প্রতারণার মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়ার নতুন ফাঁদ বসিয়েছে গ্রামীণফোন। টেলিভিশন ও পত্রিকায় চমকপ্রদ নানা সুযোগ সুবিধার কথা বলে নকল ও নিম্নমানের মোবাইল সেট দিয়ে গ্রামীণফোন গ্রাহকদের সাথে প্রতারণায় নেমেছে। চায়না এবং জিঞ্জিরায় তৈরি (দেশীয়) এসব মোবাইল সেট এখন গ্রামীণফোনের প্যাকেজ হিসেবে বাজারজাত করা হয়েছে! অভিযোগ উঠেছে, নতুন মোড়কে পুরনো সেট বাজারজাত করছে গ্রামীণফোন। অতি নিপুণভাবে প্যাকেটিংয়ের কারণে সাধারণ গ্রাহকরা আসল-নকল শনাক্ত করতে পারছেন না।
জানা গেছে, গ্রামীণফোন খুব কম টাকায় চীনের একটি প্রতিষ্ঠানকে মোবাইল সেট তৈরি করে দিতে বলে। অনেকগুলো সুযোগ-সুবিধার কথা বলে খুবই নিম্নমানের যন্ত্রাংশ দিয়ে তৈরি হয়েছে গ্রামীণ ফোনের এসব মোবাইল সেট। অথচ তারা এসব মোবাইল সেট বিক্রি করছে চড়া দামে। মোবাইল সেটের ওপরে গ্রামীণফোনের লগো ব্যবহার করে নিজস্ব প্রোডাক্ট বলে সুবিধা নিচ্ছে তারা। এসব সেট আসল না নকল তা বুঝার কোন উপায় নেই। অভিযোগ আছে, অনেক মোবাইল সেটের কেচিংটা পরিবর্তন করে দেশে তৈরি এসব মোবাইল সেট নিজেদের বলে চালিয়ে যাচ্ছে গ্রামীণফোন। ওয়ারেন্টি এক বছর বলা হলেও মোবাইল সেটগুলো খুবই নিম্নমানের বলে মন্তব্য করেছেন সেট আমদানিকারক অধিকাংশ প্রতিষ্ঠান এবং বিভিন্ন মার্কেটের মোবাইল দোকানদাররা। তারা বলছেন, এসব সেটের দাম ১৫০০ থেকে ২০০০ টাকার বেশি কোন ক্রমেই হতে পারে না। তারা বলছেন, গ্রামীণফোন নিম্নমানের এসব সেট বাজারে ছাড়ার কারণে বাংলাদেশ উন্নত দেশের ডাম্পিং স্টেশনে পরিণত হচ্ছে। গ্রামীণফোনের এসব সেটগুলো নিম্নমানের বলে অভিযোগ আসলেও বিটিআরসি নীরব ভূমিকা পালন করছে।
মোবাইল ফোন আমদানিকারক সমিতির সাধারণ সম্পাদক ফয়সাল আমিন বলেন, আমাদের পক্ষ থেকে নকল ও নিম্নমানের মোবাইল সেট বাজারজাত করার ব্যাপারে সরকারকে বেশ কয়েকটি সুপারিশ দিয়েছি। আমরা বলেছি, প্রত্যেকটা সেটের পেছনের অংশে হলোগ্রাম লাগাতে হবে। কিন্তু কেউই এটা মানে না। এ ছাড়া সরকারকে মাঝে মধ্যে বাজার মনিটরিং করতে হবে। তাহলে নকল সেট বাজারজাত বন্ধ করা সম্ভব হবে। বড় প্রতিষ্ঠান হিসেবে গ্রামীণফোন হলোগ্রাম ব্যবহার করে কিনা জানতে চাইলে ফয়সাল আমিন বলেন, তারাও ব্যবহার করে না। গ্রামীণফোনের মোবাইল সেটগুলো চায়নার তৈরি বলে তিনি জানান। সেটগুলোর মান কি রকম, এ ব্যাপারে কিছু জানেন কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, শুনেছি ভালো। এর বাইরে আর কিছুই জানি না।
