২০০৭ সালের ২২ আগস্ট ছাত্র-বিক্ষোভের ঘটনায় কারা নির্যাতিত শিক্ষক অধ্যাপক ড. আনোয়ার হোসেন তার ক্ষমা প্রার্থনার বিষয়ে বলেছেন, ২০ আগস্ট ছাত্ররা লাঞ্ছিত, অপমানিত ও রক্তাক্ত হয়েছিল। ঐতিহ্যবাহী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাধীনচেতা এই ছাত্র-ছাত্রীদের আত্মমর্যাদায় কঠিন আঘাত করা হয়েছিল। তাই বিক্ষুব্ধ হয়ে অন্যায়ের বিরুদ্ধে স্বতস্ফূর্তভাবে বিক্ষোভ করেছে তারা। ইউনিফরমধারী সেনা সদস্য লাঞ্ছিত হয়েছেন। একটি সেনাযান ভস্মীভূত হয়েছে। সেগুলো কারা করেছে তা আমি জানি না। তারপরও ছাত্র বিক্ষোভের ঘটনাকে কেন্দ্র করে তা হয়েছে। তাই ছাত্রদের অভিভাবক হিসেবে সম্মানিত জোয়ান থেকে শুরু করে সেনাপ্রধান পর্যন্ত সকলের কাছে আন্তরিকভাবে ক্ষমা প্রার্থনা করেছিলাম। সেনাবাহিনীর আহত মর্যাদাবোধের যেন দ্রুত নিরাময় হয়। গতকাল এ প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপকালে ড. আনোয়ার এসব কথা বলেন।
ড. আনোয়ার আরো বলেন, রিমান্ডে থাকাকালে আমি নিজে প্রস্তাব করেছিলাম এ বিষয়ে আমি কোর্টে বলব। তারা অবাক হয়েছিলেন। আমাকে অনুরোধ করেছিলেন, ইলেকট্রনিক মিডিয়ার সামনে আমার কথাগুলো বললে সেনাবাহিনীর বড় উপকার হবে। সারা দেশে সেনা সদস্যরা তা শুনতে পাবে। ভুল বোঝাবুঝির অবসান হবে। তিনি বলেন, আমি শর্ত দিয়েছিলাম, আমার মতো আমাকে বলতে দিতে হবে। তারা কথা দিয়েছিলেন তারা তা রক্ষা করবেন। কিন্তু আমার সঙ্গে প্রতারণা করা হয়েছিল। আমার সম্পূর্ণ বক্তব্য প্রচারে বাধা দেয়া হয়েছিল। আমার সেই উক্তি ‘সেনা সদস্যদের মতো শিক্ষক-ছাত্র-নাগরিক-সকলের আত্মমর্যাদা আছে, আর কখনো যেন তাতে আঘাত করা না হয়।’ তা প্রচার করা হয়নি। তিনি বলেন, আমার অপর বক্তব্য ‘সেনাবাহিনীর মূল দায়িত্ব ছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে দেশে অতি দ্রুত একটি গ্রহণযোগ্য, স্বচ্ছ, নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানে সহায়তা করা, যাতে নির্বাচিত বেসামরিক সরকারের হাতে দেশের শাসনভার হস্তান্তর করা যায় এবং সেনাবাহিনী গৌরবের সঙ্গে ব্যারাকে ফিরতে পারে’। কিন্তু তা বলার আগেই আমাকে ধাক্কা দিয়ে কোর্টে ঢুকিয়ে দেয়া হয়। দেশের মঙ্গলের জন্য সেনাবাহিনী যেন ছাত্র-শিক্ষক-জনতার প্রতিপক্ষ হিসেবে আর না আসে, ছাত্ররা যেন রক্ষা পায়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যেন রক্ষা পায়, সেই কারণে কোনো গ্লানিবোধ না করে একজন শিক্ষকের বিবেক ও সত্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত নীতিনিষ্ঠ সবল ও উচ্চতর অবস্থান থেকে আমি সেই ক্ষমা প্রার্থনা করেছিলাম। কিন্তু দেশবাসী জানেন আমার সে ক্ষমা প্রার্থনাকে তুচ্ছ জ্ঞান করা হয়েছে।
ড. আনোয়ার আরো বলেছেন, বর্তমান গণতান্ত্রিক সরকারের কাছে আবেদন উক্ত ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত শেষে অভিযুক্তদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে। যারা এই অন্যায়ের পেছনে ছিল যাদের প্ররোচনায় এটি হয়েছে তাদের চিহ্নিত করতে হবে। এটি প্রতিহিংসার ব্যাপার নয়, এটি একটি দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য করেতে হবে।
