somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বাবা

১৬ ই ডিসেম্বর, ২০১৫ সকাল ৭:১১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

লিখেছেন: Muhammad Masih Ullah, তার মুক্তিযোদ্ধা বাবাকে নিয়ে, যিনি মুক্তিযুদ্ধকে পণ্য বানান নি। হৃদয়স্পর্শী লেখা। ফেসবুক থেকে প্রাপ্ত। আল্লাহ তায়ালা লেখককে জাযাখায়ের ও হায়াতে তাইয়্যিবা দান করুন।

এক

বাবা সদ্য পশ্চিম পাকিস্তান থেকে ছুটিতে বাড়ি এসেছেন। ঢাকা থেকে বাড়ি ফেরার পথে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে। সারাদেশে কারফিউ চলছে। বিভিন্ন মালবাহী গাড়িতে কোনমতে গা ঢুকিয়ে দিয়ে অনেক কষ্টে বাড়ি ফেরা। করাচীতে সম্ভবত আর ফেরা হবে না। উত্তাল মার্চ। চারিদিকে যুদ্ধ যুদ্ধ পরিস্থিতি। বাবা রাজনীতিসচেতন একজন মানুষ। দেশের প্রয়োজনে অস্ত্র ধরার জন্যে এলাকার যুবকেরা তৈরি। বাবার ঘাড়ে দায়িত্ব চেপেছে এলাকার যুবকদের সংগঠিত করার। হাটহাজারী, ফটিকছড়ি ও রাউজানের প্রত্যন্ত এলাকা থেকে ছেলেরা আসছে। দাদা অনেক জমিজমার মালিক। বছর শেষে ধানের গোলা ভর্তি হয়ে যায়। যুদ্ধরত যুবকদের জন্য প্রতিদিনই বড় বড় পাত্রে ভাত রান্না হচ্ছে। আমাদের কাছারিঘরে লাইন ধরে যুবকরা কোন তরকারি ছাড়াই ভাত খেয়ে যায় । আমাদের এদিকে পাক আর্মি এখনও নামে নি। নাজিরহাট হালদা ব্রীজ ভেঙ্গে ফেলা হয়েছে, যেন তারা তাদের বড় বড় গাড়ি নিয়ে এদিকে আসতে না পারে। হাটহাজারীতে ও রাউজানে ওরা ক্যাম্প করেছে বলে খবর এসেছে। বাবা কোথায় কোথায় চলে যান। মাঝে মাঝে হঠাৎ করে উদয় হন। বলেন, পঞ্চাশ জনের জন্য ভাত রেডি কর। মা ও চাচী ভাত পাকাতে থাকেন। তরকারি ছাড়াই ভাত খেয়ে মুক্তিযোদ্ধারা চলে যায়। রাজাকাররা নাপিত পাড়া আক্রমন করবে বলে খবর এসেছে। মুক্তিযোদ্ধারা পাহারা বসিয়েছে।

শোনা যাচ্ছে, নানুপুরের দিকে পাক আর্মি প্রবেশ করেছে। সেই থেকে মা চাচীদের মধ্যে আতঙ্ক কাজ করে। মা ও চাচীকে মুখে কালি মেখে রাখতে হয়। ইজ্জ্বত আবরুর হেফাজত তো করতে হবে। মাঝখানে দুয়েকদিনের জন্য মাকে বাবার খালার বাড়িতে রেখে এসেছেন বাবা। বাবাকে সবসময় সতর্ক থাকতে হয়। মুক্তিযোদ্ধা সংগঠক হিসেবে রাজাকারদের লিস্টে তার নাম উঠে গেছে।

অক্টোবরের দিকে যুদ্ধে যাওয়ার জন্যে পালিয়ে এসেছে পনের বছরের একটা ছেলে। বাবা তাকে জিজ্ঞেস করে জেনেছেন, সে কাটিরহাট হাই স্কুলের ফার্স্টবয়, কাটিরহাটের জামাল সওদাগরের ছেলে। ছেলেটিকে কৌশলে একটা কামরায় তালাবদ্ধ করে রেখেছেন বাবা। না, এই মেধাবী ছেলেটাকে যুদ্ধে পাঠানো যাবে না। পরদিন অনেক কষ্টে এক চাচাকে দিয়ে তাকে বাড়িতে ফেরত পাঠিয়েছেন বাবা। ( পরবর্তীতে ছেলেটি কাটিরহাট হাই স্কুল থেকে বোর্ড স্ট্যান্ড করেছিল।)

