somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

সাকাহাফং এর পথে... [পর্ব-১]

২৫ শে অক্টোবর, ২০১৪ বিকাল ৪:০৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

অনেকদিন ধরেই একটি দূর্গম এলাকায় ভ্রমণের কথা মাথায় ঘুরছে। তাই সিদ্ধান্ত নিলাম বান্দরবান যাব। গুগলে খোজাখুজি করতে একটি ইভেন্ট পেলাম। ইভেন্টের রুট প্লানটা আমার খুব পছন্দ হল।ঠিক এই রকম "ঢাকা- বান্দরবান শহর- থানচি- বোরডিংপাড়া- শেরকর পাড়া-তাজিংডং-সিপ্লাম্পি পাড়া-থান্দুই পাড়া- নেফিউ পাড়া- চম্বকই ফলস- নেফিউ ফলস- সাকাহাফং চুড়া- সাজাই পাড়া- সাতভাই পাথর- সাতভাইকুম-আমিয়াকুম-নাক্ষিয়াং-লালদুসং পাড়া-বুজুম পাড়া- দুলু পাড়া-উলাচি পাড়া- চিংথন পাড়া- নাফাকুম- পাইন্দং পাড়া-রেমাক্রি বাজার- রাজা পাথর- তিন্দু- থাঞ্চি- বান্দরবান শহর- ঢাকা।"


৭ তারিখ থেকে আমাদের যাত্রা শুরু হল। রাত ১২ টায় আমাদের বাস ছাড়ে সকাল ৭.৩০ মিনিটে বান্দরবান শহরে আমরা পোঁছালাম। সকালের নাস্তা শেষ করে আমাদের গাইডকে ফোন দিলাম। সে এসে জানাল আমাদের জীপটা অন্য একটি ট্রিপ নিয়ে চলে গেছে। কিছুক্ষণ বান্দরবান শহরে ঘুরলাম। সাঙ্গুর অপরূপ সৌন্দোর্য্য দেখলাম।
তারপর থানচির বাসে উঠে বসলাম। বান্দরবান থেকে থানচির পথ গুলো খুব সুন্দর। কখনো আকা বাকা পথা কখনো বা উচু নিচু বাক, দুই পাশে পাহাড়, কিছুদুর তাকালে বিশাল খাদ। মাঝে মাঝে অনেক নিচু ঢাল কখনো ডানে অবার বামে বেঁকে গেছে। পুরোটা রাস্তায় আমি খুব এক্সাইটেড ছিলাম আর খুব উপভোগ করেছি। অবশেষে ৫ ঘন্টা বাস জার্নি শেষে আমরা থানচি পোঁছালাম। এখানে খাবারের অবস্থা খুব ভাল না। ভাত, মাংস আর ডাল দিয়ে সবাই পেট ভরে দুপুরের খাবার খেয়ে নিলাম। তারপর কিছু শুকনো খাবার ও প্লাস্টিক কিনে নিলাম।


এখান থেকেই আমাদের ট্রেকিং শুরু হল। ৫.০০ টা বাজে আমরা থানচি থেকে বোর্ডিং পাড়ার উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। অতিরিক্ত খাবার ফলে একটু হাটতেই শরীর খুব গরম হয়ে গেল। তবুও আমাদের আজকের মধ্যেই বোর্ডিং পাড়াতে পোঁছাতে হবে। তাই কষ্ট করে হলেও হাটতে হল। এই রাস্তাতে ১ম জোকের আক্রমণের শিকার হলাম। তাই আমাদের প্রায় গ্রুপের সবাই খুব ভয় পেতে শুরু করল। তার উপর সন্ধ্যা শেষে রাত নামতে শুরু করল। জোক, পিচ্ছিল এবং প্রচন্ড বিপজ্জনক রাস্তা সব মিলিয়ে প্রতিটা পদক্ষেপ ছিল গা ছমছম করার মত।


মাঝে সবুজ রঙের সাপের স্পম্মুক্ষিনও হতে হয়েছে।


রাত ৮.০০ টায় আমরা বোর্ডিং পাড়াতে পোঁছালাম। এখানে আমাদের গাইড রান্না করল, রাতের খাবার শেষ করে সবাই ঘুমিয়ে গেলাম।
৮ তারিখ ভোর ৫ টায় সবাই আবার শেড়কর পাড়ার উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। সকালের পাহাড় গুলো অনেক সুন্দর।


পাহাড়ের ফাকে ফাকে মেঘ এসে জমে রয়েছে যেন আমরা মেঘের উপর দিয়ে হাটছি। ১ম দিনের তুলনায় বেশ ভাল ছিল।


