somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আমি বৈজ্ঞানিক

০৫ ই সেপ্টেম্বর, ২০০৯ রাত ১২:২০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

প্রাইমারী স্কুলে পড়ি তখন। হাতে এল একটা বই। বিজ্ঞানের মজার খেলা। কিযে দারুন সব বিষয় ছিল তাতে! সামান্য সব জিনিষ দিয়ে বিজ্ঞানের মজার মজার সব এক্সপেরিমেন্ট। সেই থেকে বিজ্ঞানের প্রতি আগ্রহটা আরও তীব্র হল।

অপর দিকে, আমার নানা রকম এক্সপেরিমেন্টএ বাসার সবাই ব্যাতিব্যাস্ত হয়ে উঠলো। পানি থেকে লবন আলাদা করতে গিয়ে ভেঙ্গে ফেললাম মামুন মামা’র সব টেস্টটিউব, রেডিও শুনতে গিয়ে বড় ভাইয়া কানে খেল তারের খোঁচা, ছোট কাকার জামায় পারমানেন্ট হল আমার ভ্যানিশিং কালার... কিন্তু সবার চোখ এড়িয়ে আমি বিজ্ঞানের সেবায় নিয়োজিত। স্বপ্ন দেখি আইনস্টাইন হব :)

এমনি করে সময় কিভাবে পাড় হয়ে গেল! তখন ক্লাশ নাইন এ উঠেছি। ক্লাশে স্বাভাবিক ভাবেই বিজ্ঞান বিভাগ নিলাম। আমি আর রুশো (আমার সকল কর্ম ও অপকর্মের সঙ্গী, বাচপান কি দোস্ত) মিলে ওর বাসায় গড়ে তুললাম আমাদের ল্যাব। কি ছিলোনা ওই ল্যাব এ! ম্যাচের বারুদ থেকে শুরু করে টিকটিকির ফসিল পর্যন্ত!! :D

আমাদের সময় বিজ্ঞান বইএ ছিল ‘এসো নিজে করি’ নামক প্রকৃয়া। সবই প্র্যাকটিক্যাল এর আদলে লিখা। কিন্তু এসএসসি’র আগে দু-এক দিন ছাড়া আর কখনো স্কুলের ল্যাব এ আমাদের নিয়ে গিয়েছে কিনা সন্দেহ। সে কারণে আমাদের ল্যাব প্রীতি ক্রমাগত বেড়েই চললো। অন্ধকারে কুকুরের মুখে ফসফরাস মেখে ছেড়ে দেয়া থেকে শুরু করে সাবমেরিন বানানো (ড্রাম, পাম্প আর হোসপাইপ সহযোগে তৈরী এক কিম্ভুত যান, যেটায় করে সত্যি সত্যি আমরা পুকুরের নীচে ডুব দিয়ে কাঁকড়া আর চিংড়ির বাসা খুঁজে বেড়াতাম। আফসুস এই দেশ এমন বিজ্ঞানীদের চিনলোনা - চিক্কুরইমো), এমন সকল কুকর্মের উৎস হয়ে উঠেছিল এই ল্যাব। অসংখ্য কাহিনী আছে এই ল্যাবকে ঘিরে। এ কারণে স্কুলে সবাই আমাদের ডাকতো ‘বৈজ্ঞানিক’ বলে। তবে আজ বলছি এর যবনিকার কথা।

মিড টার্মের আগে বায়োলজি’র গফুর স্যার বললেন সবাইকে কয়কে ধরনের পাটের পোকা আর ব্যাঙ এর কঙ্কাল জমা দিতে হবে ক্লাশে। সবার তো আক্কেল গুড়ুম! সাথে সাথে প্রতিবাদের ঝড়। কেবল আমি আর রুশো উঠে দাড়ালাম। অমনি সহপাঠিদের রক্তচক্ষু আমাদের দিকে, কিন্তু বিজ্ঞানের জন্য আত্মনিবেদিত আমরা সেসব উপেক্ষা করে একান ওকান হাসি দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম – ‘স্যার, ব্যাঙ না হয় ধরলাম, কিন্তু কঙ্কাল বানাবো কি করে?’