চারিপাশ থেকে বিজয়ের খবর আসছে। বিজয়ের আর খুব বেশি বাকী নেই।

যুদ্ধ শেষ। দেশ স্বাধীন হয়ে গেছে। বাবা সমস্ত সার্টিফিকেট করাচী রেখে এসেছেন। স্থানীয় পার্লামেন্ট সদস্য খবর পাঠিয়েছেন, বাবা যেন ঢাকা গিয়ে তার সাথে দেখা করেন। বাবাকে বলা হয়েছে, বিহারীদের ফেলে যাওয়া এক ফ্যাক্টরীর ম্যানেজার হতে। বাবা অস্বীকার করে বললেন, আগেও সরকারী চাকুরে ছিলাম এখনও তাই করব, এসব ম্যানেজারগিরি আমাকে দিয়ে হবে না।

বাবা ল্যান্ড কাস্টম্স এ জয়েন করেছেন। দূনীতিগ্রস্থ আমলাতন্ত্র দেখে বাবা হতাশ। নিয়ত করেছেন, কোন অবৈধ সুবিধা ভোগ করবেন না। কোন দূর্নীতিকে প্রশ্রয় দেবেন না। বাবা প্রায়ই বলতেন, এজন্য তো মুক্তিযুদ্ধ করিনি। যখন চাকরীতে জয়েন করেছেন, তখন থেকেই রাজনীতি ছেড়ে দিয়েছেন। সবাই মুক্তিযোদ্ধার কার্ড বানাচ্ছে। বাবা নির্বিকার। কোন কার্ড বানাবেন না। কোন সুবিধা নিবেন না।

বাবা চাকরী থেকে রিটায়ার্ড করেছেন। সামান্য পেনশনে সংসার ও আমাদের লেখাপড়া চলছে। ভূয়া মুক্তিযোদ্ধারাও ভাতা পাচ্ছে। মা মাঝে মাঝে কার্ড করার জন্য বলেন। বাবা রেগে যান। ছোটভাই মাত্র এক নম্বরের জন্য ইউনিভার্সিটিতে টিকে নি। তার আফসোস, “বাবা যদি মুক্তিযোদ্ধা কার্ড বানাতেন, আমার কাজে আসত।” বাবা রেগে বলেন, “তোর যোগ্যতা দিয়ে টিকলে টিকবি। আমি সুবিধাভোগীদের দলে যোগ দিতে পারব না।” দেশের রাজনীতির প্রসংগ উঠলে বাবা খুব পেরেশান হয়ে যেতেন। প্রত্যাশা আর প্রাপ্তির মাঝে বিরাট ব্যবধান দেখে কেবলই আফসোস করতেন। যখন বাবা মারা গেলেন, কেউ বলছিল, মুক্তিযোদ্ধা সংসদে খবর দাও, যেন রাস্ট্রীয় মর্যাদায় দাফন করা হয়। আমি সাফ বলে দিলাম, কোন দরকার নেই। জীবিত অবস্থায় যিনি কোনদিন কোন সুবিধা নিতে চান নি, এখন মৃত্যুর পর আমি তার বিপরীত কিভাবে করব? তাছাড়া মৃত্যুর পর দাফন কাফনের মধ্যে শরীয়তের গন্ডির বাইরে কিছুই করতে দেবো না। যে স্থানীয় নেতা খুব উৎসাহের সাথে এসব করতে চাচ্ছিল, আমার কথায় সে চুপসে গেল।

বাবা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কোন অনুষ্ঠানে কখনও অংশগ্রহণ করেন নি। মুক্তিযোদ্ধা সংগঠক হিসেবে যত দাওয়াতনামা আসত, সব অবহেলায় পড়ে থাকত।

প্রথমে না বুঝলেও পড়ে বুঝতাম, বাবা যা কিছু করেছেন, দেশের স্বার্থে ইখলাসের সাথে করেছেন। কোন বিনিময় না নেয়া এটাই তো ইখলাস।