তিনি বলেছেন, আমাদের বিরুদ্ধে অন্যায়ভাবে মামলা দায়ের করা হয়েছিল। আমরা ন্যায় বিচার পাইনি। কারণ ওই সময় অবয়বহীন ভৌতিক সরকার দেশে ভুলের এবং ভয়ের শাসন কায়েম করেছিল। গ্রেফতার হওয়ার পরে কারাগরে রিমান্ডে নিষ্ঠুর নির্যাতনের বর্ণৃনা দিয়ে আনোয়ার হোসেন বলেন, আমাকে গ্রেফতার করে চোখ বেঁধে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে যায়। ডিজিএফআইয়ের ওই নির্যাতন কেন্দ্রে রিমান্ডে নেয়ার পর যখন কাউকে আবার কোর্টে হাজির করা হয়, তখন কি ভয়াবহ শারীরিক ও মানসিক বৈকল্যে ভুক্তভোগী নিপতিত হয় তা সত্যি অবর্ণনীয়। তথ্য আদায়ের নামে সেখানে যা যা করা হয়, তার সবই প্রয়োগ করা হয়েছিল। প্রথম, দ্বিতীয় এবং তৃতীয় ডিগ্রির নির্যাতনমূলক জিজ্ঞাসাবাদ- তার সবই চালানো হয়েছিল। চোখ বন্ধ অবস্থায় দিন রাতের হিসাব ছিল না। তিনি সংসদীয় কমিটির তদন্তের ব্যাপারে বলেন, বর্তমান সরকার আমাদের যৌথ আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে যে পুনঃ তদন্তের উদ্যোগ নিয়েছেন তাকে স্বাগত জানাই। এতে আমরা আনন্দিতও হয়েছি। আশা করি সঠিক বিষয়টি বের হয়ে আসবে।
২০০৭ সালের ২২ আগস্ট ছাত্র-বিক্ষোভের ঘটনায় অপর কারা-নির্যাতিত শিক্ষক বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ড. হারুন-অর-রশিদ বর্তমান নির্বাচিত সরকারের প্রতি আহ্বান রেখে বলেছেন, ছাত্রদের বিরুদ্ধে যে মামলা দায়ের করা হয়েছিল অবিলম্বে নিঃশর্তভাবে তা প্রত্যাহার করে নিতে হবে। এবং শিক্ষকদের বিরুদ্ধে যে মামলা দায়ের করা হয়েছিল তাতেও ন্যায় বিচার পাবেন বলে তিনি প্রত্যাশা করেন। তিনি বলেন, ২২ আগস্ট ঢাবিতে যে ঘটনা ঘটেছে সেটা অত্যন্ত দুঃখজনক, বেদনাদায়ক ও দুর্ভাগ্যজনক। সে ঘটনায় দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠের শিক্ষকদের গ্রেফতার করে চোখ বেঁধে রিমান্ডে নেয়া হয়েছে, নির্যাতন করা হয়েছে। যা বিশ্বের কোনো দেশে এ রকমের ন্যাক্কারজনক ঘটনা ঘটে নি।
তিনি বলেন, আমরা তখন বিপন্ন ছাত্রদের পাশে দায়বদ্ধতা থেকেই দাঁড়িয়েছিলাম এবং সেটা ক্যাম্পাসের ভেতরে থেকেই করেছি। আমরা কোনো অন্যায় করিনি। কিন্তু আমাদের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে। সে মামলার মধ্যে একটিতে খালাস পেয়েছি। অন্যটি প্রত্যাহার করা হয়েছে। আর অপরটিতে সাজা দেয়া হয়েছিল। তার বিরুদ্ধেই আপিল করেছেন শিক্ষকরা। তিনি বলেন, যখন এই রায় দেয়া হয়েছিল তখন বিচার বিভাগ প্রশ্নবিদ্ধ ছিল। আমরা ন্যায় বিচার পাইনি। এখন নির্বাচিত সরকার ক্ষমতায় রয়েছে, আশা করি ন্যায় বিচার পাব।
সেই সময়ের প্রেক্ষাপটে গতকাল আরো কথা বলেছেনÑ অধ্যাপক হারুন ও অধ্যাপক সদরুল আমিন। বর্তমান সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়ে অধ্যাপক হারুন বলেন, জনগণের বিপুল ম্যান্ডেট নিয়ে ক্ষমতায় এসেছে, তাই সরকারের উচিত হবে এগুলো নিয়ে বাড়াবাড়ি না করে দিন বদলের সনদের আলোকে দেশের উন্নয়নের লক্ষে কাজ করে যাওয়া। ক্ষমা চাওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, আমরা এখনও বলি আমরা কোনো অন্যায় করিনি। শিক্ষকদের ক্ষমা চাওয়ার প্রশ্নই আসে না। আমরা যা করেছি তা নৈতিক অবস্থান থেকেই করেছি।
এবিষয়ে অপর কারা নির্যাতিত শিক্ষক অধ্যাপক সদরুল আমিন বলেছেন, আমারা ২২ আগস্টে করাবরণ করেছি। আমরা কোনো অন্যায় করেনি। আমরা আমাদের অভিভাবকের দায়িত্ব থেকেই বিপন্ন ছাত্রদের পাশে দাঁড়িয়েছিলাম। তিনি আশা প্রকাশ করে বলেন, এই ন্যাক্কারজনক ঘটনার সঙ্গে যারা জড়িত সুষ্ঠু তদন্ত সাপেক্ষে তাদেরকে চিহ্নিত করতে হবে।

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