স্যার বললেন – ‘ব্যাঙ ধরে সেটাকে মারার পর মাটির হাঁড়িতে করে মাটিতে পুঁতে রেখে দিবি ১০-১২ দিন। ততদিনে ব্যাঙ পচে মাংস নরম হয়ে যাবে। এরপর সেটাকে তুলে চিমটা দিয়ে মাংস আলাদা করে হাড় গুলো সংগ্রহ করবি। তারপর ফরমালিন এ ভিজিয়ে শুকানোর পর আঠা দিয়ে জোড়া দিবি এক এক করে।’

পচা ব্যাঙ!!! যতই নিবেদিত প্রাণ হইনা কেন, স্যারের কথায় দমে গেলাম। আর ওদিকে গোটা ক্লাশ আমার দিকে তাকিয়ে দাঁত কেলিয়ে হাসছে। আমি আবারো জিজ্ঞেস করলাম, ‘স্যার, আর কোন উপায় নেই?’ স্যার মনে হয় আমার করুন অবস্থা বুঝতে পারছিলেন। একটু চিন্তা করে বললেন, আরেকটা উপায় আছে, ব্যাঙটা অনেকক্ষন ধরে সেদ্ধ করে নিতে পারিস। এতে করে মাংস নরম হবে, তারপর না হয় হাড় আলাদা করবি।
এইবার খানিকটা সাহস পেলাম। গন্ধতো আর লাগবেনা, সুতরাং বাকীটা খুব একটা কঠিন মনে হলনা। আড়চোখে চাইলাম রুশো’র দিকে, ওর চোখেও সম্মতি। সাহস করে বলে ফেললাম যে কালই আমরা ব্যাঙ এর কঙ্কাল জমা দিচ্ছি ক্লাশে।

স্কুল ছুটি হতেই আমাদের গোপন ডেরায় বসে প্ল্যান করে ফেললাম। পরদিন এহেন মহান কর্মের কারণে স্কুলে ফাঁকি দেব এবং পরদিন সকালে দু’জনই রওনা হলাম আট পুকুরে ব্যাঙ শিকারে। সাথে প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম। আমাদের খুব বেশী কাঠখড় পোড়াতে হল না সাফল্যের মুখ দেখতে। জারে করে ৩ টা তরতাজা ঘ্যাঘর সন্তান সহযোগে আমরা ফিরে এলাম। অনেক জটিল পরীক্ষা নিরীক্ষা’র পর একটাকে আমাদের উদ্দেশ্য হাসিলের নিমিত্তে শহীদ হবার জন্য মনোনীত করা হল। বাকী দুটো ব্যাঙকে ছেড়ে দিলাম। আর নির্ধারিত ব্যাঙটাকে ক্লোরোফর্ম দিয়ে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয়া হল (পাঠকগণ আমার নিষ্ঠুরতা ক্ষমা করবেন প্লীজ)।

এরপর স্যারের কথা পইপই করে অনুসরন করে একটা পানি ভর্তি মাটির হাড়িতে করে মৃত ব্যাঙটাকে সেদ্ধ করতে দিলাম। কাজটা করা হচ্ছিল আমার বাসায়। কেননা আব্বু-আম্মু দু’জনেই কর্ম সুবাদে বাসার বাইরে। আর ছোট দু’ ভাই আমার মার খাবার ভয়ে কিছু বলবে না।

যেহেতু এটা সময় সাপেক্ষ মিশন, রুশো তাই পরে আসবে বলে চলে গেল বাসায়। আমি কিছুক্ষন বসে রইলাম রান্না ঘরে। তারপর হঠাৎ মনে হল এমনি এমনি বসে না থেকে বই পড়ি না কেন। নতুন কিনে আনা জুলভার্ন এর ‘ক্যাপ্টেন হ্যাটেরাস’ তখনো পড়া হয়নি। লিভিং রুমের সোফায় শুয়ে শুয়ে ক্যাপ্টেনের সাথে এ্যাডভেঞ্চার শুরু করলাম। কিছুক্ষন পর ছাদে চলে এলাম। ওটা ছিল আমার বই পড়ার জন্য প্রিয় যায়গা (সেই গল্প আরেক দিন হবে)। কাহিনী’র উত্তেজনায় আমি বুঁদ হয়ে আছি। ছোট ভাই এসে ডাক দিল – ‘ভাইয়া!’ আমি তখন বরফের মাঝে আটকে যাওয়া জাহাজ উদ্ধারে ব্যস্ত। তাকাবার সময় পর্যন্ত নেই। কেবল হাত নেড়ে বুঝিয়ে দিলাম –ভাগ এখন।

জাহাজ উদ্ধারের পর উত্তর মেরুর সেই লোমহর্ষক অভিযান.... থার্মোমিটারের পারদ দিয়ে গুলি বানিয়ে ক্যাপ্টেন হ্যাটেরাসের মেরু ভাল্লুক শিকার.... বাইরে প্রচন্ড তুষার ঝড় আর বরফের ঘরের ভেতর বসে আগুন জ্বালিয়ে আটকে পড়া অভিযাত্রী’র দল ... চিমনী দিয়ে বের হচ্ছে ধোঁয়া... একি! চিমনী’র ধোঁয়া এখানে এলো কি করে? আবারো ‘ভাইয়া!!’ এবার আরেকটু জোরে...এদিকে তাকাতেই দেখি ছোটভাই দাড়িয়ে আছে ভয়ার্ত মুখে। কি যেন মনে পড়লো... অমনি দে ছুট.....