বাবা, আজ বিজয় দিবস। তোমাকে আজ খুব বেশি মনে পড়ছে।

দুই

বাবাকে কোনদিন চেতনা টেতনা নিয়ে কথা বলতে শুনিনি। মাঝে মাঝে তার করাচীতে চাকরী করার সময়ের বিভিন্ন গল্প শুনতাম। পাকিস্তানীদের প্রতি কোন জাতিগত বিদ্বেষ তার কথার মাঝে পাওয়া যেত না। বরাবরই ইন্ডিয়ার বিভিন্ন আগ্রাসী নীতির বিরোধিতা তার আলোচনায় ফোটে উঠত। বিশেষ কোন রাজনৈনিক আদর্শ লালন করতেন না। তারপরও বাবা কোন সময়ই আমাদের গ্রামে ভোট দিতে পারতেন না। তার ভোট নাকি অন্যরা দিয়ে দিত। বাবা কেন্দ্র থেকে পেরেশান হয়ে ফিরে আসতেন। এলাকায় সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে সব সময় সোচ্চার কনঠ ছিলেন। সন্ত্রাসীদের সামনেও সরাসরি বলে ফেলতেন। সারা জীবন সরকারী চাকরী করেছেন। কোন রাজনৈতিক প্রোগ্রামে যোগ দিতেন না। রাজনৈতিক নেতাদের একপ্রকার ঘৃনাই করতেন। ঐ সময় অনেকটা নিরুপায় হয়েই যুদ্ধে নেমেছেন। জাতির পক্ষে যুদ্ধে নামাটাকেই বাবা ঐ সময় করনীয় মনে করেছেন। কোন বিশেষ ব্যক্তি বা দলের অনুগত হিসেবে নয়।

___________

১৬/১২/২০১৪
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই ডিসেম্বর, ২০১৫ সকাল ৭:২৬
১টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শ্রমিক সংঘ অটুট থাকুক

লিখেছেন হীসান হক, ০১ লা মে, ২০২৪ সকাল ৯:৪৮

আপনারা যখন কাব্য চর্চায় ব্যস্ত
অধিক নিরস একটি বিষয় শান্তি ও যুদ্ধ নিয়ে
আমি তখন নিরেট অলস ব্যক্তি মেধাহীনতা নিয়ে
মে দিবসের কবিতা লিখি।

“শ্রমিকের জয় হোক, শ্রমিক ঐক্য অটুট থাকুক
দুনিয়ার মজদুর, এক হও,... ...বাকিটুকু পড়ুন

কিভাবে বুঝবেন ভুল নারীর পিছনে জীবন নষ্ট করছেন? - ফ্রি এটেনশন ও বেটা অরবিটাল এর আসল রহস্য

লিখেছেন সাজ্জাদ হোসেন বাংলাদেশ, ০১ লা মে, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৪

ফ্রি এটেনশন না দেয়া এবং বেটা অরবিটার


(ভার্সিটির দ্বিতীয়-চতুর্থ বর্ষের ছেলেরা যেসব প্রবলেম নিয়ে টেক্সট দেয়, তার মধ্যে এই সমস্যা খুব বেশী থাকে। গত বছর থেকে এখন পর্যন্ত কমসে কম... ...বাকিটুকু পড়ুন

প্রতিদিন একটি করে গল্প তৈরি হয়-৩৭

লিখেছেন মোঃ মাইদুল সরকার, ০১ লা মে, ২০২৪ দুপুর ১২:৫১




ছবি-মেয়ে ও পাশের জন আমার ভাই এর ছোট ছেলে। আমার মেয়ে যেখাবে যাবে যা করবে ভাইপোরও তাই করতে হবে।


এখন সবখানে শুধু গাছ নিয়ে আলোচনা। ট্রেনিং আসছি... ...বাকিটুকু পড়ুন

একাত্তরের এই দিনে

লিখেছেন প্রামানিক, ০১ লা মে, ২০২৪ বিকাল ৫:৩৬


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

আজ মে মাসের এক তারিখ অর্থাৎ মে দিবস। ১৯৭১ সালের মে মাসের এই দিনটির কথা মনে পড়লে এখনো গা শিউরে উঠে। এই দিনে আমার গ্রামের... ...বাকিটুকু পড়ুন

হুজুররা প্রেমিক হলে বাংলাদেশ বদলে যাবে

লিখেছেন মিশু মিলন, ০১ লা মে, ২০২৪ রাত ৯:২০



তখন প্রথম বর্ষের ছাত্র। আমরা কয়েকজন বন্ধু মিলে আমাদের আরেক বন্ধুর জন্মদিনের উপহার কিনতে গেছি মৌচাক মার্কেটের পিছনে, আনারকলি মার্কেটের সামনের ক্রাফটের দোকানগুলোতে। একটা নারীর ভাস্কর্য দেখে আমার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×