নগরীর ইস্টার্ণ প্লাজা, মোতালেব প্লাজা, স্টেডিয়াম মার্কেট, নাহার প্লাজাসহ বিভিন্ন মার্কেটে মোবাইল ব্যবসায়ীর সাথে আলাপকালে তারা বলেন, চীনের তৈরি নিম্নমানের হ্যান্ডসেটে বাজার সয়লাব হয়ে গেছে। এসব সেটের বেশির ভাগই মানহীন হওয়ায় ক্রেতারাও স্বাভাবিকভাবে প্রতারিত হচ্ছেন। গ্রাহকরা বুঝতে পারেন না, কোন ব্রান্ডের সেট ভালো আর কোনটি খারাপ। তারা সব সময় কম দামে কিনতে চায়। তারা বলেন, গ্রামীণফোন যে সেটটি এখন গ্রাহকদের দিচ্ছে তা খুবই নিম্নমানের। চমকপ্রদ বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে তারা গ্রাহকদের প্রতারিত করছে। তারা আরও বলেন, অন্য যে সব মোবাইল প্রতিষ্ঠান সেটসহ অফার দিয়েছে তাদের মোবাইল সেটগুলো ব্রান্ডের। এসব সেটের উপর নির্ভর করা যায়। এ ছাড়া তারা তাদের সিম ব্যবহার করার উপরও অনেক ক্ষেত্রে জোর দিয়ে থাকে। যদি মোবাইল সেট ভালো না হত তাহলে তারা তা করতো না। তারা বলেন, গ্রামীণফোন তাদের সিম ব্যবহারের উপর কোন বাধ্যবাধকতা রাখেনি। তাদের টার্গেট হচ্ছে সেট বিক্রি করা। যেহেতু এখন ২০ শতাংশ মোবাইল ব্যবহারকারী সেট পরিবর্তন করে অথবা একাধিক সেট ব্যবহার করে, তাই সে সুযোগটা নিতে চাচ্ছে গ্রামীণফোন।
বিটিআরসি'র হিসাব মতে এখন দেশে মোবাইল ব্যবহারকারীর সংখ্যা প্রায় ৪ কোটি। এর মধ্যে এখন অনেকেই একাধিক মোবাইল সেট ব্যবহার করছেন। এ হিসাবে প্রতি মাসে দেশে মোবাইল সেটের চাহিদা প্রায় ৮ লাখ। এসব সেটের অধিকাংশই আসে অবৈধ পথে। আবার বিভিন্ন দেশের মোবাইল সেটের অবিকল তৈরি হচ্ছে বাংলাদেশে। মোবাইল সেট আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলো জানিয়েছে, দেশে গ্লোবাল ৫টি ব্রা্যন্ডের সেট বাদে বাকি সবই নিম্নমানের। নকিয়া, সনি এরিকসন, মটোরোলা, স্যামসং এবং এলজি'র বাইরে অন্য সেটগুলো খুবই নিম্নমানের। এগুলোর বাইরে আসা অন্য সেটগুলোর স্থায়িত্ব এক বছরেরও কম। অনেকে আবার অপরিচিত এসব ব্রান্ডের সেটের ওয়ারেন্টি দিচ্ছে এক বছর! সে ক্ষেত্রে ব্যবহারকারীরা কমদামে মোবাইল সেট পেলেও প্রকৃতপক্ষে তাদের কোন লাভই হচ্ছে না। সেট নষ্ট হলে অথবা কোন সমস্যা হলে তা মেরামতের কোন উপায়ও নেই। ফলে সেটটি ফেলে দিয়ে আবারো নতুন সেট কিনতে হয়। এতে তাদের বাড়তি টাকাও খরচ হচ্ছে। আমদানিকারকরা জানান, চোরাইপথে আসা এসব নিম্নমানের অধিকাংশ সেট সবই আসে চায়না থেকে। কিছু কিছু আসে থাইল্যান্ড থেকে। আর এখন গ্রামীণফোন ঢাকঢোল পিটিয়ে যে মোবাইল সেটটি গ্রাহকের হাতে তুলে দিচ্ছে সেটি চায়নার তৈরি নিম্নমানের। এটির স্থায়িত্ব মাত্র একবছর। অথচ একই টাকায় অন্য ব্রান্ডের সেট কিনলে গ্রাহক নিশ্চিন্তে কয়েক বছর ব্যবহার করে যেতে পারবেন। গ্রামীণফোন তাদের গ্রাহক সংখ্যাধিক্যের কথা চিন্তা করে মিডিয়ায় বাহারী রঙের বিজ্ঞাপন দিয়ে খুব সহজেই জনগণের সাথে প্রতারণা করে যাচ্ছে।
