১,
আমার দাদার বয়স ৮০ এর উপরে, উনি গত চার দিন ধরে ঢাকার আজমপুর এ Medical College for Women and Hospital এ ভর্তি আছেন। স্ট্রোক করেছেন ,কথা বলতে পারেন না, খেতে পারেন না কিন্তু বুঝতে পারেন সব। আমি উনার বড় নাতি, আমি গেলে উনি কিছুক্ষন তাকিয়ে থাকেন এবং এরপর কাঁদতে শুরু করেন। আমি যদি বলি,আবার আসব, উনি না বোধক মাথা নাড়েন,যার মানে “ না রে দাদা, আর তো দেখা হবে না রে”। একরকম শূন্যতা ভর করে আমার মাঝে, আমার মনে পরে উনি আমাকে হাঁটে নিয়ে যেতেন, মুরালি, মুরকি এবং নানা প্রকার মিষ্টি কিনে দিতেন, আমি খেতাম পেট ভরে। উনি সুর করে পুঁথি পড়তেন, সোহরাব-রুস্তম এর কাহিনি, অত্যন্ত হৃদয় বিদারক ঘটনা। হারিকেনের আলোয় চাদর মুড়ি দেয়া সেই দাদার ছবি এখনও আমার চোখে ভাসে, আমার মনে হয় এইত সেদিন, অথচ বিশ বছরের অধিক সময় পেরিয়ে গেছে, আমি আকারে বড় হয়ে গেছি। ভুলে গেছি দাদা আমাকে নিয়ে যেতেন কবি গানের আসরে অথবা সান্ধ্য-কালীন কোন দাওয়াতে। গরুর গোস্ত, মোটা চালের ভাত আর খাট্টা - অমৃতের মত লাগত। আমাদের গ্রামের বাড়ি চাঁদপুর এ , এখনও বিদ্যুৎ পৌঁছেনি, নদী থেকে খুব একটা দূরে নয় গ্রামটি। ছোটবেলায় গ্রামের বাড়িতে শুয়ে শুনতাম দূরে কোন স্টিমার এর পোঁ পোঁ আওয়াজ, সেই রাত গুলো এখন মনে হয় কোন দূরবর্তী অর্ধবিস্মৃত স্বপ্ন, এখনও আমাদের বাড়ির উঠানে সন্ধ্যে হলেই জোনাকি পোকারা আলো জ্বালায়, নারকেল গাছে ঝড়ের রাতে এখনও গা ছমছম করা শোঁ শোঁ শব্দ হয়, ঘর গুলির অবস্থা ভাল নয়। যদিও অনেক কিছুই আগের মত আছে কিন্তু সবই যেন বদলে গেছে, আমার দাদা এখন আমাদের আঁকড়ে থাকতে চান আরও কিছুদিন, আর আমি এখন পার করছি জীবনের বেঁধে দেয়া কঠিনতম সময়। আমার দাদা যখন ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে আমার দিকে , মনে হয় এত অল্প সময় নিয়ে কেন আসা এখানে একটা অনর্থক দৌড় প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে ? উনার জন্য সবাই দোয়া করবেন , আল্লাহপাক যেন উনাকে আরও অনেক বছর সুস্থ রাখেন।
২,
সাভারে যে ঘটনা তাতে আমার উপরের স্ট্যাটাস সময়োচিত নয়, কিন্তু এরপরও লিখলাম, একটি সময় সবার জন্য যে একই বার্তা বয়ে আনে না। যে মেডিকেল এর নাম উপড়ে উল্লেখ করেছি তারা কালো ব্যানারে শোক প্রকাশ করেছে আর ভেতরে নোটিস আছে রক্ত-দানের জন্য । আমি গেলাম রক্ত দিতে, ডাক্তার বললেন, আজকে উনাদের উয়িকলি হলিডে, ওয়ার্কিং ডে-তে রক্ত নেয়া হবে, এখানে আর কি বলা যেতে পারে!! আমি বলতে চাইলাম ভাই আপনারা কালকেও হলিডে-হানিমুন পালন করেন , সমস্যা নাই, রক্ত দেয়ার মানুষ অবশ্যই অনেক আছে এদেশে।