প্রায় ৩ ঘন্টা হাটার পর আমরা শেড়কর পাড়াতে পোঁছালাম। এখানে দুপুরের খাবার খেয়ে তাজিংডং এর উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। ঠিক তখনি শুরু হল বৃষ্টি। বৃষ্টিতে পাহাড়ি পথ গুলো অনেক পিচ্ছিল হয়ে উঠে এবং জোকের আনাগোনাও বেড়ে যায়। পিচ্ছিল পথে হাটতে খুব কষ্ট হচ্ছিল। ফলে আমাদের হাটার স্পিড খুব কমে গিয়েছে। খুব মনোযোগ দিয়ে প্রতিটা পদক্ষেপ আগাতে হচ্ছে। একটি ভুল পদক্ষেপও মৃত্যু ডেকে আনতে পারে। ঠিক দুপুর ২ টায় আমরা তাজিংডং এর চূড়ায় উঠি।


তাজিংডং এর চূড়ায় উঠতে একটি খাড়া রাস্তা রয়েছে। সেই রাস্তাটাও বৃষ্টিতে ভিজে পিচ্ছিল অবস্থা। তাজিংডং এর চূড়ায় দাড়ানোর মত জায়গা খুব কম। সেখানে আমরা ২০ জন আটসাট হয়ে ১ ঘন্টা থাকলাম, কিছু ছবি তোলা হল। তারপর আমরা থান্দুই পাড়ার উদ্দেশ্যে রওনা হলাম।
প্রায় ৩.৩০ মিনিট হাটার পর সন্ধ্যার দিকে আমরা সিমপ্লাম্পি পাড়াতে পৌঁছাই। সেখানে পোঁছে কারো শরীরেই আর শক্তি অবশিষ্ট নেই। তাই এখানে রাত্রি যাপন করতে হল। সবাই যখন ড্রেস পরিবর্তন করতে শুরু করল একজন দেখল তার শরীরে দুই পায়ের মাঝে বিশাল ১টি জোক। তাড়াতাড়ি জোক টাকে সরানো হল। এর পরেই বোঝা গেল ক্ষতির পরিমাণটা। জোকে কামড়ানো যায়গা থেকে প্রচুর রক্তক্ষরণ হচ্ছিল। কোনভাবেই রক্ত বন্ধ হচ্ছিল না। এরকম দৃশ্য দেখার পর অনেকেই ভয় পেয়ে গেল।


৯ তারিখ সকালে আমরা নেফিউ পাড়ার উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। এখান থেকে নেফিউ পাড়া প্রায় ১০ ঘন্টার রাস্তা। তাই আমরা খুব তাড়াতাড়ি হাটতে শুরু করলাম। ১ ঘন্টার মধ্যেই থান্দুই পাড়াতে এসে পৌঁছে গেলাম। কিছুক্ষন রেস্ট নিলাম।


আমাদের গাইড টা নেফিউ পাড়ার রাস্তা ঠিক মত চিনত না। তাই থান্দুইপাড়া থেকে একজন কে নিয়ে গেলাম যিনি রাস্তাতা চিনেন। রাস্তাটা খুব খারাপ। এ পথে বন জঙ্গল বেশী তাই হাটতে খুব কষ্ট হচ্ছিল। হাটার মাঝে আমি ডান পায়ে প্রচন্ড ব্যাথাও পাই। কিন্তু এটা তো আর আমার বাসা না যে, সাথে সাথেই ডাক্তার পেয়ে যাব। পায়ের ব্যাথা নিয়েও সামনে এগিয়ে যেতে হচ্ছে। ঝোপঝাড়ের মধ্যে দিয়ে জোকের কামড় আর পায়ের ব্যাথা নিয়ে হেটে চলেছি। ৩ ঘন্টা হাটার পর আমরা হাজরাই পাড়াতে আসি। সেখানে ১০ মিনিট রেস্ট নিয়ে আবার যাত্রা শুরু করি। কারণ আজকের মধ্যেই আমাদের নেফিউ পাড়াতে যাতে হবে। পরদিন সাকাহাফং জয় করব। হাজরাই পাড়া থেকে ৪ ঘন্টা ট্রেক করে নেফিউ পাড়া পৌঁছাই। এ পর্যন্ত আসতে প্রতিটা মানুষের অনেক কষ্ট হয়েছে। এই পর্যায়ে আমি বিশ্বাস করতে বাধ্য হয়েছি যে, মনের জোর বলে আসলেই কিছু রয়েছে। যখন শরীরের কোন শক্তি অবশিষ্ট নেই তখন কিভাবে এত বিপজ্জনক রাস্তা পেরিয়ে গেলাম। নেফিউ পাড়া এসে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম এই পথে আর ফিরে যাব না, যদি যাই তাহলে ঠিক মারা পড়ব। নেফিউ পাড়া উঠতে প্রচন্ড খাড়া একটি পাহাড় রয়েছে যা ঝুর ঝুড়ে পাথরে ভরা। হাত পা কিছু দিয়েই কনফিডেন্টলি গ্রিপ পাওয়া যায় না। এই রাস্তায় আমি একেবারে আমার ব্যালান্স হারিয়ে ফেলেছিলাম। একটুর জন্যে বেঁচে গিয়েছি। নেফিউ পাড়াতে উঠে একেবারে শুয়ে পড়লাম। আর ১ পা সামনে যাবার মত কোন শক্তি আমার ছিল না। রাতে নেফিউ পাড়াতে থাকলাম। সেইদিন নেফিউ পাড়াতে নাকি হরিণ শিকার করা হয়েছে। আমি উপজাতি দের সাথে কথা বলে জানতে পারলাম এটি শিকার করা হয়েছে রাতে তাদের পাড়ার সবাই মিলে এর মাংস খাওয়া হবে। এই সুযোগ মিস করি কিভাবে!!! আমিও তাদের সাথে কথা বলে ম্যানেজ করে নিলাম। রান্না শেষ হলে আমাকে ডেকে নিয়ে যাবে হরিণের মাংস খাবার জন্য। জীবনের ১ম হরিণের মাংস খাব ভাবতেই অন্য রকম লাগছিল। অবশেষে হরিণের মাংস খাবার জন্য ডাক পড়ল। আমি এবং আরও দুইজন ঢুকে গেলাম একটি ঘরে। ঘরে ঢোকার পর এমন গন্ধ পেলাম যে, ওই ঘরে আর ২০ সেকেন্ড দাঁড়িয়ে থাকাটা আমার জন্য অসম্ভব ছিল। খাসির মাংস ও পেঁপে সিদ্ধ দিয়ে রাতের খাবার খেলাম। তারপর ঘুমানোর প্রস্তুতি নিলাম।