জানা গেছে, গ্রামীণফোন পুরনো ও কমদামী মোবাইল সেটের ওপরের অংশ (কভার) পরিবর্তন করে এসব সেট বাজারে ছেড়েছে। অনেকেই বলছেন, মোবাইল সেটটি ক্রয়ের কয়েক দিন পরেই সমস্যা দেখা দিয়েছে। অনেকেই গ্রামীণফোনের কাস্টমার কেয়ারে এসে তা পরিবর্তন করে নিয়ে গেছেন। এ সময় কেন সমস্যা দেখা দিল তা জানতে চাইলে কর্তব্যরত কর্মকর্তা বলেন, ভাই, মেশিনারী জিনিসের উপর তো ভরসা করা যায় না! যে কোন সমস্যা দেখা দিতে পারে। যারা কিনেছেন, তারা বলছেন তারা নিজেরা গ্রামীণফোনের প্রতারণার শিকার হয়েছেন। সবকিছু যাচাই বাছাই না করে যারা গ্রামীণফোনের এ সিটটি কিনবে তাদের একটা সময় দীর্ঘশ্বাস ছাড়া কোন উপায় থাকবে না। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গ্রামীণফোনের নিম্নমানের এসব সেট কিনে প্রতারিত হচ্ছেন গ্রাহকরা। গ্রামীণফোনের নাম শুনেই অনেকে এই সেটটি কিনছেন। কিন্তু তারা তো জানেন না এসব সেটের �ওপরে ফিটফাট ভেতরে সদর ঘাট'।
নকল ও নিম্নমানের সেট বাজারজাত করা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে কারো নাম উল্লেখ না করে বাংলাদেশে নকিয়ার হেড অব মার্কেটিং নংফেল আনোয়ার বলেন, বিভিন্নভাবে নকল ও নিম্নমানের সেট বাজারে আসছে। কেউ কেউ তাদের সুনামকে পুঁজি করে বাজারে নিম্নমানের সেট ছাড়ছে। এর ফলে ক্রেতারা হরহামেশাই প্রতারিত হচ্ছেন। অনেক সুবিধার কথা বলে যে সেট বিক্রি করা হচ্ছে আসলে সেগুলো খুবই নিম্নমানের। এ ক্ষেত্রে গ্রাহকদের আরো সচেতন হতে হবে। এ ছাড়া সরকারকেও নকল ও নিম্নমানের সেট আমদানি ও বাজারজাত করার ব্যাপারে কঠোর হতে হবে।
ঢাকাস্থ মোবাইল সার্ভিসিং সেন্টারের এক ইঞ্জিনিয়ার এ প্রতিবেদককে বলেন, বিভিন্ন কোম্পানির নামে হুবহু সেট এখন বাংলাদেশেই তৈরি করা যায়। অত্যন্ত দক্ষ হাতে এগুলো নির্মাণ করা হয়। হংকংয়ে বিভিন্ন ব্রান্ডের ক্রুটিযুক্ত মোবাইল সেটের মাদারবোর্ড বিক্রি হচ্ছে লট হিসাবে। সেখান থেকে কিনে নিয়ে এসে দেশে এবং চীনের অনেক কোম্পানি এখন সেগুলোকে নতুন করে ফেলছে। ওই মাদার বোর্ডের উপর আবার তৈরি করা মোবাইল সেট হুবহু নকল করা সম্ভব। যা দেখে বিশেষজ্ঞরাও শনাক্ত করতে হিমশিম খান।
সার্বিক ব্যাপারে জানতে চাইলে গ্রামীণফোনের ডিজিএম সৈয়দ তালাত কামাল বলেন, এসব অভিযোগের ব্যাপারে কোন মন্তব্য করবো না। যদি কোন খারাপ কিছু পেয়ে থাকেন তাহলে লিখেন। যদিও গত ৩১ আগস্ট হ্যান্ডসেটের উদ্বোধনকালে গ্রামীণফোনের প্রধান নির্বাহী (সিইও) ওডভার হেশজেদান বলেন, গ্রাহক সেবার মান বাড়ানোর ধারাবাহিকতায় তারা নিজস্ব ব্র্যান্ডের এ সেট বাজারজাত করেছে। এই সেটে একসাথে অনেক সুবিধা পাওয়া যাবে। তিনি আরও বলেন, সব ধরনের গ্রাহকদের কথা চিন্তা করে গ্রামীণফোন এই হ্যান্ডসেটটি বাজারে ছেড়েছে।

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




