সুন্দর লাগছে। বইছে ঝিরঝিরে বাতাস। এমন একটা রাতের জন্যই আমার অপেক্ষা। এ রাতটাই আমাকে গান গাওয়ার ভাব তৈরি করে দিলো। এমন রাত দ্বিতীয়টি কবে পাবো, জানি না!'
'প্রিয় বন্ধু, এখন গান করো না, তোমার গান শুনলেই পাহারাদার জেগে যাবে। তাকে জাগিয়ে দেওয়া মানে বড়সড় একটা বিপদকে সংবর্ধনা দিয়ে নিজেদের ঘাড়ে নিয়ে আসা।' বন্ধুসুলভ হাসি দিয়ে বললো বিজলী।
কিন্তু তার এমন নিষেধ শোনার সময় কই বোলার? সে বললো, 'কী যা-তা বলছো! এমন মনোরম পরিবেশে তুমি আমার পাশে। এর চেয়ে বড় আনন্দের আর কী আছে? এমন একটা সময়ে গান থেকে কে থামাবে আমাকে!'
বন্ধুকে যুক্তি দিলো শিয়াল। বললো, 'যাই বলো, তোমার কণ্ঠ কাকের চেয়ে ভালো নয়! তার চেয়ে বরং তুমি চুপচাপ থাকো। তাহলে বিপদ আমাদের কাছে আসতে পারবে না।'
কিন্তু বোলা কোনোভাবেই সেটা মানতে চাইলো না। উল্টো বললো, 'তুমি কি গানের রাগ বা তাল সম্পর্কে কিছু জানো? জানবেই বা কেমনে? তুমি তো গানই জানো না। যদি জানতে তাহলে এমন ভীতুর মতো আমাকে বারবার নিরুৎসাহিত করতে না।'
আবারও বিপদের কথা মনে করিয়ে প্রিয় বন্ধুকে বিজলী বললো, 'আসলে তুমি ঠিকই বলেছো বোলা। গান বা মিউজিক সম্পর্কে আমার বিন্দুমাত্র ধারণা নেই। তবে এখন তুমি গান গাইলে পাহারাদার জেগে উঠবে। আর তোমাকে এমন পুরস্কার দেবে, যা তুমি দ্বিতীয়বার জন্ম নিলেও ভুলতে পারবে না। সুতরাং আমার কথা শুনে অন্তত এ মুহূর্তে গান গাওয়ার কথা ভুলে যাও।'
'আমি জানি, তুমি সব সময়ই একটা বোকা। আমার গানের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে তুমি এখনও সন্ধীহান। আমি গান শুরু করছি। তবে অবশ্যই তোমার জন্য গানটা'_ বলেই ছেঁড়ে গলায় গাইতে শুরু করলো বোলা।
'থামো, থামো, তুমি যদি আরও গাইতে চাও, তাহলে আগে আমাকে এখান থেকে চলে যেতে দাও। আমি বাগানের বাইরে গেলেই তুমি মনপ্রাণ খুলে গাইতে শুরু করো। তবে আমি বাইরে তোমার অপেক্ষায় থাকবো।' কাঁদতে কাঁদতে বললো বিজলী।
বোলা উচ্চৈঃস্বরে গাইতে শুরু করলো। তবে তার আগেই বিজলী দ্রুত কেটে পড়লো। এদিকে গান শুনে জেগে ওঠলো পাহারাদার। তার নির্দিষ্ট লাঠি নিয়ে চুপিচুপি এগিয়ে এসে আচ্ছা পিটুনি লাগালো বোলাকে। শান্ত করে দিলো ওর গানের গলা! আচ্ছামতো মার খেয়ে আধমরা হয়ে পড়ে রইলো বোলা।
বিজলী তখনও অপেক্ষা করছে বোলার জন্য। সকাল হবে হবে_ এমন সময় জ্ঞান ফিরে পেয়ে কাতরাতে কাতরাতে বাগান থেকে বের হলো বোলা। গেটের সামনে এসেই দেখা পেলো বিজলীর।
'স্বাগতম বন্ধু, তুমি তোমার গানের উত্তম পুরস্কার পেয়েছো নিশ্চয়ই' -বললো বিজলী।
'আমাকে আর লজ্জা দিও না। তোমার কথা না শোনাতেই আমার এ অবস্থা। আমি খুবই লজ্জিত বন্ধু।' _নতমুখে জবাব দিলো বোলা।
এরপর কী হলো?
খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে বাড়ি ফিরলো গায়ক গাধা। আর চালাক শিয়াল হেলে-দুলে বাসার দিকে চলে গেলো।

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