ইলেকট্রিক হীটারের উপড় হাড়িটার সব পানি শুকিয়ে গেছে, তার উপড় পুড়ে পুরো কয়লা হয়ে গেছে আমার এত সাধের.....ব্যাঙটা। কালো ধোঁয়ার আচ্ছাদনে ঘরের অনেকটুকুই দেখা যাচ্ছে না। আমি কোন রকমে হীটারটা বন্ধ করে বের হয়ে এলাম।

আমি জানি, বিজ্ঞানীরা ব্যর্থ গবেষণা গোপন করে। তাই কেউ কাউকে কিছু বলেনি; তবুও কি করে যেন এই বার্তা সেই কালো ধোঁয়ায় ভর করে পরদিন স্কুল অবধি পৌঁছে গিয়েছিল।

সেদিন স্কুলে গিয়ে ক্লাশে ঢুকতেই সবাই সমস্বরে স্বাগত জানালো নতুন বিশেষণে – ‘ব্যাঙ বৈজ্ঞানিক’

আপডেটঃ এখনো আমি আর আরিফ মাস্টর রিমোট কন্ট্রোলড্ প্লেন বানাই আর উড়াই। কি যে মজা!! :)
২৪টি মন্তব্য ২৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

জামাত কি দেশটাকে আবার পূর্ব পাকিস্তান বানাতে চায়? পারবে?

লিখেছেন ঋণাত্মক শূণ্য, ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৭:২৮

অন্য যে কোন সময়ে জামাতকে নিয়ে মানুষ যতটা চিন্তিত ছিলো, বর্তমানে তার থেকে অনেক বেশী চিন্তিত বলেই মনে করি।



১৯৭১ এ জামাতের যে অবস্থান, তা নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের অস্তিত্বের বিরুদ্ধে... ...বাকিটুকু পড়ুন

১৯৭১ সালে পাক ভারত যুদ্ধে ভারত বিজয়ী!

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৯


দীর্ঘ ২৫ বছরের নানা লাঞ্ছনা গঞ্জনা বঞ্চনা সহ্য করে যখন পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বীর বাঙালী অস্ত্র হাতে তুলে নিয়ে বীরবিক্রমে যুদ্ধ করে দেশ প্রায় স্বাধীন করে ফেলবে এমন সময় বাংলাদেশী ভারতীয়... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইন্দিরা গান্ধীর চোখে মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশ-ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক: ওরিয়ানা ফলাচির সাক্ষাৎকার

লিখেছেন শ্রাবণধারা, ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১১:৫৫


১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ইতালীয় সাংবাদিক ওরিয়ানা ফলাচি ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সাক্ষাৎকার নেন। এই সাক্ষাৎকারে মুক্তিযুদ্ধ, শরনার্থী সমস্যা, ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক, আমেরিকার সাম্রাজ্যবাদী পররাষ্ট্রনীতি এবং পাকিস্তানে তাদের সামরিক... ...বাকিটুকু পড়ুন

=যাচ্ছি হেঁটে, সঙ্গে যাবি?=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সন্ধ্যা ৭:০৬


যাচ্ছি হেঁটে দূরের বনে
তুই কি আমার সঙ্গি হবি?
পাশাপাশি হেঁটে কি তুই
দুঃখ সুখের কথা ক'বি?

যাচ্ছি একা অন্য কোথাও,
যেখানটাতে সবুজ আলো
এই শহরে পেরেশানি
আর লাগে না আমার ভালো!

যাবি কি তুই সঙ্গে আমার
যেথায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

আগামী নির্বাচন কি জাতিকে সাহায্য করবে, নাকি আরো বিপদের দিকে ঠেলে দিবে?

লিখেছেন জেন একাত্তর, ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৮:১২



আগামী নির্বচন জাতিকে আরো কমপ্লেক্স সমস্যার মাঝে ঠেলে দিবে; জাতির সমস্যাগুলো কঠিন থেকে কঠিনতর হবে। এই নির্বাচনটা মুলত করা হচ্ছে আমেরিকান দুতাবাসের প্রয়োজনে, আমাদের দেশের কি হবে, সেটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

×