১০ তারিখ সকাল ৫ টায় উঠে আমরা সাকাহাফং এর উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় শৃঙ্গে উঠব তাই খুব এক্সাইটেড ছিলাম। নেফিউ পাড়া থেকে সাকাহাফং এর রাস্তাটিতে সর্বাধিক মাত্রায় জোক রয়েছে। এই পথে সবচেয়ে বেশী জঙ্গল রয়েছে। জঙ্গল কেটে কেটে রাস্তা তৈরি করে আমাদের এগোতে হয়েছে। ঠিক সকাল ৬.৪৫ মিনিটে আমরা সাকাহাফং জয় করি। সব কষ্ট এক নিমিষে শেষ হয়ে গিয়েছিল।

সাকাহাফং এর চূড়া থেকে মায়ানমার এর দৃশ্যটা অসাধারণ। মনে যেন পাহাড় গুলো সব মেঘের সাগরের নিচে ডুবে রয়েছে। এখানে ১ ঘন্টা থেকে আমরা প্রায় দৌড়ে নেফিউ পাড়াতে নামি। নামতে আমাদের ১.১০ মিনিট সময় লেগেছিল।



পরের পর্ব নাইক্ষংকুম, আমিয়াকুম ও নাফাকুমের পথে.. .
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে অক্টোবর, ২০১৪ দুপুর ১২:৪২
১৩টি মন্তব্য ১২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

দু'টো মানচিত্র এঁকে, দু'টো দেশের মাঝে বিঁধে আছে অনুভূতিগুলোর ব্যবচ্ছেদ

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ১২:৩৪


মিস ইউনিভার্স একটি আন্তর্জাতিক সুন্দরী প্রতিযোগিতার নাম। এই প্রতিযোগিতায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সুন্দরীরা অংশগ্রহণ করলেও কখনোই সৌদি কোন নারী অংশ গ্রহন করেন নি। তবে এবার রেকর্ড ভঙ্গ করলেন সৌদি... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমার প্রফেশনাল জীবনের ত্যাক্ত কথন :(

লিখেছেন সোহানী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সকাল ৯:৫৪



আমার প্রফেশনাল জীবন বরাবরেই ভয়াবহ চ্যালেন্জর ছিল। প্রায় প্রতিটা চাকরীতে আমি রীতিমত যুদ্ধ করে গেছি। আমার সেই প্রফেশনাল জীবন নিয়ে বেশ কিছু লিখাও লিখেছিলাম। অনেকদিন পর আবারো এমন কিছু নিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমি হাসান মাহবুবের তাতিন নই।

লিখেছেন ৎৎৎঘূৎৎ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



ছোটবেলা পদার্থবিজ্ঞান বইয়ের ভেতরে করে রাত জেগে তিন গোয়েন্দা পড়তাম। মামনি ভাবতেন ছেলেটা আড়াইটা পর্যন্ত পড়ছে ইদানীং। এতো দিনে পড়ায় মনযোগ এসেছে তাহলে। যেদিন আমি তার থেকে টাকা নিয়ে একটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তিযোদ্ধাদের বিবিধ গ্রুপে বিভক্ত করার বেকুবী প্রয়াস ( মুমিন, কমিন, জমিন )

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৫:৩০



যাঁরা মুক্তিযদ্ধ করেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে লেখা তাঁদের পক্ষে মোটামুটি অসম্ভব কাজ। ১৯৭১ সালের মার্চে, কৃষকের যেই ছেলেটি কলেজ, ইউনিভার্সিতে পড়ছিলো, কিংবা চাষ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো, সেই ছেলেটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সাংঘাতিক উস্কানি মুলক আচরন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৪



কি সাঙ্ঘাতিক উস্কানিমুলক আচরন আমাদের রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর । নাহ আমি তার এই আচরনে ক্ষুব্ধ । ...বাকিটুকু পড়ুন

×