পরে ভাবলাম একে বলে লাভটা কি? শুধু মাত্র ফেসবুক ব্যাবহার করে স্বেচ্ছা রক্ত, অর্থ ও অন্যান্য সামগ্রি দানের যে নজির এই প্রজন্ম দেখিয়েছে তা দেখে এত ধ্বংসের মাঝেও আশায় বুক বাঁধতে ইচ্ছা করে। আমাদের ত্রাণ ও দুর্যোগ মন্ত্রি এখন নিজের জেলায় গেছেন নির্বাচনী প্রচারণায়, অর্থ মন্ত্রির কাছে চার হাজার কোটি টাকা ব্যাপার না, অথচ টর্চ আর অক্সিজেন কেনার টাকার জন্য হন্যে হয়ে মেসেজে শেয়ার হচ্ছে সামাজিক যোগাযোগ সাইটে। লিখতে কখনো আমার এতটা কষ্ট হয়নি কিন্তু আজ আমি লিখতে পারছি না , বারে বারে মনে হচ্ছে আমার একটি পা আটকে আছে ইটের কংক্রিটে, হাতের ভিতর দিয়ে রড চলে গেছে। যারা নিজেদের প্রিয়জনদের ছবি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সন্ধানের আশায়, তারা কি তার প্রিয়জনদের ছবি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন ? তারা দাঁড়িয়ে আছেন চাপা পরা এক বাংলাদেশের ছবি নিয়ে, বলছেন আমার প্রাণটাকে আমার কাছে ফিরিয়ে দাও , নতুবা আমার আধপেটা, অনাহারী শরীরের অভিশাপ বইতে পারবে না, এই অভিশাপ বুকফাটা নিঃশ্বাসের অভিশাপ, আমার দেশমাতা কি তা শুনতে পায় !
৩,
আমি একটা ভিনদেশি সাপ্লাই চেইন এ কাজ করছি যাদের এদেশে একটা অফিস রয়েছে, এরা প্রায় ১০০ এর উপরে ফ্যাক্টরির সাথে কাজ করে , কম দামে পোশাক কিনে বেশি দামে বিক্রি- এই হচ্ছে সারাংশ। আমার সেই বিদেশী সহকর্মী আমাকে গতকালকে বলছিল, “ দিস কাইন্ড অফ ইন্সিডেন্ট বিকামিং নরমাল ইন ইউর কান্ট্রি” এবং সে আরও জিজ্ঞেস করছিল ইফ হি উইল গেট হিজ গুডস অন টাইম। আমার মনে হয়েছিল কেউ একজন ছুরি দিয়ে আমার পিঠ চিড়ে ফেলেছে। সে ঠিকই বলছে , আমরা তো এভাবেই মরি- লঞ্চ ডুবে, হরতালে পিকেটিং এ, আগুনে পুরে, দালান ধসে , এইত আমরা , এইত আমাদের নিয়তি। সোনায় মোড়ানো বাংলা মোদের শ্মশান করেছে কে ? – পাকিস্থানিরা তো নেই এখন । আমি জানতে চাই কে ? কে ? কে?
৪,
কাজের সুবাদে আমার প্রতিনিয়ত ফ্যাক্টরি গুলোতে যেতে হয়, আমি অনেক গুলি কারখানার নাম বলতে পারব যাদের কমপ্লাইয়ান্স (কাজের জন্য সঠিক এবং মানসম্মত মাপকাঠি) ঠিক নেই , কিন্তু কাজের কাজ কিছুই কি হচ্ছে। ইচ্ছে করলেই সরকার এ সকল কারখানা চিহ্নিত করতে পারে এবং ব্যাবস্থা নিতে পারে, কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে কিছুই হবে না, আবার দালান ধসবে , দুই দল দুজনকে দায়ি করবে এবং কিছুদিন পরে ভুলে যাবে। তাছাড়া এরা গরিব মানুষ , বিশ হাজার টাকা ধরিয়ে দাও, ঝামেলা শেষ। যে কারখানাটি ধসে গেছে আমি সেখানে কয়েকদিনের মধ্যে যাওয়ার পরিকল্পনা করছিলাম, আজকে আমিও চাপা পরতে পারতাম, যদি পরতাম তাহলে আমার বাবা-মা, স্ত্রী ছাড়া আর কারুর কিছুই হত না, হয়ও না। আমি দুর্বল , তাই এই একটি দোয়া আল্লাহর দরবারে, মৃত্যু অবধারিত। কিন্তু এরকম মৃত্যু যেন আর না আসে, অন্তিম সময়ে কাছের মানুষের যেন একটু স্নেহ – ভালবাসার স্পর্শ পাওয়া যায়। আর যেন শুনতে না হয় , “ দিস কাইন্ড অফ ইন্সিডেন্ট বিকামিং নরমাল ইন ইউর কান্ট্রি”।